চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

টার্গেট যখন বাইক ও বাইকার

সড়কে সাম্প্রতিক সময়ে যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার অধিকাংশের জন্য মোটরসাইকেল দায়ী বলে অভিযোগ উঠেছে। দ্রুতগতির এই যানবাহন চালকদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে তৈরি হচ্ছে ‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা-২০২৩’। যেখানে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোতে এর গতিসীমা নির্ধারণ করা হচ্ছে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত ৯ সদস্যের একটি কমিটি এই খসড়া নীতিমালা তৈরি করেন।

প্রস্তাবিত খসড়া নীতিমালায় যা যা থাকছে

  • ঢাকা ও অন্যান্য শহরের ভেতর মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিলোমিটার।
  • মহাসড়কে ১২৬-এর কম সিসির (ইঞ্জিনক্ষমতা) মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।
  • পেছনে আরোহী নিয়ে মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না।
  • ঈদ বা দুর্গাপূজার মতো উৎসব বা পার্বণকালীন ১০ দিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলতে পারবে না।
  • যেকোন সড়কে গর্ভবতী নারী, বয়স্ক ব্যক্তি ও ১২ বছরের কম বয়সি শিশুদের মোটরসাইকেলের আরোহী হিসাবে নেওয়া যাবে না।
  • এতে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তির কাছে মোটরসাইকেল বিক্রি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
  • এছাড়াও রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকের পোশাক ও হেলমেটের রং নির্ধারণ করে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে এ নীতিমালায়।

নীতিমালার প্রতিক্রিয়ায় চালকেরা যা বলছেন
নতুন নীতিমালার খসড়ায় গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ কিলোমিটার, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক উল্লেখ করে একজন মোটরসাইকেল চালক বলেন, একটা প্যাডেল রিকশা কিংবা সাইকেলের গতিও ৩০ কিলোমিটারের উপরে উঠে। তাহলে আমার পক্ষে এই গতি নিয়ে কিভাবে চালানো সম্ভব! তাছাড়া আমার সাথে যে গাড়িগুলো চলবে- বাস, ট্রাক, সিএনজি এদের গতি থাকবে ৭০-১০০ কিলোমিটার। আমি যদি তাদের সাথে সমানভাবে গতি না নিয়ন্ত্রণ করি, তাহলে পিছন থেকে আমাকে মেরে দিয়ে চলে যাবে। তখন এর দায়ভার কে নেবে! এই নিয়ম করা হলে শুধু নিয়মই হয়ে থাকবে, যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের মাধ্যমে পরিবারের খরচ বহন করেন চালক মামুন। তিনি বলেন, এমনিতেই এখন তেলের দামসহ সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি। এই নিয়ম করা হলে, আমাদের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আগে প্রতি লিটার তেলে ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার যেতে পারলে, এখন গতির কারণে অন্তত ৭-১০ ‍কিলোমিটার কম যেতে হবে। এছাড়া আমাদের আয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়বে। জনসাধারণের বিপক্ষে যাবে এমন নীতিমালা চূড়ান্ত না করার অনুরোধ জানান তিনি।

ঈদ, পূজা কিংবা উৎসবের সময়ে একটু বেশি টাকা আয় হয় উল্লেখ করে আরেক রাইডার বলেন, উৎসবের দিনগুলোতে আমাদের নিয়মিত আয়ের চেয়ে একটু ভালো হয়, আর এটা সকলের জানা কথা। অথচ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃত আমাদের সমস্যার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন শিক্ষিত কিন্তু পরিবারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে রাইডার হয়েছেন। তাদের সকলকে একটা করে চাকরির ব্যাবস্থা করে দেওয়া হোক। তাহলে আমরা রাইড দেওয়া ছেড়ে দিব। মোটরসাইকেল জীবনের তাগিদে চালাতে হয়, রাস্তায় কেউ ইচ্ছে করে পড়ে থাকে না।

অন্যদিকে ব্যবসা ক্ষেত্রে এমন নীতিমালায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে উল্লেখ করে মোটরসাইকেল কোম্পানির এক শো-রুম ম্যানেজার বলেন, বিগত বছরের তুলনায় গত বছর অন্যান্য ব্যবসার মতো মোটরসাইকেল ব্যবসায়ও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। করোনা শেষে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে এখনও আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারিনি। তার মধ্যে আবার নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ক্রেতারা মোটরসাইকেল কেনা থেকে দূরে সরে যাবে।

তিনি বলেন, মোটরসাইকেল একটি দ্রুতগতির বাহন। মানুষ জরুরী কাজে এটি ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু আপনি যদি এর গতিসীমা কমিয়ে দিতে বাধ্য করেন, তাহলে মানুষ কেন এটা ব্যবহার করবে! এছাড়াও তিনি বলেন, নতুন নিয়মে ১২৬ সিসির নিচে মোটরসাইকেল মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে না। আমাদের মতো একটা মধ্যম আয়ের দেশে ১২৬ সিসির বেশি মোটরসাইকেল ক্রয় করার ক্ষমতা কত শতাংশের রয়েছে তা চিন্তা করা উচিৎ ছিল কর্তৃপক্ষের।

কেন নেওয়া হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত

  • সড়কে দুর্ঘটনা কমানো।
  • মোটরসাইকেলের নিরাপদ ব্যবহার ও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ তৈরি।
  • মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জন্যই এসব নিয়মনীতি তৈরি করা হয়েছে।

জরুরি প্রয়োজনে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দূরের পথে মহাসড়কসহ সর্বত্র মোটরসাইকেলের চলাচল দেখা যায়। বিশেষ করে, উৎসবের সময় মোটরসাইকেলের ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বিপুল প্রাণহানি ঘটছে। এজন্য মোটরসাইকেলের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে মনে করছেন কর্তৃপক্ষ।

সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল কতটা দায়ী
যাত্রী কল্যাণ সমিতি, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনসহ বেসরকারি সংস্থাগুলো সড়ক দুর্ঘটনা যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে, সে অনুযায়ী দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির প্রায় ৪০ শতাংশের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংশ্নিষ্টতা রয়েছে।

দেশে নিবন্ধিত ৫৬ লাখ ২৮ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৪০ লাখ ৩৯ হাজার মোটরসাইকেল। গত ১১ বছরে সারাদেশে চারগুণ হয়েছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। ২০২২ সালে নতুন ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে। তবে রাজধানীতে মোটরসাইকেল বাড়ার হার আরও বেশি। ঢাকায় ১১ বছরে পাঁচগুণ হয়েছে এই দ্বিচক্রযানের সংখ্যা। ঢাকায় নিবন্ধিত ১৯ লাখ ৬৬ হাজার যানবাহনের ১০ লাখ ২৩ হাজারই মোটরসাইকেল।

সড়কে শুধু মোটরসাইকেলের উপর নিষেধাজ্ঞা কেন
মোটরসাইকেলের উপর করা এটাই প্রথম নিষেধাজ্ঞা নয়। আর আগেও বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ পদ্মাসেতু সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার পরদিন, ২৭ জুন ২০২২ (সোমবার) সকাল ৬টা থেকে পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এছাড়াও বিভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা ও বিভিন্ন নিয়মনীতি করা হয়েছে।

নতুন নীতিমালার খসড়ায় বলা হচ্ছে, চার চাকার বাহনের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ গুণ বেশি রয়েছে। তবে মানুষ নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ বাহনটির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। যারফলে, তাদের মাঝে সচেতনতার লক্ষ্যে এমন সিদ্ধান্ত।

অন্যদিকে, লাইসেন্স ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া মোটরসাইকেল চালানোকে ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেল বলে মনে করছেন অনেকে।