৫ আগষ্ট, ২০২২, রাতের বেলা। অভ্যাসবশত: বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের মধ্যকার একদিনের ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। খুবই আশা ছিল, তিন ম্যাচের ওডিআই সিরিজটির সব কটি ম্যাচই জিতে আসবে পারবে টাইগাররা যদিও টি-২০ তে মাত্র হতাশার সৃষ্টি করেছিল।
আশাবাদে উজ্জীবিত ছিলেন বহু দর্শক খেলোয়াড়রাও। তবুও নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছিল না। জিম্বাবুয়ে ব্যাটিং শুরু করে পরে-বাংলাদেশ টসে হেরে আগে ব্যটিং করতে বাধ্য হয়। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশী ব্যাটাররা যখন ৩০৩ রান তুলে নেন তখন এই আশাবাদ তুঙ্গে ওঠে। সব কটি ব্যাটারই ভাল খেলেছেন তাই এমন আশাবাদ।
আমি খুব একটা ক্রিকেট যোদ্ধা নই তবে ধীরে ধীরে ক্রিকেট ভক্ত হয়ে পড়েছি। কোভিড ১৯ এর সুবাদে গৃহকর্মী ও পুত্র কন্যাদের চাপে একটানা আড়াই বছর আদৌ বাইরে যাতায়াত নেই। শতভাগ গৃহবন্দী হয়ে পড়ার ফলে লেখালেখি, ঘুম আর ক্রিকেট খেলা দেখা-এই হয়ে দাঁড়িয়েছে দৈনন্দিন রুটিন। সে অনুযায়ীই বিগত ৫ আগষ্ট ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম।
কিন্তু যে আশাবাদের সঞ্চার হয়েছিল তা প্রধানত: বাংলাদেশের বোলারদের মারাত্মক বোলিং দুর্বলাত এবং জিম্বাবুয়ের আক্রমণাত্মক সফল ব্যাটিং এর কারণে তা মিইয়ে যেতে সুরু করে। মনটাও সে কারণে খারাপ হতে থাকে।

খেলার ফলাফল-আশাবাদ-নৈরাশ্য টি.ভি চ্যানেলের সচিত্র প্রতিবেদনে বাজারে পণ্য সরবরাহ ও পণ্য মূল্য পরিস্থিতি। বিশেষ করে বাজারে ব্যাপক সরবরাহ থাকা সত্বেও কাঁচামরিচের দাম ট্রিপল সেঞ্চুরীতে পৌঁছানোর মারাত্মক খবরটি। হিসাব কোনভাবেই মিলাতে পারছিলাম না-কেন কি কারণে কাঁচামরিচের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে কে.জি প্রতি ৩০০ টাকায় পৌঁছালো। বিগত ৯০ বছরে তো এমনটা একদিনের জন্যেও হতে দেখি নি।
আমি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদ্রষ্টা। তেমনি আবার ওই মহাযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী চলাকালে অবিভক্ত বাংলায় পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৩/৪ বছর আগে “পঞ্চাশের মন্বন্তর” নামে বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল এবং যাতে লক্ষাধিক বাঙালির মৃত্যু ঘটেছিল খাদ্যের মারাত্মক অভাবে এবং পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তা ক্রয়শক্তির অভাবে-তাতেও তো কাচামরিচের দাম বেড়ে এমন কি ৫ টাকা সেরও হয় নি। চালের মূল্য বেড়ে ১০০ টাকা মনে পৌঁছেছিল-তাই মানুষ কিনে খেতে না পেরে পথে ঘাটে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। তখন তো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এশিয়া মহাদেশকে স্পর্শ করেছিল-জাপানে হিরোসিমা-নাগাসাকিতে এটম বোমা প্রথম বারের মত নিক্ষেপ করে যে মারাত্মক ধ্বংসলীলা ঘটানো হয়েছিল-আজকের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তো এখনও ইউরোপের মাটিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। আর তার প্রতিদক্রিয়ায় বড় জোর আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে কিন্তু বাংলাদেশের কৃষিপন্যের দাম কেন বাড়বে-তার উপযুক্ত জবাব মেলা ভার। এদেশে কৃষকরা পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করেন না-করে থাকে সিণ্ডিকেট-যারা কৃষকের কাছ থেকে জলের দামে কিনে মধ্যস্তভোগী হিসেবে আবার বড় বড় পাইকারদের কাছে বিক্রী করে। তাদের কাছ থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনে আমাদের মত সাধারণ ক্রেতাদের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু দাম বাড়ায় বৃহৎ আড়তদারেরা-তারাই লাভের বড় অংশ খেয়ে নেয়।
এই আড়তদারদেরকে সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো তবে কিন্তু মানুষকে ট্রিপল সেঞ্চুরীতে কাঁচামরিচের পৌঁছানো দেখতে হতো না। বিশেষ করে এখন যে বর্ষাকাল চলছে কাঁচামারিচ ও পটল সহ বহুবিধ সবজি ও তরীতরকারির এখন মৌসুম। আর এক মওসুম আসবে শীতকালে। তখন ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, সি, আলু এবং বহুবিধ ফসল ফলবে-বাজারে সারি সারি দোকান বসবে ওই পণ্য সম্ভার নিয়ে। তবে এবার যেমন বর্ষকাল শেষ হতে গেলেও আজও যেমন গ্রীষ্মকালের সমাপ্তি ঘটে নি তাতে ভয় হয়, শীতকালটাও কি গ্রীষ্মকালেই বিলীন হয়ে যাবে?
মূল্যবৃদ্ধি যদি কাঁচামরিচেই সীমাবদ্ধ থাকতো ধরে নিতাম আবহওয়াজনিত কারণে এবং সম্প্রতি সামান্য কিছু বৃষ্টি হওয়াতে হয়তো সাময়িকভাবে কিছুটা দাম বেড়েছে-২/৩ সপ্তাহের মধ্যেই দাম স্বাভাবিকে ফিরে যাবে। কিন্তু যখন দেখি আজ ৮/৯ মাস যাবত চালের দাম ক্রমশ বেড়েই চলেছে তখন তো ওই জাতীয় কোন সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ থাকে না। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে আরও শক্তিশালী সিণ্ডিকেট।
সম্ভবত: চালের ওই একই সিণ্ডিকেট নানা জাতের ডাল, ভোজ্য তেল ও মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ছোটবেলা থেকে বাজার করায় অভ্যস্ত হওয়াতে বাজারের ভাব-ভঙ্গী জীবনভর খুব ভাল বুঝতাম। কিন্তু জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে সেগুলি বুঝার ক্ষমতা যেন দিন দিনই হারিয়ে ফেলছি। উদাহরণ ¯^রূপ বলি, যখন আউসের বা আমনের বা ইরি মওসুম আসতো-ভালভাবেই জানতাম চালের দাম কমবে এবং তা দিব্যি কমতো ওই মওসুমগুলিতে। শীতকালে তরীতরকারি বা গ্রীষ্মকালে গ্রীষ্মকালীন সবজি-তরকারির দাম নিশ্চিতভাবে কমতো। ডালের ক্ষেত্রেও তাই। শীতকালে মাছের সরবরাহ বাড়তো-দামও কমে যেত।
অর্থনীতির ভাষায় আগের দিনে মুরুব্বীদের বলতে শুনেছি- সাপ্লাই ও ডিমান্ড সংক্রান্ত তত্ত্ব। শুনতাম মানুষেল প্রয়োজন (ডিমান্ড) অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ হয়-তেমনই আবার সরবরাহের ওপর পণ্য মূল্যের উঠানামা নির্ভর করে। সে কালের পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদেরা বাজার সরবরাহ, পণ্য মূল্যের ওঠানামা বিষয়ে ওই জাতীয় তত্ত্বের অবতারণা করতেন।
বুঝা দুস্কর, এই তত্ত্ব এখন আর বাজারে খুব একটা চালু নেই। কেন নেই তা দুর্বোধ্য। এখন তো আমরা আরও অনেক বেশী শক্তিশালী পুঁজিবাদ গড়েতুলেছি। তবে বাজার কেন সেই থিওরি মানছে না? নিয়ন্ত্রণ তো সরকারের করার কথা। কারণ নাগরিকদের সার্বিক জীবন পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্যই তো রাষ্ট্র। কারণ নাগরিকেরা সরকারকে কর প্রদান করে আর ওই করের টাকায় সরকার চলে। মন্ত্রীদের বেতন বাড়ীভাড়া, এমপিদের ভাতা (বিপুল অংকের) থেকে সুরু করে লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মচারীদের জীবন যাপনে সাবর্কি অর্থ সহায়তা যে জনগণ জোগান দেয়, তাদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে আইন মোতাবেক ব্যবস্থাদি গ্রহণের রাষ্ট্র বা সরকার পিছিয়ে থাকবে কেন?
জানি, রাষ্ট্র বা সরকারের কোন মন্ত্রী বা এম.পি. আমার মত একজন ক্ষুদ্র নাগরিকের কথা বা প্রশ্নের উত্তর দিতে আসবেন না। জবাবদিহিতা বিহীন আমাদের এই ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র। তবে এটা পরিস্কার যে আগে উল্লেখ করা শক্তিশালী এক বা একাধিক সিণ্ডিকেটই ইতিমধ্যে পূরা বাজারের নিয়ন্ত্রভার নিয়ে নিয়েছে এবং তারাই পণ্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি সহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে বলেই মওসুম বা সরবাহ, চাহিদা প্রভৃতি বিষয় এখন গৌণ হয়ে পড়েছে।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টা অনেকাংশে পরিস্কার হবে। আমরা জানি, আমাদের যে বিপুল পরিমাণ ভোজ্য তেল এর প্রয়োজন-তা দেশে উৎপাদিত সরিষা, বা সয়াবিন বী জবা সূর্য্যমুখী ফুলের বা অন্য কোন কিছু থেকে উৎপাদিত তেলে পূরণ হয় না। চাহিদার প্রায় পূরোটাই আমদানীর ওপর নির্ভর করে। তাই আমদানী যারা নিয়ন্ত্র করে তারাই বা তাদের মনোনীতরাই সারা দেশে অসংখ্য সিণ্ডিকেট গড়ে তুলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টা নির্ধারণ করছে। আর যেহেতু এরা সবই সরকারের সাথে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট-তাই তাদের গায়ে হাত দেবে এমন শক্তিশালী হাত কার আছে? সবটাই এখন ঘোর দলীয় করণের আওতায়-বিশেষ করে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলিতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলিতে।
কিন্তু এই সিণ্ডিকেট সদস্যরা নিজেরা সংখ্যায় অত্যন্ত কম হয়েও যেভাবে কোটি কোটি সাধারণ নাগরিকের কষ্টার্জিত অর্থ সম্পূর্ণ বে-আইনী ও অযৌক্তিকভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে যে কোন জবাবদিহিতামূলক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারা অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয় এবং যথারীতি আইনের আওতায় এনে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়। আমরা তেমন কিছু কল্পনাও করতে পারি না।
মাঝে, কয়েক সপ্তাহ আগে সরকার সয়াবিন তেলের দাম বেশ কিছুটা কমালেন তা আজও বাজারে কার্য্যকর হয় নি। কিন্তু দাম যখন বাড়ায়, তখন সিণ্ডিকেট নেতারা টেলিভিশনে খবরটি দেখার সাথে সাথে বার্ধিত দামের পণ্য কেনার অপেক্ষা না করেই দাম বাড়িয়ে দেয়।
ওই ৫ আগষ্ট রাতে হঠাৎ বিশেষ খবর টেলিভিশনের সকল চ্যানেলে প্রচারিত হতে শুরু করলো। সেই খবরে জানান হলো জ্বালানি তেল যেমন ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনের মূল্য একবারে ৫০ % বাড়ানো হয়েছে এবং রাত ১২ টা থেকেই তা কার্য্যকর হবে। সাথে সাথে স্বভাবত: তেলের পাম্পগুলিতে বিপুল ভীড় জমে গিয়েছিল দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্র।
আজ ৬ আগষ্ট। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে দেখি প্রতিবাদের ঝড়। তার পরে চোখে পড়লো বাস মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম। তারা হয় বাড়তি ভাড়া নেবে-যদিও এখন পর্য্যন্ত বাড়তি ভাড়া নির্ধারিত হয় নি-নয়তো গাড়ী রাস্তায় বের করবে না। আগের দামে কেনা তেল দিয়ে বেশী মুনাফা করার সুযোগ কেউই হাত ছাড়া করতে রাজী নন। অবশেষে বেলা ১১ টার দিকে এসে সরকারি হস্তক্ষেপে স্থির হলো বিকেলে বি আর টি এ অফিসে দ্বিপাক্ষীয় বৈঠকে বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ না করা র্প্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদৌ না নেওয়া কিন্তু গাড়ী চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হবে। জানি না রাস্তার অবস্থা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পরিবহন মালিকেরা সাবেক ভাড়ায় যান চলাচল স্বাভাবিক রেখেছে কি না।
এখন দেখা যাক জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধিতে শুধুই কি বাস-ট্রাক-কার-মাইক্রো-জীব প্রভৃতি প্রভৃতির ভাড়াই বাড়বে না কি এর প্রতিক্রিয়ায় আরও কিছু ঘটাবে?
নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায় এর পরিণতিতে শিল্প কারখানায় প্রস্তুত সকল পণ্য, কৃষি পণ্য প্রভৃতি সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। বাড়বে বিদ্যুতের এবং গ্যাসের দামও। তার কিছু দিনের মধ্যেই নতুন করে সকল পণ্যেরই মূল্য বৃদ্ধি ঘটা নিশ্চিত ।
এখন প্রশ্ন হলো-মানুষের আয় উপার্জন কি বাড়বে? উত্তর হলো-হ্যাঁ, বাড়বে-তবে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ লোকের আয়-উপার্জন বিপুলভাবে বাড়বে। অর্থাৎ ধনীরা ধনী হবে আরও। কিন্তু বাদ বাকী ৯০-৯৫ ভাগ মানুষ? তাদের আয়ের কি হবে? না, তাদের আয় বাড়ার কোন প্রশ্নই নেই-তা বরং কমবে। কারণ যিনি আগে ৫০০ গ্রাম দুধ কিনতেন-তিনি এখন বেশী হলে ২০০ গ্রাম কিনবেন। সকল পণ্যের ক্ষেত্রেই এমন হবে। তাই পেটের ক্ষুধা মেটানো যাবে না কারণ কম বা ন্যায্য দামে বাজারে কোন পণ্য নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)