
ইতিহাসের বঙ্গদেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)-এর সোনার বাংলা, কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর বাংলাদেশ আর জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)-এর রূপসী বাংলায়, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন জাতির জনক বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অগণিত জনমানুষ অবলোকন করেছেন ১৯৪০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত কীভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন ও উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে অকুতোভয় এক ক্ষণজন্মা মানব-সন্তান কারও রক্তচক্ষুর পরোয়া না করে উল্কার মত ছুটে বেরিয়েছেন অধিকারবঞ্চিত মানুষের স্বার্থে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে তিনি প্রায় ৮ বছর কারাভোগসহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দু’বার ফাঁসির আসামিও হয়েছিলেন। তিনি দিন-রাত মাঠে-ঘাটে রাজনীতির সাধারণ কর্মী থেকে ধাপে ধাপে রূপান্তরিত হন ‘মুজিব’ ১৯৪০ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’তে ১৯৭৩ সালে। তার ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ৩২ নাম্বার রোডের ৬৭৭-নং বাড়িটি বহুলাংশে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। তারই দুর্জয় সাহস সংগ্রাম নেতৃত্বে ৬-দফা থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিবিদ আইনজীবী মওদুদ আহমদ (১৯৪০-২০২১)-এর একটি গ্রন্থে উল্লেখ-“শত সমালোচনা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের সাহস এবং নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না। বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন দেশ এবং এদেশের মানুষ যে এখন একটি স্বাধীন জাতি এর জন্য ব্যক্তি হিসেবে মুজিবের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি। এসব কিছুর পেছনে একজন বীর বছরের পর বছর জেল খেটেছেন, ফাঁসির মঞ্চে উঠেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ে আপোস করেননি, তার কথা এদেশের মানুষ কি করে ভুলতে পারে?” (তথ্যসূত্র: চলমান ইতিহাস জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৮৩-১৯৯০, পৃষ্ঠা-১৮৯-১৯০)।
তিনি ‘মুজিব’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’তে রূপান্তরিত হতে সম্ভাব্য যত ধরণের মেধা ও মনন-ধীশক্তি-শ্রম ব্যয় করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি এবং ভিন্নমাত্রার মেধা-মনন-ধীশক্তি-শ্রম ব্যয় করেছেন ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পরের বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ-শোষণমুক্ত-বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ আলোকিত এক রাষ্ট্র-সমাজ বিনির্মাণে। যার জন্য তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র ১৩১৪ দিন।
আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে আপোষহীন, তা জনযুদ্ধের আগেই হোক বা জনযুদ্ধের পরেই হোক। প্রবীণ সাংবাদিক প্রবাসী কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩৪-২০২২)-এর একটি গ্রন্থে, ১৯৬৬ সালের ১৯ জানুয়ারি লাহোর গভর্নর হাউসে ইফতার শেষে চা খাওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আর ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া’র কথোপকথন উল্লেখ করেছেন; প্রেসিডেন্ট বলেন- “আচ্ছা মানিক মিয়া, আপনার বন্ধু কী চান? আমি ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দিয়ে তার কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সেন্ট্রাল মিনিস্টার হওয়ার জন্য। সবুরকে দিয়ে তার সঙ্গে নেগোসিয়েট করার চেষ্টা করেছি। বলেছি, তিনি চাইলে মোনেমকে আমি গভর্নর পদ থেকে সরাব। তারপরও তিনি লা’জবাব। আসলে আপনারা কী চান?

আমরা দু’জনেই বুঝলাম, তিনি শেখ মুজিবের কথা বলছেন। মানিক মিয়া বললেন, শেখ মুজিব জানেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রী হলে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কোন সমাধান হবে না। (তথ্যসূত্র: ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পৃষ্ঠা-১২২-১২৩)। দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্তসমৃদ্ধ সাহসি এক মানুষ ছিলেন তিনি। তার জীবনকাল যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত মাত্র ৫৫ বছর (১৯২০-১৯৭৫), এর মধ্যে রাজনৈতিক জীবন ৩৫ বছর।
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ ও শান্তি-ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ ১৯৭৩ সালে ২৩ মে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক এবং ‘বিশ্ববন্ধু’ উপাধি দেয়। ফলে বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’তে রূপান্তরিত হন। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশি স্থায়ী মিশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে তার ৪৪তম শাহাদত বার্ষিকীর এক সভায়, কূটনীতিকরা অত্যাচারিত মানুষদের স্বার্থে তার সংগ্রাম ও অবদানের জন্য ‘ফ্রেন্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ আখ্যায়িত করেন। এছাড়া- ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল বিবিসি’র এক শ্রোতা জরিপে বিশ্ববন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন।
তাছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদ (১৯৩৯-২০১৫)-এর একটি গ্রন্থে উল্লেখ- “তিনি হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোন নেতা ছিলেন না। দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তিনি রাজনৈতিক ময়দানে শুধু জাতীয়ভাবে নয়; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন” (তথ্যসূত্র: আমার রাজনীতির ৬০ বছর জোয়ার-ভাটার কথন, পৃষ্ঠা-২৪৩)। ইতিহাসে তিনি একটি শাশ্বত অধ্যায়, শত চেষ্টা করেও আর তার কীর্তি মুছে ফেলা যাবে না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার অবদান অপরিসীম ও তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনও কোনো ধরণের আপোস ব্যতীতই বাস্তবে রূপান্তরের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নয় বিশ্ব মানচিত্রে এক অনন্য ইতিহাস আর নিপীড়িত-নির্যাতিত অধিকারহীন গণমানুষের মুক্তির কন্ঠস্বর। তিনি গড়তে চেয়েছিলেন সুস্থ-সবল-জ্ঞানসমৃদ্ধ-ভেদ-বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ আলোকিত মানুষের জন্য জনকল্যাণমূখী উন্নত এক বাংলাদেশ। প্রবীণ সাংবাদিক কলাম লেখক এবিএম মূসা (১৯৩১-২০১৪) তার একটি গ্রন্থে শেখ মুজিব সম্পর্কে লিখেন- “এ দেশে অনেক মহান নেতার জন্ম হয়েছে, রাজনীতির অঙ্গনে অনেকে কুশলী পদচারণ করেছেন, বিদ্যা-বুদ্ধি-মেধায় রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় তার চেয়ে অনেক বেশি উপযুক্ত কেউ কেউ ছিলেন বৈকি; কিন্তু তার মতো কি কেউ জনগণকে ভালোবাসার কথা বলতে পারতেন?” (তথ্যসূত্র: মুজিব ভাই, পৃষ্ঠা-৮১)।
অপ্রিয় হলেও সত্য-৪৮ বছর আগে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তিসমূহ বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহসাগরসহ এশিয়ায় নিরবিচ্ছিন্ন আধিপত্য বজায় রাখতে এবং একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আর বাংলাদেশ বিনির্মাণের বাস্তবসম্মত স্বপ্নসহ জাতীয় শক্তিকে পরিকল্পিতভাবে বিনষ্টের লক্ষ্যে যুদ্ধ জয়ের মাত্র ১৩৩২ দিন পর বিশ্ববন্ধুকে হত্যা করায়। এ হত্যা শুধুমাত্র তার মতো ইতিহাসে একজন বিরলপ্রজ ব্যক্তিকে হত্যা নয়- এ হত্যা একটি স্বাধীন জাতির সুস্থ-সবল-চেতনাসমৃদ্ধ-বিজ্ঞানমনস্ক ভেদ-বৈষম্যহীন আলোকিত মুক্ত জাতিতে রূপান্তরের স্বপ্নের হত্যা। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হলে বেরিয়ে আসবে দেশি-বিদেশি কায়েমী স্বার্থবাদীরা কীভাবে রাজনৈতিক কতিপয় নেতা ও শ্রেণিপেশার ব্যক্তিদের দিয়ে জনযুদ্ধের সময় থেকেই ষড়যন্ত্র করিয়ে হিমালয়তুল্য মুজিবকে অজনপ্রিয় করে হত্যার দায় অন্যের ওপর চাপিয়েছে। একটি দেশ জনককে নজরদারিতে রাখতে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠায়, কিন্তু পরে মুজিবের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় তাকে জীবন দিতে হয় আর পরিবারের দাবির পরেও দেহের ময়নাতদন্ত হয়নি। কাদের বাধায় ১৯৭২ সালে জাতীয় স্বার্থে একটি দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। কারা কীভাবে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করায়; দেশি-বিদেশিরা কীভাবে জনককে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। হুলিয়াপ্রাপ্তরা সরকারবিরোধী কাজে বিদেশে যেতে কাদের সহায়তায় ভিন্ন নামে পাসপোর্টসহ বিমানের টিকেট ও ৫টি দেশে থাকা-খাওয়ার অর্থ এবং আশ্রয় পায়; কারা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে বিদেশ যায়; কারা ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববন্ধুর আগমন ঠেকাতে নিখিল বোমা ফাটায় আর হত্যার পর লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলার কথা বলে; মুজিব হত্যার আগে ও পরে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কার কি ভূমিকা ছিল; খুনিচক্রের কারা আত্মীয়তার শক্তিতে বলিয়ান; কারা খুনিচক্রকে (ক’জনের পরিবারসহ) ব্যাংককে যাওয়ার বিমান চ্যাটার্ড ও ভাড়া পরিশোধসহ লিবিয়ায় থাকা এবং বিভিন্ন দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা আর অর্থসহ অন্যান্য সহায়তা করেন; অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কতগুলো বীভৎস মুখসহ দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতার অনেক অজানা ঘটনা এবং নাম সামনে আসবে যারা ষড়যন্ত্র আর হত্যার সাথে জড়িত; কারা বিশ্ববন্ধু হত্যার পর মূল ঘাতকদের স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্র বানাতে তৎপর হয়।
অথচ- রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দসহ জনমানুষ আজও বিশ্ববন্ধু হত্যার কার্যকারণ বুঝে উঠতে পারেনি। তাই- নেতৃবৃন্দসহ জনমানুষ কী কখনও জানতে পারবে না মৃত্যুঞ্জয়ী জাতির জনক বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রকৃত কারণ? দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই একটি গ্রহণযোগ্য নাগরিক কমিশন গঠন করে ২০২৫ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্ববন্ধু হত্যার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে, মূল চক্রান্তের সাথে জড়িত দেশি-বিদেশি চক্রের মুখোশ জনসম্মুখে প্রকাশ করাই সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ- জনক হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দেশের অধ:পতন আজও রোধ করা যায়নি। যার ফলে ফাঁদে পড়েছে স্বাধীনতা, ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ; রাজনৈতিক অঙ্গনে হিংসা-বিদ্বেষ; দেশে-বিদেশে প্রপাগান্ডা; মঞ্চে নিন্দা-গীবত; জনমানুষের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা; আজও সবার জন্য গুণমানসম্মত অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয়-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ বিশ্রাম-বিনোদন-অবকাশ-সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়; দেশের খাস জমি-জলা-জঙ্গলের মালিক গুটিকয়েক ব্যক্তি; শত-কোটিপতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া বহাল; অর্থপূজার সম্মান সর্বোচ্চ; সব মিলয়ে দুই সমাজ দুই অর্থনীতি; জনগণের ব্যাপকাংশ প্রজাতন্ত্রের মালিক না হয়ে হয়েছেন ‘প্রজা’ আর জনগণের সেবক শাসক-প্রশাসকেরা হয়েছে ‘রাজা’। কিন্তু- সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের ২-এ উল্লেখ, “সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।” এখন জনগণের মাথাপিছু ঋণ ১ লাখ ৫ হাজার ২৫২ টাকা। আগামী এক বছরে আরও ১৫ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়বে। ফলে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ২০ হাজার ৪৩৯ টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’র সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপান স্টাডিস্-এর ফাউন্ডার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত (১৯৫৪)-এর একটি গ্রন্থে উল্লেখ-“গত তিন দশকে প্রবাহিত বৈদেশিক ঋণ-সাহায্যের মাত্র ২৫ ভাগ পৌঁছেছে তাদের কাছে যাদের উদ্দেশ্যে ঐ সাহায্য এসেছে, আর ৭৫ ভাগ বিভিন্নভাবে লুটপাট হয়েছে (২৫% বিদেশিরা, ৩০% দেশের আমলা, রাজনীতিবিদ, কমিশন এজেন্ট, পরামর্শক, ঠিকাদাররা ও ২০% শহর ও গ্রামের উচ্চবিত্তরা)। বৈদেশিক ঋণ-সাহায্যের লুটপাট প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে অর্থনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করেছে, এবং অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন স্থায়ীকরণে রাজনীতিকেও দুর্বৃত্তায়িত হতে হয়েছে” (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২৩: একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট, পৃষ্ঠা-৩২)।
এছাড়াও মওদুদ আহমদের পূর্বোক্ত গ্রন্থের ১২৪-নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ, “শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু রাখার চেষ্টা করেছিলেন বটে, প্রকৃতপক্ষে সকল বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে ঐ হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই দেশের রাজনীতি জনগণের হাত থেকে সরে ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশ এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করে, যার সঙ্গে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশে যত আন্দোলন হয়েছে সেসবের কোন মিল ছিল না, বরং যে প্রক্রিয়া এবং শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে এতদিন সংগ্রাম করা হয়েছে, অগণিত মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে, এই যাত্রা হলো ঠিক তার বিপরীত দিকে। ক্ষমতানির্ভর রাজনীতির যেই শাসনযন্ত্র থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করে দেশ ভেঙ্গে স্বাধীনতা আনতে হয়েছিল, বাংলাদেশ সেই শাসনযন্ত্রেই আবার ফিরে গেল।” তাই- জনক হত্যার রহস্য উন্মোচনে কমিশন গঠনে সরকার ব্যর্থ হলে, সময় যতই লাগুক না কেন আমরা ইতিহাসের বৃহত্তর স্বার্থে নিজ উদ্যোগে আত্মদায়বদ্ধ সামাজিক সংগঠন ‘প্রজন্মের চেতনা’র পক্ষ থেকে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করবো। ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য মোঃ ছালেক-উর-রহমান (সুমন)-এর লিখিত স্লোগান- “ইতিহাসের চাকা ঘোরাবো, সে তো ঘুরবেই, কাঁটবে আঁধার, প্রকৃত ইতিহাস আলোতে আসবেই।”
নিখাদ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ বিশ্ববন্ধু শুধু বাংলাদেশেরই নয় বিশ্বের নিপিড়িত-নির্যাতিত জনমানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দেলন সংগ্রামের প্রশ্নে ছিলেন অনড়-অটল-অবিচল বিশ্বস্ত। দেশি-বিদেশি কোনো শক্তিই তাকে কখনও এ প্রশ্নে নিম্নতম মাত্রায় কক্ষচ্যুত করতে পারেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে তার মত ক্ষমা আর উদার মানসিকতা সম্পন্ন শক্তিমান নেতা খুব কমই আছেন। যেমন- কাজী জাফর আহমদের পূর্বোক্ত গ্রন্থের ২৫৫-নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ- “শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অনেক সমালোচনা আমাদের আছে। কিন্তু এ কথা সত্য, মাথা থেকে পা পর্যন্ত তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি একটা দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন। সেজন্য সকল রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তার একটা দুর্বলতা ছিল। যখনই তিনি দেখেছেন আমার জীবন হুমকির মুখে তখনই তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য যা করা প্রয়োজন তা করেছেন।রাজনৈতিক কর্মীর প্রতি তার যে ভালোবাসা, স্নেহ মমতা ছিল সে কারণেই তিনি আমাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন। এটা তার হৃদয়ের একটা ঔদার্য, বিশালতা এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।”
গজ-ফিতা দিয়ে হিমালয়-সাদৃশ্য বিশ্ববন্ধুর শারীরিক উচ্চতা মাপা গেলেও তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা অথবা হৃদয়ের বিশাল ব্যাপ্তি কোনো মানদণ্ড দিয়ে মাপা অথবা দাঁড়ি পাল্লায় ওজন করা সম্ভব হবে না। আজ তার কাছে শুধু বাংলাদেশের জনমানুষেরই নয়, আজন্ম ঋণ বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত গণমানুষের। এখন অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে গণমানুষের আত্মবিশ্বাসে ‘বিশবন্ধু’ দেশ-দেশান্তরে আর যুগান্তরে আজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। একই সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী চিহ্নিত হয়ে থাকবে বিশ্বের ইতিহাসে তার রাজনৈতিক জীবনের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অদ্বিতীয় কালজয়ী শ্রেষ্ঠ ভাষণটি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)