১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারী এরশাদের ভাড়াটিয়া খুনিদের গুলিতে শহীদ হন বসুনিয়া। এই দিনে পরম মমতার সাথে স্মরণ করি তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়াকে। স্বৈরাচার এরশাদ তার ক্ষমতা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করার লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাচন করার উদ্দ্যোগ নেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রাজনৈতিক দলসমূহ সেটা প্রতিহত করার ডাক দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ.এফ রহমান হল এরশাদের ছাত্র সংগঠন নতুন বংলা ছাত্র সমাজের দখলে ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐ দিন সকালে নিয়মিত মিছিল শেষে স্যার এ এফ রহমান হল অভিমুখে রাতে মিছিলের সিদ্ধান্ত নেই। এ ছিল এক কঠিন সিদ্ধান্ত। মিছিলে আক্রমণ হবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা সূর্যসেন হল ও মোহসিন হলের গেটে জমায়েত হই। মিছিলটি মোহসিন হল থেকে বের হয়ে জহুরুল হক হলের মোড় পর্যন্ত অগ্রসর হতেই একটি মোটরসাইকেলে কালো কোট পরা দুই যুবক মিছিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক রাউন্ড গুলি করে চলে যায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বন্ধু বসুনিয়া আমার হাত ধরা ছিল । কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। এফ রহমান হল ও মোহসিন হল এর মাঝখানে তখন সংঘর্ষ চলছে। আমার বন্ধু প্রয়াত কাজী জামিল হক রাজা চিৎকার দিয়ে উঠল বসু আর নাই। আমি বসুনিয়ার নিথর দেহে হাত দিয়ে দেখলাম সব শেষ।
আমাদের এক সহযোদ্ধা মুকুল ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছে নিম্নরূপ:
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এরশাদের গুন্ডা বাহিনীর হাতে নিহত হন রাউফুন বসুনিয়া
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে সূর্য সেন হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ের দায়িত্ব ছিল বাসদ ছাত্রলীগের। আমরা সন্ধ্যা থেকেই রুমে রুমে যেয়ে মিটিং-এ আসার জন্য সবাইকে বলতে থাকি। রাত সাড়ে আটটা নয়টার দিকে বসু ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয় হলের ভিতরে। আমাকে জিজ্ঞেস করে রানা হামিদ কোথায়। আমি বলি সামনে যান রানা ভাই আর শফি ভাই সামনেই বসে আছে। আমাদের কারো এক জনের রুমে ডিমের তরকারি আর ভাত রান্না হয়েছিল। সেখানে আমারও খাওয়ার কথা তাই বসু ভাইকে বলি ভাই মিটিংয়ের দেরি আছে ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খাবেন? তিনি না বলে গেটের বাইরে চলে যান। যথারীতি সভার প্রস্তুতি চলাকালে আমি উনাদের কাছে গেলে শফি ভাই বলেন তার ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি বললাম তাহলে সিগারেট খাচ্ছেন কেন? আমার উদ্দেশ্য ছিল সিগারেটের বাকি অংশটায় ভাগ বসানো। সেই সভায় সে রাতে সভাপতিত্ব করে আমাদের হল শাখার সভাপতি কামিদ।
নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখার পর এরশাদের উপজেলা নির্বাচন বন্ধসহ ১৪ ফেব্রুয়ারি বটতলার জমায়েতে যোগদানের আহবান জানিয়ে আমরা স্লোগান দিতে দিতে মহসিন হল পার হয়ে সামনে এগুতে থাকি। সংখ্যায় ৩০/৩৫ জন ছিলাম। মিছিলের সামনে ছিল শফি ভাই, রানা, হামিদ, বসু ভাই ও অন্যান্যরা। মহসিন হল পার হতেই শফি ভাই দ্বিতীয় সারিতে এসে দুই একবার স্লোগান দিতেই তার গলা বসে যায়। তারপর বসু ভাই জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো বলতেই তার গলার স্বরও দুর্বল হয়ে যায়। সাধারণত প্রায় সব মিছিলে আমি অন্যান্যদের সাথে স্লোগান দিতাম। খানিকটা লজ্জায় আমি বসু ভাইকে বলি ভাই আপনে সামনে যান আমি স্লোগান ধরছি । তখন আমি স্লোগান ধরি দ্বিতীয় সারি থেকে। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো, খুনি এরশাদের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবনা। ততক্ষণে মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেছে। একটা বাইক সামনে দিয়ে খুব জোরে শব্দ করে এফ রহমান হলের দিকে চলে গেল। ঠিক তখন সামনের সারিতে পাশাপাশি বসু ভাই, শফি ভাই ও রানা হামিদ ভাই । তারপরই এফ রহমান হলের সামনে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একজন কেউ গুলি করছিল। ধুপ করে একটা শব্দ শুনেছিলাম। নিচু হয়ে তাকিয়ে দেখি বসুভাই, রক্তে ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঢেকে গেছে চোখ আর কপাল।
বসুনিয়ার নিষ্প্রাণ নিথর দেহ আমরা ক্রলিং করে মোহসিন হলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। মোহসিন হল থেকে ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা এফ রহমান হলের দিকে শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। অবশেষে লাশ মহসিন হলের গেষ্টরুমে নিয়ে আসতে সমর্থ হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য শিক্ষকগণ ও কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতাদের মধ্যে অনেকেই মহসিন হলে পৌঁছান। পুরো ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসেও নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। পরে পুলিশ পাহারায় লাশ ঢাকা মেডিকেল এর মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরদিন সকালে শহীদ বসুনিয়ার লাশ নিয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য মিছিল শুরু হয়। মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শেষ করে পুরনো ঢাকার দিকে যেতে থাকলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বেধে যায়। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে রাজপথে বিভিন্ন সরকারি যানবাহন ও স্থাপনার ওপর হামলা চালায়। ফলশ্রুতিতে স্বৈরাচারী এরশাদ উপজেলা নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
বসুনিয়ার আত্মদান নয় বছরের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে। স্বৈরাচারের পতনের ৩৪ বছর পরেও আমরা ঠিক যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমরা একটি গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছিলাম দেশে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে। বসুনিয়ার আত্মদান বৃথা যাবে না কারণ একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজ একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। একদিন তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে কত আত্মত্যাগ কত প্রাণ বলির মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়েছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)