একবছর পর প্যারিসে বসতে চলেছে অলিম্পিক গেমসের ৩৩তম আসর। এবারের আসর দিয়ে আবারও ফ্রান্সের সেইন নদীতে ফিরছে সাঁতার ও ডাইভ ইভেন্ট। দূষিত পানির কারণে দীর্ঘ ১০০ বছর নদীটিতে সাঁতার নিষিদ্ধ ছিল।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শিল্প কারখানার পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্যানিটেশনের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে পশ্চিমা দেশের অনেক শহরের মতো প্যারিস তার নদীর গুণগত মান হারিয়েছিল। সেইন নদীর একই পরিণতি হলেও এটিকে সাঁতার উপযোগী করতে ১.৪ বিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে নেয়া হয় প্রকল্প, যা সফলতার মুখ দেখতে চলেছে।
মেগা প্রকল্পটি আগামী বছর গেমস চলাকালীন সময়ে চালু হবে। নদীটিকে শুধুমাত্র ইভেন্টের স্থান হিসেবে নয়, বরং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ফোরাম হিসেবেও প্রদর্শন করা হবে। এখানে ১৬০টি নৌকার একটি বহর ১০ হাজার ক্রীড়াবিদকে নিয়ে ৬ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে আইফেল টাওয়ার পর্যন্ত যাবে।
১৯৬০’র দশকে নদীটির দূষণ তীব্র আকার ধারণ করায় সেখানে মাত্র তিন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব টিকেছিল। এরআগে কর্তৃপক্ষ ১৯২৩ সালে সাঁতার নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিবছর ক্রিসমাস ক্রস-রিভার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এর আগে ১৯০০ সালে প্যারিসে প্রথমবার হওয়া অলিম্পিক গেমসে সেইন নদীতে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা ছিল। পাশাপাশি তখন দেখা যেতো কামান-ফায়ারিং এবং হট-এয়ার বেলুনিংয়ের মতো অদ্ভুত সব খেলা। এখন সেসব খেলার প্রচলন আর নেই।
নদী দূষণের মূল কারণ ছিল ঊনবিংশ শতকের একক পদ্ধতির নিষ্কাশন অবকাঠামো। এর ফলে রান্নাঘর এবং বাথরুমের ব্যবহৃত পানি টয়লেটের নর্দমাগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। স্বাভাবিক সময়ে এটি উপকণ্ঠে চিকিৎসা কেন্দ্রের দিকে রাস্তার নিচের টানেলের একটি কমপ্লেক্সের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে প্রবল বৃষ্টির সময় পদ্ধতিটি কাজ না করার ফলে অতিরিক্ত জমে যাওয়া পানি সেইন নদীতে ফেলে দিতে হয়।
গত ২০ বছরে পরিস্থিতির উন্নতির ফলে ইতিমধ্যেই নদীতে মল ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের তীব্রতা হ্রাস পেয়েছে। একটি সুবিশাল ভূগর্ভস্থ জলাধার ভবন তৈরি করা হয়েছে, যা ভারি বৃষ্টির সময়ে জলাবদ্ধতা সংরক্ষণ করতে কাজ করবে। এটি অস্টারলিটজ স্টেশন থেকে দেখা যায়। জলাধার ভবনটি পিতেই-সালপেতরিয়েরে হাসপাতালের সামনেই, যেখানে ১৯৯৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনার পর প্রিন্সেস ডায়ানা মারা গিয়েছিলেন।
প্যারিস সিটি হলের স্যানিটেশনের প্রধান প্রকৌশলী স্যামুয়েল কলিন-কানিভেজ বলেছেন, ‘নদীটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে তা বলা যেতে পারে। সেইনে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য সুরক্ষা ভালভ হয়েছে। যদি আমরা মাঝে মাঝে নদীতে বর্জ্যের পানি না ফেলতাম, তাহলে এটি মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়তো। এখন একটি টানেল জলাধারে প্রবাহ নিয়ে আসবে, যেখানে পানি এক বা দুইদিনের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে।’
জলাধারের সাথে কিছু বর্জ্য জল নদীতে পড়ার সম্ভাবনা অবশ্য কানিভেজ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে ভবিষ্যতে এমনটি হলেও তা হবে বিরল ঘটনা। এক্ষেত্রে সাময়িক সময়ের জন্য সেইনকে গোসল করার অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।
প্যারিস ফিশিং ফেডারেশনের বিল ফ্রাঙ্কোইস বলেছেন, ‘নদীর তলদেশে সঠিক ধরনের আগাছার একটি আবরণ তৈরি হচ্ছে। পানি যত পরিষ্কার হবে, আগাছা ততো বেশি বৃদ্ধি পাবে। তারপর আগাছা পানিকে আরও পরিষ্কার করার জন্য ফিল্টার করবে।’
‘১৯০০ সালে নদীতে প্রতিযোগিতায় যে মাছ ধরা হয়েছিল তা পরিমাপে আপনার হাতের আকারের চেয়ে বড় ছিল না। আজ আমাদের শহরের কেন্দ্রে ৩০-৩৫ প্রজাতির মাছ আছে। আমরা দুই মিটার লম্বা ক্যাটফিশ পাই।’
প্যারিসে ইঁদুর বহু বছরের এক সমস্যার নাম। বিষয়টি এতটাই চিন্তার কারণ যে সেইন নদীতে গোসল করতে এটি সবাইকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।
বিল ফ্রাঙ্কোইস ইঁদুরের প্রস্রাববাহিত রোগ লেপ্টোস্পাইরোসিস নিয়ে সবাইকে দিলেন সতর্ক বার্তা। বললেন, ‘আমরা যারা ছিপ দিয়ে মাছ ধরি তারা লেপ্টোস্পাইরোসিসের বিপদ সম্পর্কে জানি। আমাদের ভেতর কেউ কেউ বার্ষিক টিকাও নিয়ে থাকেন। প্যারিসে ইঁদুরের অভাব নেই।’
তবে প্যারিস সিটি হলের পানির মান পর্যবেক্ষকদের প্রধান পল কেনুচে বলেছেন, গবেষণায় দেখা গেছে লেপ্টোস্পাইরোসিস ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি নয়।
‘আমাদের লা ভিলেটের খালে (যেখানে ইতিমধ্যেই সাঁতারের অনুমতি রয়েছে) লেপ্টোস্পাইরোসিসের একটিও কেস নেই। কোনো বড় উদ্বেগের কারণ না থাকলেও আমরা অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করব এবং ইঁদুর অপসারণের জন্য ব্যবস্থা নেবো।’
অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্বে থাকা প্যারিসের ডেপুটি মেয়র পিয়েরে রাবাদান ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘মানুষ যখন ক্রীড়াবিদদের কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছাড়াই সেইনে সাঁতার কাটতে দেখবেন, তখন তারা সেইনে ফিরে যেতে শুরু করার জন্য আত্মবিশ্বাসী হবেন।’