চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান: তৃণমূলের আপোষহীন প্রতিনিধি

KSRM

প্রতিটি মানুষকে একজীবনে অনেকজীবনের জন্য যুদ্ধ করতে হয়, লড়াই করতে হয়। কোনোটা একান্ত জীবনের লড়াই, কোনোটা সামষ্টিক জীবনের লড়াই; প্রাইভেট লাইফ ও পাবলিক লাইফ, তিনি দুটো জীবন করেছেন। কঠোর পরিশ্রম ও ধৈর্যবান মানুষের এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে গেছেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান, ময়মনসিংহের মানুষের প্রিয় প্রিন্সিপাল স্যার বা মতি স্যার। গত ২৭ আগস্ট তিনি প্রয়াত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে যারা কিংবদন্তি, তাদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান অন্যতম। যেদিন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পথ চলা শুরু করেছেন, সেদিন থেকে খাঁটি ঈমানদার মানুষের মতো দল ও নেতার নির্দেশ পালন করে গেছেন আজীবন। যেমনটা তিনি ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে করেছেন পরম মমতায়। এক্ষেত্রে প্রিন্সিপাল স্যারকে একজন একমুখী মানুষ বলা যায়।

Bkash July

এই একমুখী মানুষটির গুণমুগ্ধ অনুসারীরা তাঁকে ‘ময়মনসিংহের সিংহপুরুষ’, ‘অনেক পাতার ইতিহাস’; এরকম নানান অভিধায় ভূষিত করে থাকেন। এসবই কর্মীদের আবেগ থেকে উৎসারিত শব্দমালা, মিথ নাকি বাস্তবতা? প্রিন্সিপাল স্যার একজীবনের বিভিন্ন পর্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান, পুত্র, স্বামী, পিতা, ছাত্র-শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ, পৌরসভার চেয়ারম্যান, দলের জেলা পর্যায়ের শীর্ষ পদ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, এবংবিধ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি শুধু আওয়ামী লীগের দলীয় দায়িত্ব পালন, বিশেষ করে ব্যক্তিগত জীবনের অর্জনের আলোকে বিষয়গুলোকে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

২.
গ্রামের একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান কৃষকের সন্তান। মক্তব ছেড়ে স্কুলে পড়ছেন। পঞ্চাশের দশকের বাস্তবতায় কঠিন হলেও সেটাই হয়েছিল। নিজ বাড়ি ছেড়ে দূরে লজিং থেকে স্কুলে পড়ছেন, সেখান থেকে সে-যুগের অজপাড়াগা শেরপুরের নকলায় গিয়ে স্কুলে ভর্তি হচ্ছেন। আবার ময়মনসিংহ শহরে ফিরে এসে মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করছেন। তারপর আনন্দমোহন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই জীবন-সংগ্রামের দৃঢ়তার সন্ধান পাওয়া যায়। বাঙালি মুসলমানের এগিয়ে যাওয়ার এমন গল্প পুরো দেশ জুড়ে। সাতচল্লিশে দেশভাগের প্রাক্কালে ও পরে আগতদের কথা আলাদা। বাদবাকীদের জন্য এটা প্রায় আদর্শ গল্প। হয়ত সময়ের তফাৎ আছে, কিন্তু জীবন-সংগ্রামের এই লড়াইকে অস্বীকার করার জো নেই। এই লড়াইয়ে জিতেছে তারাই, যারা অদম্য ছিলেন। টিকেছে তারাই, যারা অনমনীয় ছিলেন। প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান অদম্য ও অনমনীদের গোত্রভুক্ত ছিলেন।

Reneta June

স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবনের সূচনা করেন। গফরগাঁয়ের পাঁচবাগ স্কুল এবং নরসিংদী জেলার মনোহরদীর হাতিরদিয়া স্কুলে পড়িয়েছেন। এক পর্যায়ে পড়ানো ছেড়ে নিজে পড়তে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর আবারও পড়ানোতে যোগ দেন, এবার কলেজে। জামালপুরের নান্দিনা, ময়মনসিংহ কলেজ ও নাসিরাবাদ কলেজে শিক্ষকতার সময়েই সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। রাজনীতিবোধই তাকে নতুন একটি কলেজের জন্ম দিতে প্রেরণা জোগায়। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে আইয়ুব-মোনায়েম খানের হাতে শহীদ আলমগীর মনসুর মিন্টু’র নামে স্থাপিত কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেন।

আইয়ুব খানের খয়ের খা গভর্নর মোনায়েম খানের বসতিও ময়মনসিংহ শহরে, সেই শহরেই মোনায়েম খানের নির্দেশে নিহত ব্যক্তির নামে গড়া কলেজের নেতৃত্ব দেওয়ার ঘটনা সাদা চোখে অতি সাধারণ ‘চাকুরি-বিষয়ক’ মনে হলেও, এখানে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক চেতনার বিষয় আছে। আছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় সিক্ত হবার দারুণ রোমাঞ্চ ও সংকল্প। সেই রাজনৈতিক চেতনায় শাণিত হয়েই আর পাঁচজন সাধারণ কলেজ শিক্ষকের মনোস্কামনার কাঠামো ভেঙে তিনি হয়ে উঠেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান।

৩.
কলেজ গড়া ও দলের সাথে পথ চলার মধ্য দিয়েই চলে আসে একাত্তর। সময়ের প্রয়োজনে এবারও হাতে তুলে নেন জাতীয় দায়িত্ব। মেঘালয়ের ঢালু যুব শিবির সম্পর্কে ‘যখন এমপি ছিলাম’ বইতে গফরগাঁও থেকে নির্বাচিত এমপিএ মোঃ আবুল হাশেম লিখেছেন- ‘বারেঙ্গাপাড়ার অদূরে মাচাঙপানির নিকটেই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে আসা মানুষদের অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য একটি শিবির খোলা হল। এই শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন ময়মনসিংহের মিন্টু কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছুদের তালিকা তৈরি করে ভারতের ভিতরে বিভিন্ন (ট্রেনিং)ক্যাম্পে পাঠানো হত’। মুজিবনগর সরকারের “বোর্ড অব কন্ট্রোল ইয়ুথ ক্যাম্প”-এর সচিব মোহাম্মদ নুরুল কাদের লিখেছেন- ‘পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় এই রাজ্যগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী যুব ক্যাম্পের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৬টিতে উন্নীত হয়েছিল’। অবশ্য ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থী শিবির’ নামক বইতে আসাদুজ্জামান আসাদ ১১৫টির উল্লেখ করেছেন। যাহোক, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-প্রথমদিকে স্থাপিত অভ্যর্থনা ও প্রশিক্ষণ দুই ভাগে ২৮টি যুব শিবিরের ক্যাম্প ইন চার্জের দায়িত্ব পালন করেছেন তৎকালীন সংসদ সদস্যগণ। এর বাইরে যারা যুব শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের একজন ঢালু অভ্যর্থনা যুব শিবিরের প্রধান ব্যক্তি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। এরপর যুদ্ধ জয়।

যুদ্ধ জয়ের প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত দিবসের একটি ছবি এরকম- অনেক মুক্তিযোদ্ধারা অমিত তেজে শহরে ঢুকছে, কাঁধে স্টেনগান, হাতে লাল-সবুজের পতাকা, কপালে ফ্যাট্টি বাঁধা, চোখে স্বপ্ন জয়ের আকাঙ্ক্ষা, হত্যা বন্ধের যুদ্ধে শহীদ হবার প্রত্যয়, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে নদী পেরিয়ে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা মিছিল করে শহরে ঢুকছে; একবার কল্পনা করুন- গায়ে কাঁটা দেয়। ‘ময়মনসিংহে একাত্তর’ বইতে তৎকালীন জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহাম্মদ আব্দুশ শাকুর লিখেছেন-‘শহরের তরুণেরা হৈ হৈ করে ছোটাছুটি করছে। একদল ছুটেছে শম্ভুগঞ্জ ঘাটে, মুক্তিবাহিনীকে এগিয়ে আনতে’। শহরবাসীর পক্ষে ‘ডা. কে জামান ও পেপারল্যান্ডের আনিসুর রহমান দুদু ফুল নিয়ে স্বাগত জানালেন’। সেদিন এরকম একটি মিছিলের সামনে এলোমেলো চুল-দাঁড়িতে শোভিত যাকে দেখা যায়, তিনি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। স্যালুট!

আবার আরেক চিত্রও দেখেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশেরই দুর্ভাগ্য বটে! সেদিন যারা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে পরাজিত হয়ে পালিয়েছিল কিংবা বিচারের মুখোমুখি হয়ে কারাগারে গিয়েছিল, তাঁদেরই হাতে প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানকে কারাগারে যেতে হয়েছে একাধিকবার, একেবারে মিথ্যা-সাজানো মামলায়। জেলখাটা দুজন স্বাধীনতা বিরোধীর কাছে, ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে এবং ১৯৮৩ সালে পৌরসভা নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়েছিল। এছাড়া আরও দুবার হেরেছিলেন স্বাধীনতা বিরোধীদের একজন মুখপত্রের কাছে। ১৬ ডিসেম্বরের সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল ৭ নভেম্বরের চেতনাধারীরা। এই প্রসঙ্গে আমার শিক্ষক অধ্যাপক যতীন সরকারের ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ বই থেকে কোট করছি। তিনি লিখেছেন-‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের মৃত্যু আমরা নিজ চোখে দেখেছি। শুধু দেখি নি, আমরাই তার মৃত্যু ঘটিয়েছি। তবে মরার পরও যে পাকিস্তান এখানে আছে-সে কথাও অস্বীকার করতে পারি না। আছে ভূত হয়ে।‘ পাকিস্তানের এই ‘ভূতদর্শন’ এর কাছেই প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানদের পরাজিত হতে হয়েছিল। কী নির্মম রাজনৈতিক বাস্তবতা! লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির কারও কাছে পরাজিত হবার নজির নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রিন্সিপাল স্যারের জন্য গৌরব ও আনন্দের বিষয় হলো-স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির তিনি ছিলেন প্রতিনিধিত্বশীল অন্যতম প্রধান ব্যক্তি।

৪.
জাতির প্রয়োজনে জাতীয় দায়িত্ব পালন করে ঘরে ফিরেই লেগে যান দেশ গড়ার কাজে। স্থানীয় সরকারের পৌরসভায় নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ সেবা করা শুরু করেন। আর দলের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ময়মনসিংহ জেলায় এমন একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান, যেখানে তার একাধিক অগ্রজ নেতা ছিলেন ভারতবর্ষের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় নেতা ছিলেন। এরকম একটি এলাকায় নিজেকে তুলে ধরা, স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা মোটেও সহজ কাজ নয়। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান এই কঠিন কাজে সফল হয়েছেন। এক্ষেত্রে একটু নির্মোহ আলোচনা করা যেতে পারে। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল আবুল মনসুর আহমদ ও হাশিমুদ্দিন আহমদের হাত ধরে। সময়ের পরিক্রমায় হাশিমুদ্দিন আহমদ দল ছেড়ে ডানপন্থী হয়ে বহুদূরে চলে যান। আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিকে আমরা ১৯৬৪ সালের(মূলত ১৯৫৭) পর থেকে আর গ্রহণ করতে পারি না। বাঙালি মুসলমানের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দুটি ধারার মধ্যে আবুল মনসুর আহমদকে দেখা যায় রক্ষণশীল ধারায়। সম্ভবত সেজন্যই দীপেশ চক্রবর্তীর মতো সাব-অল্টার্ণ বুদ্ধিজীবীকে হায়ার করে আনতে হয় মনসুর সাহেবের পক্ষে উকালতি করে প্রগতিশীল বলে রায় দিতে। এছাড়া সাংগঠনিকভাবেও এই কমিটির তেমন অগ্রগতি দেখাতে পেরেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায় না। মহকুমার নিচের স্তরে পৌঁছাতেই পারেন নি।

এরপরে জেলায় নেতৃত্বের হাল ধরলেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া সাহেব। পুরো ষাটের দশক ও মুক্তিযুদ্ধকালে এই কমিটি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় চারনেতার অন্যতম শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামকে জেলার চেয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যক্রমে বেশি সময় দিতে হয়েছে। ষাটের দশকের সেই দুর্দিনে জাতীয় প্রয়োজনে তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনের পরে দেখা যাবে সারাদেশের থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। ময়মনসিংহ বলতে আজকের ময়মনসিংহ শুধু জেলা নয়। টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা নিয়ে ছিল ময়মনসিংহ জেলা। অস্বীকার করা অন্যায় হবে, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া দুর্দান্ত সংগঠক ছিলেন। ৬-দফা আন্দোলনে ময়মনসিংহ তো বটেই, কারামুক্ত থাকলে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন, সংগঠন গড়েছেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ছাত্রলীগকেও ময়মনসিংহ জেলায় গড়ে তুলেছিলেন রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া। ছিলেন জেলা শাখার প্রথম সভাপতি। ১৯৫৫ সাল থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ১৯৭৪ সালে সহ-সভাপতি। রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া সাহেবের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা প্রসঙ্গে আব্দুশ শাকুর লিখেছেন ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বিভিন্ন স্থানে সংগ্রাম কমিটি গঠন শুরু হয়েছিল, আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ময়ম্নসিংহ শহরে সেই সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। সবাই তাঁর কাছেই এসে ভিড় করছে’। জাতীয় জাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক শেখ আকরাম আলী, যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে ময়মনসিংহের একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তাঁর লেখা ‘গোপন দলিল ৭০-৭১’ বইতে লিখেছেন-‘ময়মনসিংহে স্বাধীনতাকামীদের দুটি কন্ট্রোল রুম। আওয়ামী লীগের কন্ট্রোল রুম সিটি স্কুলে। দুটি কন্ট্রোল রুম হলেও ময়মনসিংহের মূল নেতৃত্ব জনাব রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার হাতে। তিনিই প্রধান নেতা। যদিও সত্তরের নির্বাচনে হেরে গেছেন কিন্তু সাংগঠনিক দক্ষতায় বৃহত্তর ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের রাজনীতি তিনি পরিচালনা করছেন’। ভূঁইয়া সাহেবকে যারা সক্রিয় সহযোগিতা করছেন, তাদের মধ্যে প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের কথাও লিখেছেন শেখ আকরাম আলী। হত্যা বন্ধের যুদ্ধ জয়ের পরের কথা লিখেছেন আব্দুশ শাকুর-‘রফিক ভূঁইয়া এসে উঠেছেন শহরের রুবি প্রেসে। নিজের বাসাটি পাক-বাহিনীর মর্টারে বিধ্বস্তপ্রায়, তাই রুবি প্রেসে উঠেছেন। ওখান থেকেই তিনি যুদ্ধফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দুরূহ দায়িত্ব পরিচালনা করছেন’। এরকম একজন মহীরুহ সংগঠকের পরে নতুন কারও পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কিংবা সমকক্ষ হওয়া রীতিমত অসম্ভব কাজ। কিন্তু সেই অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের ক্ষেত্রে। কিভাবে?

ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। পঁচাত্তরের পরে মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দল বিভাজন করে আলাদা আওয়ামী লীগ গঠনের দায় থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। খুবই অল্পদিনের মধ্যেই দলেও ফিরেছিলেন। কিন্তু সেই দাগ আর মুছতে পারেন নি। যদিও ১৯৯২ অব্দি জেলা শাখার সভাপতি এবং ১৯৯৬ সালে মৃত্যু অব্দি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এরকম দুঃখজনক ঘটনা না ঘটলে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সিংহপুরুষের মর্যাদায় আসীন থাকতেন।

শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার সমভ্যিহারে সাময়িক বিচ্যুতি, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল কাদিরের নিষ্ক্রিয়তা; এহেন নেতৃত্বের শূন্যতায় প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের উত্থান ছিল তাঁর সংগ্রামী জীবনেরই আরেকটি পরিণতি এবং উত্তরণ। শুধু যে শুন্যতার কারণেই তাঁর উত্থান ঘটেছিল, এমন নয়।  বরং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বুদ্ধিমত্তা ও সাহস তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের দিকে এবং কেন্দ্র থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়েছেন চারপাশে। এটাকেই বলা যায় সেলফ মেইড লিডারশিপ বা স্বনির্মিত নেতা। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জেলা পর্যায়ে এরকম আরও অনেকের নামোল্লেখ করা যাবে। অনেকেই হয়ত ফেসবুক যুগের আগেই প্রয়াত হয়েছেন, কিংবা ২১ বছরের দুঃসহ যন্ত্রণাকাতর সময়েই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন; ফলে তারা রয়ে গেছেন অনালোচিত এবং অনেকের অপরিচিত। প্রত্যাশা, নিশ্চয়ই একদিন আলোর মুখ দেখবে।

৫.
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পৌরসভা নির্বাচনে প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান ময়মনসিংহ সদর পৌরসভার চেয়ারম্যান (বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন ও মেয়র) নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই পৌরসভা গঠনের দীর্ঘকাল পরে ১৯৪৮ সালে প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান পদে আসীন হয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতা খানবাহাদুর গিয়াস উদ্দিন পাঠান। এবং ১৯৭৩ সালে প্রথম একজন আওয়ামী লীগ নেতা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনিই প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। ১৯৭৭ সালে অকল্পনীয় হলেও, সামরিক জান্তা সুরকারের কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনিই পুনরায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। যখন সারাদেশের পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর ৮০ শতাংশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধী। নির্বাচিত হয়েছিল বলার চেয়ে, তাঁদেরকে পরিকল্পিতভাবে বিজয়ী করানো হয়েছিল। যা ছিল ১৯৭৩ সালের পুরো উল্টা চিত্র। সে সময়েও ময়মনসিংহ শহরের মানুষ প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানকে ভোট দিয়েছিলেন। তখন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

বিনাযুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনীর মতো প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান কখনোই বিনাযুদ্ধে কিছুই পান নি এবং হারান নি। সেটা হোক জনগণের নির্বাচনী যুদ্ধ, হোক দলের নেতৃত্ব পাওয়ার যুদ্ধ, সকল ক্ষেত্রেই তাঁকে ভোটযুদ্ধের মাধ্যমেই নেতৃত্বে আসীন হতে দেখা যায়। ১৯৮৭ সালে প্রথমবার যখন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন, তখনও কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু একবার, ১৯৯২/৯৩ সালে সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু কন্যা উপস্থিত ছিলেন, কাউন্সিলররা নেত্রীর উপরে দায়িত্ব হস্তান্তর করায় ভোটের প্রয়োজন হয় নি। অর্পিত ক্ষমতাবলে প্রয়াত জননেতা শামছুল হক সাহেবকে সভাপতি এবং প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করেছিলেন স্বয়ং নেত্রী। ১৯৯৭ সালে প্রথমবার যখন সভাপতি হন, তখন পার্টিতে তিনি খুবই কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন। এর আগে ১৯৯৫ সালে আহবায়ক কমিটি হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে। আহবায়ক কমিটিতে সদস্য ছিলেন, এমন পরিস্থিতিতেও কাউন্সিলরদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৩ সালেও ভোটের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হলেও ১৯৮৬ সালে সংসদে যান। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে পরাজিত হলেও ২০০৮ সালে সংসদে যান। পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২ বার নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাঁচবার পৌরসভায় নির্বাচন করে ৩ বার নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। মূলত ১৯৭৩ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার মধ্য দিয়েই জেলা শহরের শীর্ষ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন এবং সেটা গত ২৮ আগস্ট মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত, মাত্র ৩১ বছর বয়স থেকে ৮১ বছর বয়স পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর এই নেতৃত্ব ও গুরুত্ব বহাল রাখতে পেরেছিলেন। এমনকি জেলা শাখার দলীয় পদ, মেয়র-এমপি-মন্ত্রী না থেকেও শেষ পাঁচ বছরেও একই অবস্থানে ছিলেন। এটা এক বিরাট ব্যাপার। কিন্তু এই অসাধ্য কিভাবে সাধন হয়েছিল?

৬.
এই অসাধ্য সাধনের সুলুক সন্ধানেই পাওয়া যায় তার আসল পরিচয়।

শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিংবা রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার মতো ছাত্ররাজনীতির সোনালী অতীত তাঁর ছিল না। সোনার চামচ মুখে নিয়েও জন্মগ্রহণ করেন নি। জন্মযোদ্ধা হিসেবে কেবল যুদ্ধ এবং জীবনযুদ্ধের মাধ্যমে রাজনীতির মাঠেও অবিরত যুদ্ধ-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছিলেন। এতে ছিল একাগ্রতা ও দৃঢ়তা, ছিল মানুষের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, দল ও নেতৃত্বের প্রতি ছিল প্রশ্নহীন আনুগত্য। আমরা ফ্যাক্টগুলোর দিকে একটু তাকিয়ে দেখতে পারি। যুদ্ধফেরত বিরাট অংশ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ ছেড়ে জাসদ করলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান আওয়ামী লীগেই থাকলেন, জাতির পিতার প্রতিই আনুগত্য রাখলেন। পঁচাত্তরের পরে কেন্দ্র বা সারাদেশের কথা বাদই দিলাম, ময়মনসিংহের বিরাট অংশ আওয়ামী লীগে(মিজান)-এ চলে গেলেন, হোক তা অল্পসময়ের জন্য; প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান কিন্তু প্রায় কাণ্ডারীবিহীন আওয়ামী লীগেই রয়ে গেলেন এবং দলের প্রতিই আনুগত্য দেখালেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে জেলা বাকশালের যুগ্ম-সম্পাদক বানিয়েছিলেন, সেই মর্যাদা তিনি রেখেছিলেন। এরপরে ১৯৮৩ সালে সারাদেশ তো বটেই কুদরত উল্লাহ মণ্ডলের নেতৃত্বে ময়মনসিংহের একটা অংশ নবগঠিত দল বাকশালে চলে গেলেন, এবারও প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান দলের মূলধারায় থাকলেন এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এমন ভাঙ্গাগড়ার সময়গুলোতে তিনি স্থানীয় শীর্ষ নেতা ছিলেন না বটে, কিন্তু সদর পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন নিশ্চয়ই। দলের ভেতরকার এরকম নানান সংকট ছাড়াও সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের অতি-লোভনীয় প্রস্তাব এবং হুমকি কোনোকিছুকেই তিনি তোয়াক্কা করেন নি। সর্বশেষ ১/১১-এর সময়েও দল ও নেতার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখিয়েছেন। দল ও নেতৃত্বের প্রতি এমন প্রশ্নহীন আনুগত্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। দুর্বল চিত্তের মানুষ হলে কিংবা অবৈধ টাকা কামাই করলে এটা সম্ভব হতো না। এমনকি একজন অর্থনৈতিক মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। কেবল এবং কেবলমাত্র একজন রাজনৈতিক মানুষের পক্ষেই এটা সম্ভব। এজন্যই বলা যায়- প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান ছিলেন একজন খাঁটি ঈমানদার এবং সাচ্চা রাজনৈতিক মানুষ।

৭.
পঁচাত্তরের পরের সময়টা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য, দেশের জন্য চরম দুঃসময়ের যুগ। একদিকে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায়, যেটাকে যতীন সরকার বলেছেন ‘পাকিস্তানের ভূতদর্শন’ সেদিকে নিয়ে যাওয়া চলছে, অপরদিকে আওয়ামী লীগকে ভাঙ্গার খেলাও চলেছে। দলের এই ভাঙ্গাগড়ার একটা মিল পাওয়া যায় ষাটের দশকের সঙ্গে। সেনাশাসক আইয়ুব খানও এভাবেই এনডিএফ, পিডিএম, জাতীয় লীগ এরকম নানান নামের আড়ালে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেন নি, কারণ একজন শেখ মুজিব ছিলেন। পঁচাত্তরের পরে সেনাশাসক জিয়া অনেকটা সফল হয়েছিলেন, কারণ একজন শেখ মুজিব ছিলেন না, কিংবা ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠা একজন শেখ হাসিনা তখনও নির্বাসিত ছিলেন। দলের সকল ভাঙ্গাগড়ার খেলায় যতটা ছিল আদর্শিক ব্যাপার, এরেচেয়ে বেশি ছিল নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব; এবং নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের চেয়েও বেশি ছিল সামরিক জান্তার কূটকৌশল। সেই সময়টাতে একটু সাঁতার কেটে আসি।

১৯৭৮ সালের সম্মেলনে সাংগঠনিক রিপোর্টে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছিলেন- ‘দলের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী মুখোশধারী ও জাতীয়তাবাদী এই তিন মতাদর্শের অনুসারী রয়েছে’। এর সত্যতা পাওয়া গেলো কয়েক মাসের মধ্যেই। আওয়ামী লীগ (মিজান) গঠিত হওয়ার কারণ ও প্রেক্ষাপটের মধ্যে অন্যতম কথা ছিল- ‘আমরা যারা বাকশাল বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করি না তারা একত্রিত হয়ে নতুনভাবে আওয়ামী লীগ গঠন করেছি’। এতে ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যে ১৩ জন মিজান আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। তৎকালীন ৬৫টি সাংগঠনিক জেলা শাখার অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন, ময়মনসিংহ জেলা শাখারও কয়েকজন বাদে প্রায় পুরো কমিটিই আওয়ামী লীগ(মিজান)-এ যোগ দিয়েছিল। যারা যোগ দেন নাই তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানসহ মাত্র কয়েকজন। আবার অনেকেই নিজেদের নাম দেখে বিস্মিত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতিও দিয়েছিলেন। ময়মনসিংহের শীর্ষ নেতাদের পক্ষে পাল্টা বিবৃতির কোনো হদিশ পাওয়া না গেলেও তারা অল্পদিনের মধ্যেই সংবিৎ ফিরে পেয়েছিলেন এবং মূলধারায় যোগ দেন। যার ফলে ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ জেলায় মই মার্কা নিয়ে কাউকে নির্বাচন করতে দেখা যায় না। কিন্তু একবার সতীত্ব হারালে যা হয়, সেই উপমা নিয়েই তাঁদেরকে পথ চলতে হয়েছে। এটা গেলো বাকশালের বিরোধী রক্ষণশীলদের কথা। আবার ১৯৮৩ সালে আরেক চিত্র দেখা যায়। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ভাষায় ‘বামপন্থী মুখোশধারী’রা বাকশাল নামে গঠন করলেন, আওয়ামী লীগ ভেঙে। ১৯৭৮ সালে যারা অটল ছিলেন, ১৯৮৩ সালে তাঁদের মধ্যে থেকেই বাকশালে যোগ দিলেন অনেকে। দুটো পরস্পর বিরোধী গ্রুপ ও বলয়। তিরাশি সালের ধাক্কায় অবশিষ্টদের বিরাট অংশ সতীত্ব হারিয়েছিলেন। দুই ধারার মাঝখানে জাতীয়তাবাদী ধারায় সারাদেশে যারা অটল ও দৃঢ় ছিলেন তাঁদের অন্যতম প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। এরকম সংখ্যা ময়মনসিংহে খুব কম পাওয়া যাবে, সম্ভবত সারাদেশেই একই পরিস্থিতি। এরপরে আরও একটি সংকটের মুখে পড়েছিল আওয়ামী লীগ, ১৯৯২ সালে। আগের দুই পক্ষের কোথাও যারা যায়নি তাদের মধ্যে থেকেই কিছু সংখ্যক নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠন করেছিলেন। কিন্তু এখানেও প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের মতো অনেকেই যোগ দেননি। এখানেই প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানদের গুরুত্ব। ময়মনসিংহের আরেকজন প্রবীণ নেতাকেও পাওয়া যায়, যিনি ডানে-বামে কোথাও যান নি; তিনি অ্যাড. জহিরুল হক খোকা। হয়ত আরও ছিলেন, আমার অজ্ঞতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এই জাতীয়তাবাদী ধারাই আওয়ামী লীগের মূলধারা। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে জীবনের যবনিকা টানতে পেরেছেন খুব কম সংখ্যক বড় বড় নেতা। বরং তৃণমূলের জেলা-উপজেলা-গ্রাম পর্যায়ে এই সংখ্যা অনেক বেশি। প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান প্রমুখ তৃণমূলের বলিষ্ঠ প্রতিনিধি। একজন ভিশনারী নেতা কখনও এমন কূটচালে পা দেন না। যারা দিয়েছেন তারা হারিয়ে গেছেন বা যাবেন কিন্তু যারা দেন নাই তারা ঠিকই টিকে থাকবেন ইতিহাসের পাতায়।

পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ খুবই নবীন দেশ। তবুও এদেশের রাজনীতিতে ঘটেছে বহু নাটকীয় ঘটনা, যা রূপকথাকেও হার মানায়। বর্তমানের যে দেশ ও দলের স্থিতিশীল অবস্থা, এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে পঁচাত্তর থেকে ১৯৯২ সাল অব্দি সময়কে কল্পনা করাও কঠিন। খোদ ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. মোঃ নাজিমুদ্দিন সাহেব জামাতে ইসলামে যোগ দিলেন, ভাবা যায়? এরপরের কাদের সিদ্দিকী ও ১/১১-এর ঘটনা ধাক্কা। সবই কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যার দৃঢ় নেতৃত্ব ও প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানদের মতো অকুতোভয় সহযোদ্ধার জন্যই। নেত্রী সবসময় বলেন- তৃণমূল-ই আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। কারণ ফলিত রাজনীতি হোক আর তত্ত্বীয় রাজনীতি হোক, ব্যক্তি ম্যাটার করে। ফলে রাজনীতিতে নেতার প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য থাকা কর্মীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি দীক্ষা। ১/১১-এর সময়েও দল ও দেশের রাজনীতিকে রাজনীতিহীন করার চক্রান্ত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়- প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানদের মতো নেতার প্রতি অনুগত কর্মীদের কারণেই সেটা সম্ভব হয় নি। এতে নেতা হিসেবে আমাদের বাতিঘর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যেমন গৌরবান্বিত হয়েছেন, তেমনি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানরাও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন।

৮.
সংগ্রামী এই নেতার রাজনৈতিক জীবন ও মেরুকরণের একটি ছোট বিষয় শেয়ার করছি। তার রাজনৈতিক জীবনের যাত্রারম্ভ হয়েছিল শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাত ধরে। পঁচাত্তরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহে দুটি উপদলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যে উপদলটি পঁচাত্তরের পরে বাকশালের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আওয়ামী লীগ(মিজান) নামের দলের প্রতি আস্থাশীল হয়েছিল, সময়ের পরিক্রমায় মধ্যনব্বইয়ের দশক থেকে তাঁরাই প্রয়াত জাতীয় নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন। প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান হয়েছিলেন সম্পূর্ণ উল্টা বলয়ের কাণ্ডারি এবং তাঁর সারথী হয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে যারা বাকশাল নামক দলের প্রতি আস্থাশীল হয়েছিলেন তারা। আরও মজার ব্যাপার হলো-সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নির্বাচনী এলাকায় ঘটেছিল সম্পূর্ণ উল্টা ঘটনা। সেখানে ১৯৮৩ সালে গঠিত বাকশালের কর্মীরা তাঁর সারথী হয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগ(মিজান)-এর সাবেক কর্মীরা ছিলেন বিপরীত বলয়ে। সম্ভবত ১৯৯২ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণের পর থেকেই দলের ভেতরে সকলের চিন্তাই সমান হয়ে থাকবে।

প্রিন্সিপাল স্যারের জীবন ও রাজনীতির আরেকটা দিক সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা যাক। তিনি আজান দিয়ে নামাজ পড়ছেন, নামাজের ঈমামতি করছেন, তাবলিগ জামাতে যোগ দিচ্ছেন, মুর্দার গোসল করাচ্ছেন, জানাজার ঈমামতি করছেন, জীবনে কখনও দাঁড়ি শেভ করেননি। এরকম একজন ধার্মিক মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করে গেলেন; এটা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না, তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতি করেন নি। তিনি পরকালে যেমন বেহেশতে যাবার অভিপ্রায়ে ধর্ম চর্চা করেছেন, মানুষের ইহকালও যাতে স্বর্গীয় সুখের ছোঁয়া পায় সেজন্যও কাজ করে গেছেন। এসবের মধ্যে তিনি কোনো বিরোধ দেখেন নি। এক্ষেত্রে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের একটি কথা প্রাসঙ্গিক। ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ধর্ম চর্চা ও অসাম্প্রদায়িকতা, এই দুটিকে একসঙ্গে মিলিয়ে চলেন কিভাবে? উত্তরে বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেব বলেছিলেন- ‘খাঁটি ধর্ম চর্চা ও খাঁটি অসাম্প্রদায়িকতার মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই। বরং কোনো একটাতে ভেজাল হলেই সংঘর্ষ দেখা দেয়’। প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের ক্ষেত্রেও এ-কথাটি প্রযোজ্য মনে করি।

৯.
প্রতিটি মানুষের জীবনের দুটি দিক, প্রাইভেট/ব্যক্তিগত ও পাবলিক/সামষ্টিক। প্রথমত, প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের প্রাইভেট জীবনের যেটুকু বাইরে প্রসারিত সেটুকু সম্পর্কে বলা যায়- পেশায় কলেজের অধ্যক্ষ, সংগঠনে জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, পৌরসভার চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী। এসবই তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন বিবেচনায় সফলতা হিসেবে গণ্য হয়। দ্বিতীয়ত, পাবলিক লাইফ। যেসব দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন বা দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য যেসব কাজ করার জন্য তিনি সমর্পিত হয়েছিলেন এবং যেসব অঙ্গীকার নিয়ে তিনি দায়িত্ব পালনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন; সেসব কতটুকু করতে পেরেছেন, সঙ্গত কারণেই সবগুলো বিষয়ে আমার পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। কেবল দায়িত্বগুলো অর্জন এবং বিশেষ করে দলীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলতে পারি- তাঁর বিচরণ-ক্ষেত্রে দক্ষতার ফলে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সবার শেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন তাঁকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছে।

ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, হাশিমুদ্দিন আহমদ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান এমপি ও মন্ত্রী ছিলেন। রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, আনোয়ারুল কাদির, এম শামছুল হক, নাজমুদ্দিন আহমদ, আবদুল মতিন সরকার প্রমুখ এমপি হয়েছেন। আজিজুল হক, ওয়াজেদুল ইসলাম, জহিরুল হক খোকা প্রমুখ শুধু দলেরই দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমান নেতৃত্ব কিংবা অপরাপর জীবিতদের নিয়ে শেষ-কথা বলার সময় এখনও হয়নি।

বিদায় প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান স্যার। আপনার শেষ বিদায়ের বার্তায় বঙ্গবন্ধু কন্যা যেমন একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা হারানোর কথা বলেছেন। আমার মতো দলের সাধারণ কর্মীরাও দেশ, দল ও মানুষের বিশ্বস্ত একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে স্মরণ করবে, শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়। আপনার একাগ্রতা ও দৃঢ়তা তৃণমূলের কর্মীদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বিদ্রঃ লেখাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান হলেও প্রসঙ্গক্রমে অন্যান্য দিকেও ডালপালা ছড়িয়েছে। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যেতে হয়েছে। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র, জাতীয় থেকে তৃণমূলের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক রাজনীতির একটা চিত্রকল্প আঁকার চেষ্টা করেছি। নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে। লেখাটুকু আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদন হলেও স্মৃতিমূলক নয় বরং বিশ্লেষণমূলক। ঐতিহাসিক তথ্যের সত্যাসত্য প্রশ্নহীন হলেই কেবল আমার এই শ্রদ্ধা নিবেদনের আন্তরিকতা নিশ্চিত করবে, তাছাড়া অক্ষমতা হিসেবে স্বীকৃত হবে। রাজনীতিতে প্রকাশ্য তথ্যের বাইরে আড়ালের বিষয় থাকে অনেক বেশি। অনেক প্রত্যাশা করেছিলাম একখানা আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা লিখবেন, কিন্তু সেটা হয়েছে কিনা জানি না। তাই অন্তরালের অনেক বিষয় রয়ে গেছে আমার অধরা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View