চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সন্তানের জীবনে বাবা মায়ের বিচ্ছেদের প্রভাব যেন না পড়ে

‘বিচ্ছেদ’-শব্দটি যেন কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভীষণ রকমের বেদনাময়। যা জীবনের অনেক কিছু এলোমেলো করে দেয় এক নিমিষেই। বিশেষ করে পারিবারিক সম্পর্কে বাবা মায়ের বিচ্ছেদের প্রভাব পড়ে সন্তানদের উপর। বিচ্ছেদের আগে এবং পরে সন্তান যে মানসিক যন্ত্রণাতে থাকে তা হয়ত তোয়াক্কাই করে না মা বাবা নিজেদের ইগোর কারণে।

বিচ্ছেদের আগে তারা নিজেদের পারস্পরিক দোষগুলো নিয়ে করে লড়াই। যা দেখে বাচ্চারা হয় আতংকগ্রস্থ।আবার বিচ্ছেদের পর দুজনেই সন্তানদের মনে করে তাদের নিজের সম্পদ। আর তাই যে যার নিজের মত করে কাছে রাখতে চায় সন্তানকে তার কাছে । আইন আর আবেগের এ লড়াইয়ে সন্তানরা বুঝতে পারে না কে ভালো কে মন্দ। এ অবস্থায় তারা বাবা মায়ের থেকে দূরে সরে নিজেদের মতো করে একটা মনোজগত তৈরি করে নেয়। যার পরিনতির ছাপ পড়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনে।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যখন বিচ্ছেদ আসে তখন সন্তানদের বিষয়ে দুজনকে সচেতন হবে। মনে রাখতে হবে তাদের সম্পর্কের তিক্ততাতে সন্তান পরিবার সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে । তাই এ সময় সন্তানের মনোবল দৃঢ় রাখার বিষয়ে ভারতের বিশিষ্ট মনোবিদ ডাঃ কেদাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বাবা মাকে কিছু বিশেষ পরামর্শ দেন

১. স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে যখন ডিভোর্স ছাড়া আর কোন পথ নেই অবস্থার সৃষ্টি হলে সন্তানের সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে হবে দুজনকে। কোন পরিস্থিতির চাপে পড়ে তারা আলাদা থাকতে হচ্ছে তা বলতে হবে। কিন্তু তাই বলে সন্তান তাদের কাছে হেলাফেলার বিষয় নয়৷ আর বিচ্ছেদের জন্য সন্তান দায়ী নয় এটা জানাতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় মা বাবা সন্তানের সামনেই নিজেদের ঝগড়াতে সন্তানকে ইস্যু করে। যার নেতিবাচক প্রভাবে সন্তান অপরাধ প্রবনতাতে ভুগে।

২ একই ভাবে দুজনকেই আশ্বস্ত করতে হবে সন্তান যার কাছেই থাকুক, থাকবে আদরে-যত্নে৷ কোনও ক্ষতি বা অসুবিধা তারা হতে দেবেন না৷ সন্তান চাইলে আলাদা করে মা-বাবার কাছেও থাকতে পারে৷ যদিও এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটে৷ একসঙ্গে বসতে না চাইলে আলাদাভাবে সন্তানের সঙ্গে কথা বলে নিবে মা বাবা৷ কিন্ত্ত দু’জনের বক্তব্য যেন এক থাকে তা লক্ষ্য রাখতে হবে।

৩. বিচ্ছেদের কারণে পরিবারের সবার সংগে এক সাথে থাকার নিয়মের ব্যতয় ঘটে সন্তানের । বাবা বা মা কে ছেড়ে একা হয়ে যাওয়ার কারনে বাচ্চাদের কিছু মানসিক সংকট দেখা দিতে পারে। কনডাক্ট ডিজ-অর্ডার, হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজ-অর্ডার, বিহেভিয়ারাল প্রবলেম (যেমন, ট্রুয়েন্সি, স্কুল রিফিউজাল, অপজিশনাল ডিফিয়েন্ট ডিজ-অর্ডার ইত্যাদি ), ইমপালস কন্ট্রোল ডিজ-অর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ-অর্ডারের মতো মনোবিকার৷ কনডাক্ট ডিজ-অর্ডারে শিশুর মধ্যে অপরাধমূলক কাজের প্রতি আগ্রহ দেখা দেয়৷ ১৮ বছরের পরেও এই স্বভাব থেকে গেলে সম্তান হয়ে ওঠে সমাজবিরোধী৷ হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিজ-অর্ডারে শিশু অতিরিক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে৷ আবার হয়তো একবারেই চুপ করে যায়৷ বিহেভিয়েরাল প্রবলেমে দেখা যায় শিশু বাড়ি থেকে পালাচ্ছে, স্কুলে যেতে চাইছে না, বড়রা যা বলছেন তার ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে৷ বন্ধুদের বুদ্ধি-ই তখন বেশি গ্রহণযোগ্য৷ ইমপালস কন্ট্রোল ডিজ-অর্ডারে অকারণেই বাচ্চা রেগে ওঠে৷ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ-অর্ডারে ক্ষুদেরাও শুচিবাইগ্রস্ত হয়ে ওঠে বড়দের মতো৷

এক্ষেত্রে হাল ধরতে হবে মাকে৷ ঠান্ডা মাথায়, সহানুভূতির সঙ্গে বোঝাতে হবে, কোনটা করা উচিত৷ কোনটা নয়৷ মা কর্মরত হলে, কাজের ফাঁকে সঙ্গ দিতে হবে৷ সন্তানকে বুঝতে হবে৷ বোঝাতে হবে, ‘বিচ্ছেদ’কে মেনে নিয়েও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা যায়৷ ভুলেও প্রতিপক্ষের নামে কোনও অপমানসূচক কথা বলা চলবে না৷ কেউ বললে তার কাছ থেকে বাচ্চাকে সরিয়ে আনতে হবে৷ পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাচ্চাকে বোঝাতে সাহায্য করবেন৷ নিতান্তই অপারগ হলে দ্বারস্থ হতে হবে মনোবিদের৷

৪.বিচ্ছেদের কারনকে নিজেদের দূর্বলতা মনে করে সন্তানকে অতিরিক্ত আদর, তার বায়না আবদার মেটাতে চেষ্টা করা ভুল। তাই স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করতে হলে –
অতিরিক্ত প্রশ্রয়, আদর, শাসন কোনওটাই করবেন না৷ স্বাভাবিক আচরণ করুন৷ ঘরোয়া কাজে সন্তানকে জড়িয়ে নিন৷ ছোট ছোট দায়িত্ব পালন করতে দিন তাকে আবার নতুন ভাবে সংসার করতে চাইলে সন্তানকে আগে থেকে নতুন মানুষটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে রাখুন৷ কারণ একটু বড় বাচ্চা চট করে নতুন কাউকে মানতে পারে না৷ দু’জনকে একান্তে মেলামেশার সুযোগ করে দিন৷ এতে বন্ডিং তৈরি হবে৷ আচমকা ‘নতুন বাবা, মা’য়ের মুখোমুখি দাঁড় করালে সন্তান বিব্রতবোধ করতে পারে৷

অনেকসময় সন্তান বড় হয়ে এই দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করতে পারে৷ একে বলে ম্যানুপুলেটিক বিহেভিয়ার্স৷ এ বিষয় থেকে রেহাই পেতে হলে বিচ্ছেদের শুরু থেকে সন্তানকে নিজের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে।

সর্বোপরি সাবালক হলে সন্তান অন্যপক্ষের কাছে ফিরে যেতে পারে এ বাস্তবতার সংগে আপনাকেও মানিয়ে নিতে হবে।

সন্তানের জন্মে বাবা মায়ের নিজেদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। ঠিক একইভাবে বাবা মায়ের প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব সন্তানদের সুষ্ঠু সুন্দর জীবন গড়া। তাদের ভুলে গেলে চলবে না বিচ্ছেদ নামের শব্দটি দিয়ে সবার আগে বিপর্যস্ত হয় তাদেরই সন্তানদের জীবন । তাই আইনগত ও সামাজিক অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সন্তানদের স্বচ্ছ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে বাবা মাকে।কারন তাদের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদের দায় সন্তানদের নয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)