চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

প্রতীক্ষা ‘লুসেইল মহাযুদ্ধের’

টানা একমাস বিরতিহীন চলতে থাকা কাতার বিশ্বকাপে এখন ক্লান্তি আর অবসন্নতা ভর করেছে। ৩২’র মধ্যে সেরা দুই দল শেষ লড়াইয়ে নিজেদের উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। পরের সেরা দুই দল আনুষ্ঠানিকতার তৃতীয় স্থান নির্ধারণীর জোয়াল কাঁধে নিতে রাজী। আমরা যারা খেলার খবরের পিছনে ছুটেছি তারা গুনছি বাড়ী ফেরার দিন।

ফুটবল বিশ্বকাপ শুধু খেলোয়াড়দের শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক শক্তির পরীক্ষা নেয় না, সাংবাদিক ও সংগঠকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষায় ফেলে। এবারের আসরে কাজ করতে করতে দুই সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে, চোখের সামনে বেশ কয়েক সহকর্মীতে অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে হাসপাতালে যেতে দেখেছি। প্রতিদিন শুধু তরতাজা খবর পাঠানোর জন্য নয় লড়াই করতে হচ্ছে টিকে থাকার, নিজেকে সুস্থ রাখার।

ফেরার ক্ষণ গুনতে গুনতেই নতুন করে উজ্জীবিত হচ্ছি রোববারের ‘লুসেইল-মহাযুদ্ধে’ দুই সেরা দলের বিশ্বজয়ের লড়াই দেখতে। ৩২ দলের ৬২ ম্যাচ শেষে একথা বলাই যায় সেরা দুই দলই খেলছে ফাইনাল। দুইবার করে জেতা আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের সামনে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়ের হাতছানি। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮-এ ইতালি, ১৯৫৮-১৯৬২’র পর তৃতীয় দেশ হিসাবে ফরাসীদের সামনে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতে রেকর্ড গড়ার সুযোগ।

কোচ দিদিয়ের দেশম ফ্রান্সকে ’৯৮তে অধিনায়ক হিসাবে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, ২০১৮’তে জিতিয়েছেন কোচ হিসাবে। এবার কোচ হিসাবে টানা দ্বিতীয়বারসহ ফ্রান্সের তিন বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য হতে পারবেন? ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ হিসাবে শেষ ম্যাচে কি আরও একবার ইতিহাসে নাম লেখাবেন দেশম?

এটি হতে চলেছে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি’রও শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ। ফুটবল ঈশ্বরের বরপুত্র কি পারবেন তিন যুগ পর কবিতা, বিপ্লব, শিল্পকলার দেশ আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ নিয়ে যেতে? দুই দশক পর মেসি’র হাতে চড়ে লাতিন আমেরিকায় ফিরবে ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার ট্রফি? সব প্রশ্নের উত্তর আছে ‘লুসেইল মহাযুদ্ধের’ অন্তে।

দোহায় সুপার-সানডে’র ফাইনাল শুধু ফরাসি ফুটবলীয় সৌরভ কিংবা আর্জেন্টাইন শিল্পের লড়াই নয়। এ লড়াইয়ে আছে বেশ’কটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। যেমন দুই ফুটবল পরাক্রমশালী মহাদেশ ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার ঐতিহ্যের লড়াই। ২০০২’র পর চার বিশ্বকাপ আসরে লাতিনদের পেছনে ফেলে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে গেছে ইউরোপ। এবার কি ইউরোপ ছেড়ে আটলান্টিক পাড়ি দেবে ফুটবলের বিশ্বকাপ?

যুদ্ধটি এসময়ের দুই সেরা ফুটবলার ও প্যারিস সেইন্ট জার্মেই’র দুই টিমমেট লিওনেল মেসি ও কাইলিয়ান এমবাপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণেরও। দশ লা লিগা, এক ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান, চার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এক কোপা আমেরিকা, এক ফিনালিস্সিমা ও সাত ফিফা বর্ষসেরা’র পুরস্কার জিতেও ৩৫ বছর বয়সী মেসি’র ট্রফি ক্যাবিনেট জৌলুশহীন একটি বিশ্বকাপের অভাবে।

অন্যদিকে মাত্র ১৯ বছরে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ দলের সদস্য হয়েও এমবাপের অপেক্ষা বর্ষসেরা’র স্বীকৃতির। রোববার দেশকে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতালে ২৩ বছরেই পূর্ণ হবে এমবাপের বিশ্ব স্বীকৃতির অপেক্ষার। বিশ্বকাপের এ আসরে ‘গোল্ডেন বুট’ ও ‘গোল্ডেন বল’ জেতার দৌড়েও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এগোচ্ছেন মেসি ও এমবাপে। পাঁচ গোল আর তিন অ্যাসিস্ট নিয়ে আপাতত এক নম্বরে মেসি, পাঁচ গোল ও দুই এসিস্ট নিয়ে পরের স্থানেই এমবাপে।

দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে ফাইনালের পারফরম্যান্সে। তবে গোল্ডেন বল জেতার দৌড়ে মেসি এগিয়ে এবারের আসরে চার ম্যাচের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিতে। শুধু ইউরোপ-লাতিন আমেরিকা, ফ্রান্স—আর্জেন্টিনা, মেসি-এমবাপে, আলভারেজ-জিরুদের নয়, ‘লুসেইলের মহাযুদ্ধ’ দুই সফল ট্যাকটেশিয়ান ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশম ও আর্জেন্টিনার লিওনেল সেবাস্টিয়ান স্কালোনির মস্তিষ্কের, ফুটবল কৌশলের।

ফাইনালের দুই প্রতিপক্ষের কোচের সামনে অভিন্ন কঠিন এক পরীক্ষা, প্রতিপক্ষ পরাক্রমশালী দলের বিজয়রথ থামিয়ে দেয়ার। ফরাসি কোচ দেশমকে যেমন আর্জেন্টিনার প্রধান অস্ত্র মেসিকে নিষ্ক্রিয় করার উপায় দেখাতে হবে, তেমনি ৪৪ বছর বয়সী স্কালোনির মাথাব্যথা অনেকটাই কমে যাবে তার ‘এমবাপে বশে’র কৌশল সফল হলে।

২০১৮’তে এই ফ্রান্সের কাছে হেরে ‘লা আলবিসেলেস্তের’ বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হলে আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলকে পাঁচ ম্যাচ কোচিং করানোর অভিজ্ঞ স্কালোনিকে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসাবে নিয়োগ দেয় আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। এরপর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই স্কালোনি হয়েছেন আর্জেন্টাইন ফুটবলের ‘কামাল আতাতুর্ক’, রেনেসাঁর নায়ক। তার ফ্রেঞ্চ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশম যখন রোববারের ফাইনাল দিয়ে ‘লস-ব্লসের’ কোচ হিসাবে ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্কালোনি কাতার দল নিয়ে আসার আগেই পেয়েছেন বড় সুসংবাদ। এবারের পারফরম্যান্স যাই হোক, তার চাকরির মেয়াদ বেড়েছে ২০২৬’র পরবর্তী বিশ্বকাপ আসর পর্যন্ত।

এমন অর্জন স্কালোনিকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই পেতে হয়েছে। কোচ হিসাবে স্কালোনির বড় সার্থকতা তিনি একসময় আর্জেন্টিনার জার্সিতে টিমমেট লিওনেল মেসি’র ফুটবল শৈলীতে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছেন। ২০১৮’র বিশ্বকাপের পর মেসি জাতীয় দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে টুইটারে মেসি’কে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে সফল হয়েছিলেন স্কালোনি।

আগের চার বিশ্বকাপে তরুণ মেসিকে এবারের মতো এত উজ্জীবিত কখনো দেখা যায়নি। মেসির দক্ষতাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আর্জেন্টিনাকে পরিণত করা হয়েছে দুর্ধর্ষ দলে। এর কৃতিত্বেই স্কালোনি পেতে পারেন ইতিহাসে ঠাঁই। প্রতিপক্ষের কোচরা বলছেন, মেসি নিঃসন্দেহে দলের নিউক্লিয়াস, তবে আর্জেন্টিনা এখন আর মোটেও মেসি নির্ভর দল নয়। কখনো আলভারেজ, কখনো অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার কিংবা মার্টিনেজরা এগিয়ে এসে দলকে জেতানোর দায়িত্ব নেন।

শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, ল্যাটিন-ফ্র্যান্সি ফুটবল থেকে বের করে আর্জেন্টিনাকে ইউরো ঘরানার এফেক্টিভ স্টাইলে অভ্যস্ত করেছেন স্কালোনি। তার স্ট্রাটেজির বড় বৈশিষ্ট্য প্রতিপক্ষকে নিজের কৌশল বুঝতে না দেয়া। গত চার বছরে প্রতিপক্ষ দেখে স্কালোনি তার ফর্মেশন সাজিয়েছেন। কখনো ৪-৪-২, কখনো ৪-৩-৩ বা ৪-২-৩-১ কখনো ৪-১, ৪-১ আবার কখনো বা ৪-১-৩-২।

স্কালোনি ইউরোপীয়দের অস্ত্র প্রেসিং ফর্মেশনে নতুনত্ব এনে সেই অস্ত্রেই ইউরোপীয়দের ঘায়েল করছেন। সেই ফর্মেশন পরিচিতি পেয়েছে পাসিং লাইন থেকে প্রেসিং লাইন বা পাসিং চ্যানেল থেকে প্রেসিং চ্যানেল নামে। ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত স্কালোনির স্ট্রাটেজি ও আর্জেন্টিনার খেলার ফর্মেশন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ম্যাচে প্রতিপক্ষের হাতে পজেশন ছেড়ে দিতে একেবারেই রাজি নয় ‘আলবিসেলেস্তেরা’। এমনকি লং পাস খেলার প্রবণতাও তাদের অন্যান্য সূচকের অনুপাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

আর্জেন্টাইন দলের পাসিং লাইন ফর্মেশন হচ্ছে চার বা পাঁচজনের একটি ইউনিটের দলবেঁধে আক্রমণ শুরু করা। যার কাছে বল থাকে তাকে একটি কল্পিত বৃত্তে রেখে চারপাশের খেলোয়াড়রা পজিশন নেয়, ফলস মুভমেন্ট করে। ফলে প্রতিপক্ষ বিভ্রান্ত হয় আক্রমণটা ঠিক কোনদিক থেকে আসছে বুঝতে না পেরে। প্রতিপক্ষের কাছে বল হারালেই এই বৃত্তাবদ্ধ দল বা ইউনিটটি ফিরতি পথে প্রতিপক্ষকে হাইপ্রেসিং শুরু করে, এভাবেই সারা মাঠের ক্ষুদে ক্ষুদে ইউনিট হয়ে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে প্রবল চাপে রাখে।

আর্জেন্টিনা দলে ডি মারিয়া ছাড়া স্বীকৃত কোনো উইংগার না থাকাটাকেও আশীর্বাদ বানিয়েছেন স্কালোনি। তার দলে বা ফর্মেশনে কোনো উইঙ্গার নেই বরং উইং প্লে করার জন্য তিনি স্বাধীনতা দিয়েছেন উইং ব্যাকস অ্যাকুনা, তাগলিয়াফিকো এবং মোলিনাকে। উইং ব্যাকেরা স্বাধীনতা পেলেও স্কালোনির কৌশলে রক্ষণ পাহারা দিতে সর্বদাই থাকেন ফোর-ম্যান ডিফেন্স লাইন। এছাড়া গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্টিনেজ ফিফথ ডিফেন্ডার হিসাবে পাসিং-এ অংশ নেন। পাশাপাশি পাসিং-প্রেসিং’র ছোট ছোট জোনাল ইউনিট এবং গোলকিপার মার্টিনেজসহ ফোর ম্যান ডিফেন্স লাইন মিলিয়ে ইতালির বিপক্ষে ফিনালিস্সিমায় আর্জেন্টিনার ডিফেন্সে সার্বক্ষণিক পাহারায় ছিল আট ফুটবলার।

রক্ষণে পটু ইতালি পাঁচজনের ‘বাস-পার্কিং’ ডিফেন্স লাইন সাজিয়েও কেন ফিনালিস্সিমায় ৩-০ গোলে হেরেছে তা এই কৌশলে পরিষ্কার। ম্যাক অ্যালিস্টার ও জুলিয়ান আলভারেজের উঠে আসা স্কালোনি ও আর্জেন্টিনাকে এতটাই নির্ভার করেছে যে অধিনায়ক মেসি ফ্রি মুভার হিসাবে নির্ভার হয়ে খেলতে পারছেন। পাওলো দিবালা ও ডি মারিয়াকে একাদশে প্রয়োজনই হচ্ছে না। তাই বলে ফাইনালে নামার আগেই ‘লস ব্লুস’ হেরে যাচ্ছে, ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়।

এসময়ের অন্যতম সেরা ‘ফুটবল মস্তিষ্ক’ দিদিয়ের দেশমের বড় কৃতিত্ব তার দলটি গত পাঁচ বছর ধরে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসাবে টিকে আছে। ৫৪ বছর বয়সী দেশম খেলেছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে, ফ্রান্স দলকে ৩-৪-৩ এবং ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে। শেষের ফর্মেশনটি তুলনামূলক আক্রমণাত্মক। শক্ত প্রতিপক্ষ এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ৩-৪-২-১ সতর্ক ফর্মেশনেও একাদশ সাজান দেশম। তার প্রেসিং শুরু হয় নিজ ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে।

বল দখলে এলেই দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠা ফ্রান্স দলের সাফল্যের মূলমন্ত্র। বৈচিত্র্য আনতে এবং প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিতে ফ্রান্স দলের প্রেসিং শুরু হয় একেবারে সেন্টার লাইনে। প্রতিপক্ষের বাড়ানো ভুল পাস ধরে ফেলার কৌশল যা, ‘ট্রিগার্স’ নামে পরিচিত তার মাধ্যমেও আক্রমণের সূচনা করেন এমবাপে, গ্রিজম্যান।

এবারের আসরে পগবা, কান্তে, এনকুকু, কিমপেম্বে ও বেনজেমার অভাব বুঝতে দিচ্ছেন না শুয়ামেনি, জিরুদ, হার্নান্দেজের পারফরম্যান্স। এটাই দেশমের কোচিং দর্শনের সফলতা। এমবাপেকে প্রতিপক্ষ মার্কিংয়ে রাখছে। তাতে গ্রিজম্যানের আক্রমণ সাজানো এবং জিরুদের হেড আর চকিত গোলস্কোরিং দক্ষতা বুঝিয়ে দিচ্ছে ফ্রান্সের শক্তির উৎস কত গভীরে।

বিজ্ঞাপন

Nil Joler Kabbo
Bellow Post-Green View