আদালতে শুনানির আগেই বিচারকের কাছে চেয়ে নিলেন ব্যক্তিগত সময়। নিজেই আবেদন করলেন জামিনের। চাইলেন মৃত্যুও। তিনি ভারতের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিমান সংস্থার কর্ণধার নরেশ গয়াল।
আদালতে প্রাঙ্গণে তিনি বললেন, সমস্ত আশা হারিয়েছেন তিনি। এর চেয়ে জেলে মৃত্যু হওয়াই শ্রেয়। আদালতে করজোড়ে বিচারককে এমনই জানালেন জেট এয়ারওয়েজ়ের প্রতিষ্ঠাতা নরেশ গয়াল। আর্থিক তছরুপের মামলা সত্তরোর্ধ্ব নরেশকে শনিবার হাজির করানো হয়েছিল মুম্বাইয়ের একটি বিশেষ আদালতে।
আদালতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বিচারককে নরেশ জানান, বর্তমানে তার যা অবস্থা, এর থেকে জেলে মরে যাওয়াই ভাল।
আদালতে জেট এয়ারওয়েজ়ের প্রতিষ্ঠাতা আরও জানিয়েছেন, তার স্ত্রী অনিতার শারীরিক অবস্থা সংকটজনক। ক্যানসারের ‘অ্যাডভান্সড স্টেজ’। স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে তিনি খুব উদ্বিগ্ন।
তাই সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে তাকে জামিন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। শনিবার ৬ জানুয়ারি তাকে আদালতে হাজির করানোর পর শুনানি শুরু হতেই নরেশ বিচারকের কাছে ব্যক্তিগত কিছু কথা বলার জন্য অনুমতি চান। বিচারক তাতে সম্মতিও দেন।
আদালতের রেকর্ড অনুযায়ী, যে কয়েক মিনিট ব্যক্তিগত সময় চেয়েছিলেন নরেশ, সেই সময়ে তিনি নিজের পরিস্থিতি এবং স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। ওই সময়ই, জেলে মৃত্যুর কথা বলেন জেট এয়ারওয়েজ় প্রতিষ্ঠাতা।
এ সময় তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল। নরেশ আদালতে জানান, তার স্ত্রীর অবস্থা সংকটজনক। কন্যাও অসুস্থ। জেলের কর্মীরা তাকে ঠিকমতো সহযোগিতা করছেন না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
আদালতের রেকর্ড অনুযায়ী, নরেশের প্রস্রাবের সমস্যা রয়েছে। মাঝেমধ্যে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়ে। হাঁটুর সমস্যার জন্য ঠিক মতো দাঁড়াতে পারেন না। আদালতে নরেশ জানান, তার স্বাস্থ্যও সঙ্কটজনক। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে জেজে হাসপাতালে ভর্তি করানো হচ্ছে না। তাই এই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে জেলে ‘মরার’ অনুমতি দিক আদালত।
প্রসঙ্গত, ৫২৮ কোটি টাকা আর্থিক তছরুপের অভিযোগে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর হাতে গ্রেপ্তার হন নরেশ। গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর তাকে ব্যাংক প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকেই তিনি আর্থার রোড জেলে বন্দি।
এক সময়ে তিনিই ছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বিমান সংস্থার কর্ণধার। রেলের টিকিটের এজেন্ট থেকে ভারতের বৃহত্তম বেসরকারি বিমান সংস্থা ‘জেট এয়ারওয়েজ’-এর কর্ণধার হন নরেশ। সিংহাসন হারিয়ে আর্থিক তছরুপের দায়ে এখন তিনি বন্দি কারাগারে।
১৯৯২ সালে পথচলা শুরু করে জেট এয়ারওয়েজ়। ১৯৯৩ সালের ৫ মে শুরু হয় পরিষেবার। একটা সময়ে তার হাতে ছিল ১২৩টি বিমান। কিন্তু ২০০৬-০৭ সালের পর আর লাভের মুখ দেখেনি সংস্থা। কমতে কমতে সেই বিমানের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৫টিতে। পুঁজির অভাবে সেই পরিষেবাও বন্ধ হয়ে যায় ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল।
২০২২ সালের নভেম্বরে নরেশের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ দায়ের করেছিলেন কানাড়া ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতারণা এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় নরেশ, তার স্ত্রী অনিতা এবং গৌরাঙ্গ শেট্টি নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে।
অভিযোগে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বলেন, জেট এয়ারওয়েজ় (ইন্ডিয়া) লিমিটেডকে (জেআইএল) ৮৪৮.৮৬ কোটি টাকার যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ৫৩৮.৬২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ব্যাঙ্কের আরও অভিযোগ ছিল যে, জেট কর্তৃপক্ষ নিজেদের অডিটে দেখিয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন সংস্থাকে সীমার বাইরে গিয়ে ১৪০০ কোটিরও বেশি টাকা দিয়েছিলেন।
অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে সিবিআই। জেটের বিভিন্ন দফতরের পাশাপাশি নরেশ-সহ অন্য অভিযুক্তদের জেরাও করা হয়েছিল। এর পর গত বছর মে মাসে নরেশের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করে সিবিআই এবং আর্থিক তছরুপের মামলা করে ইডি। মে মাসেই জেট এয়ারওয়েজ়ের প্রতিষ্ঠাতা নরেশ গয়ালের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছিল সিবিআই।
নরেশ ছাড়াও এই সংস্থার একাধিক প্রাক্তন আধিকারিকের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। দিল্লি, মুম্বাইসহ দেশের সাতটি জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। জেট এয়ারওয়েজ়ের দপ্তরেও করা হয়েছিল তল্লাশি।
সিবিআইয়ের এফআইআরে অভিযোগ করে, জেট এয়ারওয়েজ় (ইন্ডিয়া) লিমিটেড (জেআইএল)-এর নমুনা চুক্তিতে উল্লেখ করা রয়েছে যে জেনারেল সেলিং এজেন্টদের (জিএসএ) খরচ জিএসএ-র নিজেকেই বহন করতে হবে। দেখা গিয়েছে জেট জিএসএ-র নামে ৪০৩ কোটি টাকার যে খরচ দেখিয়েছে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত খরচেও জেটের টাকা ব্যবহার করেছেন নরেশ।
সেপ্টেম্বর মাসে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর হাতে গ্রেপ্তার হন নরেশ। মুম্বাইয়ে জেট এয়ারওয়েজ়ের অফিসে বেশ কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আর্থিক তছরুপ বিরোধী আইন (পিএমএলএ)-এর আওতায় তাকে গ্রেফতার করেছিল ইডি। তারপর থেকেই তিনি মুম্বাইয়ের আর্থার রোড জেলে বন্দি।
২০২৩ সালের অক্টোবরে কানাড়া ব্যাংকের ৫৩৮ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে জেট এয়ারওয়েজ়ের প্রতিষ্ঠাতা নরেশ গয়াল-সহ ছ’জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। মুম্বাইয়ের বিশেষ আদালতে ইডির তরফে ওই চার্জশিট দাখিল করা হয়।
নভেম্বরে নরেশ এবং তার পরিবারের সদস্যদের সমপরিমাণ অর্থের স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। শনিবার এই সংক্রান্ত মামলায় আদালতে হাজির করানো হয় নরেশ গয়ালকে। তখনই বিচারকের কাছে জামিনের আবেদন করেন নরেশ।