২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে। উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন নিয়ে চলছে বিস্তর পরিকল্পনা ও কর্মসূচি। সারাদেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে উদ্বোধন পর্বের প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানটি করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ক্ষমতাসীন সরকার। ৮ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলনে তিনি উদ্বোধন পর্বের বিভিন্ন বিষয় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। একই সাথে তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অর্থায়ন থেকে সরে গিয়ে বিশ্বব্যাংক বঙ্গবন্ধু পরিবারকে যে অপমান করেছিল, পদ্মা সেতু সে অপমানের প্রতিশোধ। তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক আমাদেরকে দুর্নীতি, চুরির অপবাদ দিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল। এই সেতু আমাদের অপমানের প্রতিশোধ।’
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর সেতু নির্মাণ নিয়ে তৈরি হয়েছিল নানা সংশয়। কিন্তু শুরুতেই সেই সংশয় কাটিয়ে উঠতে যে মানুষটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবচেয়ে বেশি অভয় দিয়েছিলেন, তিনি তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। সেসময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করেছিলেন এই বলে যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে যত ডলার লাগবে তার পুরোটাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেওয়া সম্ভব হবে। ড. আতিউর রহমান সেসময় বিষয়টি নিয়ে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলামের সঙ্গেও বৈঠক করেছিলেন। তিনি সেসময় এও বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর জন্যে কোন মাসে কত ডলার লাগবে, সে তথ্য ইতিমধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অগ্রণী ব্যাংক যখন যে পরিমাণ চাহিদা জানাবে, তখনই ওই পরিমাণ ডলার যোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ। রিজার্ভ থেকে সেতুর অর্থায়ন হবে খুবই কম। তবে বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিতে সমর্থন দেবে। আজ যদি বলে যে ১০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে, সেটাও দিতে পারবে’ (সূত্র: কালের কণ্ঠ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। এ বিষয়টি নিয়ে সেসময় প্রখ্যাত কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাই যথার্থই বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের অনিভিপ্রেত আচারণের পর একজন গভর্নর যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে সাহস ভুগিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে দেশের মঙ্গলাকাঙ্খায় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন তা বিরল। বড় কথা হলো তৎকালীন গভর্নরের দেশপ্রেমিক ভাবনাটাকেই তিনি বড্ড প্রশংসায় সিক্ত করেছিলেন (সূত্র; সমকাল ১৯ মার্চে ২০১৬)।
২০১২ সালের কথা। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংক নিজেদেকে গুটিয়ে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর যে প্রশ্নটি সামনে আসে সেটি হলো- পদ্মা সেতু আর হবে কিনা। এ নিয়ে নানান কথার খই ফুটতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হুমকিতে বিরোধীরা যার পর নেই উল্লাসে ফেটে পড়েন। টেলিভিশনের টকশোতে অবিশেষজ্ঞরা বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে থাকেন। এদিকে একইসাথে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের অতিকথন, বিবেচনাহীন মন্তব্য সরকারকে খানিকটা বেকায়দাতেও ফেলে দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা স্থাপন করে গোটা জাতিকে এই মর্মে আশস্ত করেন যে, ‘নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। পদ্মা সেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ হবে না।’ বারবার তিনি এই একই কথা বলতে থাকেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীকে নিজের সক্ষমতা দেখিয়ে সাহস যুগিয়ে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
রিজার্ভ হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর নিজের দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতাকে মর্যাদাময় করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেন। সেদিন যে যাই বলুক প্রধানমন্ত্রী খুশি হতে পারেননি। হয়ত কোনো ব্যক্তি বিশেষের অনর্থক চাপ বা আবদারের কারণেই তিনি সেদিন তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মন যে তার সাঁয় দেয়নি তা বলাই বাহুলা। তাই পদত্যাগী গভর্নরকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী এ বিবৃতি দিয়ে তার সাহস ও মার্যাদাবোধের প্রশংসা করেছিলেন। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য অর্জনে তার অবদানের কথা সেদিন তিনি বলেছিলেন। এর দুদিন পরেই আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বলেছিলেন, ‘আমি পদ্মাব্রীজের সময় অর্থমন্ত্রীর কাছে টাকা চেয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন আমি কোথা থেকে টাকা দেব? সেই টাকার ব্যবস্থা আতিউরই করে দিয়েছিল।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। যারা প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক গভর্নরের পেশাভিত্তিক সম্পর্কের গভীরতা জানেন তারা এই পদ্মসেতু অর্থায়নের প্রেক্ষাপট ঠিকই ধরতে পারবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তিগত একটি দুর্ঘটনার সুযোগ নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষীমহল এই দুই দেশপ্রেমিকের দেশ গড়ার গভীর বোঝাপড়া সাময়িকভাবে হলেও আটকে দিতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এই অনাহুত পর্বটি গভীর বেদনার ও আত্মঘাতি এক ট্রাজিক অনুষঙ্গ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে।
একথা সত্য যে ২০১২ সালে মানুষের প্রতি ভালোবাসার জায়গায় দাঁড়িয়েই তৎসময়ের মরমী গভর্নর ড. আতিউর রহমানই সবার আগে দেশের অর্থের সক্ষমতার বিষয়টি প্রকাশ করেছিলেন। খেয়াল করুন, গত কয়েক বছরে সাবেক গভর্নর এ বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। কেননা তিনি তার সকল কৃতিত্বের জন্যে বরাবরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন। বিশ্বমানের প্রতিটি পুরস্কার তিনি তাকেই উৎসর্গ করেছেন। পদ্মা সেতু অর্থায়নের প্রশ্নে এমন সাহসী সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিতে পেরেছিলেন বিপুল অঙ্কের যে রিজার্ভ সাবেক গভর্নরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক গড়ে তুলেছিলেন তার জোরে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে অচিরেই গাড়ি চলবে। নতুন এক প্রাণস্পন্দনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে চারিদিকে। এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কৃষি অর্থনীতিতে আসবে নতুন এক প্রাণ। নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এ বিষয়ে খানিকটা জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের কাছে। প্রশ্ন রেখেছিলাম এই বলে যে, পদ্মা সেতুর প্রভাবে বাংলাদেশের, বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতির ওপর কি ধরনের প্রভাব পড়বে। তিনি বললেন, ‘পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিতে পড়বে ব্যাপক প্রভাব। এ অঞ্চলের একুশটি জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এই সেতু চালু হবার পর সড়ক ও রেল দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় আর বসে থাকবে না। সময়ের অপচয় হবে না। আর ঝড়-বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই এই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে।’
তিনি আরও বলেন,‘ দক্ষিণ বাংলার প্রতিটি গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এই অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা রাজধানী থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারবেন তাদেও গ্রামের ও আশপাশের এসএমই উদ্যোগগুলোর জন্য। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু হবে শুনেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নত হতে শুরু করেছে। বরিশাল শহরের আশে পাশের জমির দাম দ্বিগুন হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর দুই পারেই এক্সপ্রেসওয়ের পাশের জমির দাম তিন-চার গুণ বেড়ে গেছে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, আবাসন প্রকল্প, রিসোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, মানব সম্পদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট ও নানা ধরনের এসএমই উদ্যোগ স্থাপনের হিড়িক পরে গেছে। খুলনা ও বরিশালে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুত গতিতে। আগামীতে বিকাশের এই ধারা আরও বেগবান হবে।’
পদ্মা সেতু শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কতোটা প্রভাব রাখবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঢাকার কাছে বলে পদ্মার ওপারে ছোট-বড় নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। দক্ষিণ বাংলা হবে পর্যটনের এক উৎকৃষ্ট হাব। ছুটি পেলেই ঢাকা ও অন্যান্য নগরের বাসিন্দারা ছুটবেন দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের সন্ধানে। তারা যাবেন কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি পরিদর্শনে, যাবেন পায়রা বন্দরে। পদ্মার চরগুলোতে গড়ে উঠবে নতুন নতুন রিসোর্ট ও পরিকল্পিত ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। সরকারও এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে পদ্মা পারের পুরো এলাকাকে উন্নত করার লক্ষ্যে। শোনা যাচ্ছে, পদ্মার চরাঞ্চলে অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, হাইটেক পার্ক, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, বিমান বন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ভাবছে সরকার। এ ছাড়া এপিআই পার্ক (অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট) আগেই গড়ে তোলা হয়েছে। পদ্মা সেতুর কাছেই দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী গড়ে উঠছে। এখানে থাকবে আধুনিক আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব সুযোগ-সুবিধা। পদ্মা সেতুর আশপাশে গার্মেন্টস ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটবে। খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে শিপ-বিল্ডিং শিল্পের বিকাশ ঘটবে। মোংলা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মোংলা ইপিজেড, পায়রা বন্দর, রূপপুর প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা গেলে এসব প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্থান ঘটবে। একটি গবেষণায় বলা হচ্ছে যে পদ্মা সেতু চালু হবার পর বছরে প্রায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১.০৪ শতাংশের কর্মসংস্থান হবে। আরও সহজ করে বলা যায় আগামি পাঁচ বছরে দশ লাখ অর্থাৎ বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। দশ বছর পর এই সংখ্যা তি গুণ হয়ে যাবে।’
সবশেষে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু আমাদের সার্বিক উন্নয়নের পথনকশায় এক নতুন আশা-সঞ্চারি মাইলফলক। এক নতুন সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এক নতুন অনুপ্রেরণা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী দেশটি প্রমাণ করেছে- কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)