
হায়দ্রাবাদে চলছে ভয়ংকর সুন্দর আতশবাজি! ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে স্টেশন। ট্রেনে ট্রেনে উঠছে হুইসেল, ড্রামের আওয়াজে উন্মাদনা। দক্ষিণী নৃত্যকলা-সংগীতের ছন্দে উল্লাস-চিৎকার, হাসি-আবেগ-কান্নার-মিছিলের গণজোয়ার, মোটর শোভাযাত্রার হর্নে হর্নে জীবন যায় যায় নগরের। নানা দল-মত-পথ-দর্শন, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক সব শ্রেণির আমজনতার এত উল্লাস, এত উদযাপন কি পৃথিবীর কোথাও দেখেছে মানুষ?’
চন্দ্রজয়ের খবরে এমনই তো উদযাপন হওয়ার কথা ছিল ভারতবর্ষ জুড়ে। কিন্তু না! এতটা নয়। স্টেশনে পা রেখে তেমন কিছু গোচরে এলো না আমার। হয়ত স্টেশনের বাইরে হচ্ছে। কি জানি। পরে জানতে পারব। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় বাজে। আড়াই ঘণ্টা দেরিতে ইস্ট-কোস্ট পৌঁছায় সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশনে।
সেকেন্দ্রাবাদ হচ্ছে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ব্যস্ত রেলওয়ে জংশন। এটি হায়দ্রাবাদের একটি যমজ শহর হিসেবেও পরিচিত। নামকরণ করা হয়েছিল সিকান্দার জাহ-এর নামে, যিনি হায়দ্রাবাদের তৃতীয় নিজাম তথা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে হায়দ্রাবাদের শাসক ছিলেন। হায়দ্রাবাদের মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় ৭.৭ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশদের আমলে নিজাম দ্বারা নির্মিত এটি। সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বিকশিত হয়েছে। এখানকার অনেক ভবনের স্থাপত্য ব্রিটিশ শৈলীতে ভরপুর। সেকেন্দ্রাবাদের সাথে ভারতের সমস্ত অঞ্চলের রেলপথে সংযুক্ত। প্রতিদিন আড়াই শতাধিক ট্রেন আসা-যাওয়া করে। প্রায় দুই লাখ যাত্রী স্টেশনে চলাচল করে।
এমন ব্যস্তততম রেল জংশনে সন্ধ্যায় পা ফেলে যাত্রীদের স্বাভাবিক চলাচল ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়লো না আমার। হয়ত নয়াদিল্লী কিংবা অন্য কোথাও ভালোই উদযাপন হচ্ছে। কিংবা ইসরোর ভবনগুলোতে। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা সারা ভারতবর্ষের উদযাপনের মূল বিষয়। বিষয়টা হলো, ভারতীয়রা এত উদযাপন বা আনুষ্ঠানিকতায় মাতে না। মূল কাজের কাজটিই করতে দেখছি সব সময়। সাধারণ-সহজ জীবনযাপন। লোক দেখানো তেমন কিছু নেই। কিন্তু বিশাল কিছু করে ফেলাটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাপারটা বাংলাদেশে ঘটলে আবেগীয় মাত্রা অন্যরকম হতে পারতো। বাঁধ ভাঙা জোয়ারে উন্মাদ হয়ে উঠতো শহর-নগর। আমরা চরম আবেগীয় জাতি। এই আবেগ নিয়েই তো আমরা ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আবেগও একটা জাতির চরম শক্তি হতে পারে। তা আমরাই প্রমাণ করেছি।

আমি সে জাতিরই অংশীদার। আমার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট শক্তি থাকলেও অজান্তেই চলে আসে। একদিন আগে দীর্ঘ ভ্রমণের আবেগ সঙ্গ করেই হায়দ্রাবাদের ট্রেনে চড়ে বসেছিলাম কলকাতার সালিমার স্টেশন থেকে। উদ্দেশ্য হায়দ্রাবাদ ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথনে অংশগ্রহণ। বাংলার সবুজ বন-মাঠ-ঘাট ফেলে উড়িষ্যায় চলতে চলতে রাত আসে। কবি মন ভার করে তাতে। ‘রাত-বিরাতের অপথ-পথে/জ্যোস্না বিনে মিছে/গভীর প্রেমে অথৈ সাগর/ঢেউয়ের ছন্দে মিশে’। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় জ্যোস্নার খবর রাখতে পারিনি। ট্রেনের ঝক ঝক শব্দ কিছুটা কানে বাজে। তবে তা ঘুম ভাঙার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং আরামদায়ক। খুব সকালে আরামের ঘুম যখন ভেঙে যায়, তখন নিজেকে আবিস্কার করেছি অন্ধ্রপ্রদেশে। আমার কামরার সঙ্গীদের সিট ফাঁকা। সম্ভবত মাঝরাতেই নেমে পড়েছে অভিজিৎ ও অরিজিৎ। সেটাই কথা ছিল। তাদের গন্তব্য ছিল বিশাখাপত্তনম।
অন্ধ্রপ্রদেশের এই পাহাড়-সমুদ্র নগরী অতিক্রম করে আমার ট্রেন চলছে ১২০ কিলোমিটার বেগে। আজকের সকালটা কিছুটা বদলে গেছে। একটু অচেনা লাগছে। গতকালও সব চেনা ছিল। কারণ আমরা এখন বাংলা থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরের এক প্রদেশে। যার পরিবেশ-আবহাওয়া অনেকটাই ভিন্ন। ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন চ্যালেঞ্জ, ভিন্ন কোনো সম্ভাবনা। এমন ভিন্ন পরিবেশ, নতুনত্ব, নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলাটাই জীবনের সৌন্দর্য।
‘মাহমুদও এমন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, নতুন সম্ভাবনা তৈরির স্বপ্ন বুনে ঘর ছেড়েছেন। ছেড়ে এসেছেন রক্তের মানুষ মা-বাবা, একমাত্র ছোট বোন নয়নকে, যাদেরকে মাহমুদ ভালোবাসে জীবনের চেয়েও বেশি। তবুও তিনি ঘর ছেড়েছেন আরও মূল্যবান কিছুর জন্য, আরও নতুন কোনো সম্ভাবনার জন্য, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। আর সে চ্যালেঞ্জ স্বাধীনতা সংগ্রাম, সে সম্ভাবনা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি দেশকে বাঁচাবে বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা মাহমুদ যুদ্ধ করছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন গারো পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পে। সেখানকার ক্যাম্প অধিনায়ক মাহমুদ। এই দায়িত্ব গ্রহণের আগে মাহমুদকে কেমন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে তা শুধু মাহমুদই জানেন। আর জানেন তার প্রাণের বন্ধু সুবল, অন্তরালে ভালোবেসে যাওয়া প্রিয়তমা শেফালি, ক্ষণিকের আশ্রয় হয়ে যাওয়া সিদ্দিকুর রহমান কিংবা জনসম্পত্তি হওয়া সেই সুন্দরী রমনি মালতী কিংবা খানিকটা সুইপারের শ্যাম রঙের নারী বাসন্তী। কিন্তু মাহমুদ তো এদের সবাইকে হারিয়ে এসেছে। কি নির্মম, লৌমহর্ষক একেকটি দিন পেরিয়ে আজ মাহমুদ মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে কথা তিনি কাকে বুঝাবেন!
২৫ মার্চ কালরাতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন মাহমুদ, সে নৃশংসতা তাকে আজীবন ভোগাবে। মালতীর মাদকাসক্ত ঘরে আশ্রয় গ্রহণের ফলেই তো সে রাতে বেঁচে গিয়েছিলেন মাহমুদ, তার প্রাণের বন্ধু সুবল, পুলিশের ইনফর্মার সিদ্দিকুর রহমান। হলে রাতযাপন করলে মাহমুদেরও নিথর দেহ পড়ে থাকতো এতক্ষণে। আর জগন্নাথ হলে পড়ে থাকতো সুবলের লাশ। সিদ্দিকুর রহমানের হয়তো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে। কেননা, এই রাতে প্রতিটি জায়গায় গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কত কত মৃতদেহ তো খুঁজেই পাওয়া যায়নি। তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছিল একটু পরই টের পাওয়া যায়। হরিজন পল্লীতে আচমকা বাঁশির শব্দে আঁতকে উঠেন মাহমুদ। কিছু একটা হতে চলেছে। মাহমুদের মাথায় দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খায়। ভাবেন, হলে পাকিস্তানিদের হাতে মারা গেলে দেশের জন্য শহিদ হতাম। কিন্তু এই হরিজন পল্লীতে, সুইপার কলোনিতে মালতীর মদের ঘরে মৃত্যু হবে! এত মহা কেলেংকারী! মাহমুদের খুব রাগ হয় সিদ্দিকুর রহমানের ওপর। এই লোকটাই তাকে মালতীর ঘরে নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে সিদ্দিকুর রহমান ঘরে ঢুকে জানালেন ঢাকা শহরের সকল সুইপারদের ডাক পড়েছে। বাঁচতে চাইলে তাদেরকেও সুইপার সাজতে হবে। সুইপার মানে মেথর। পায়খানা পরিস্কার করার ডাক পড়েছে ভাবছেন মাহমুদ। কাজটা কি সেটা স্পষ্টভাবে জানতে না পারলেও মাহমুদ ভাবেন, তাদেরকে পাকিস্তানীদের মলমূত্র পরিস্কারে লাগিয়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু তা নয়। মাহমুদ, সুবল ও সিদ্দিকুর রহমান সুইপারদের সারি সঙ্গে যেতে যেতে শহিদ মিনারের পাশে গিয়েই থমকে যান! শহিদ মিনারের ধ্বংসস্তুপ দেখে তারা যা বুঝার বুঝে নেন। কালরাতে ভয়ংকর কালো ছায়া পড়েছে এই শহরে! এই জাতির ওপর চালিয়েছে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। জগন্নাথ হলে যাওয়ার পর সেটা স্পষ্টতই প্রতিয়মান হয়! সেদিন মাহমুদ-সুবলরা নিজ হাতে নিজের বন্ধু-সহপাঠী, বড় ভাইদের লাশ মাটি চাপা দিয়েছেন! দিতে হয়েছে তাদের! তাদের বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থেকে পাকিস্তানিদের এই রক্তের প্রতিশোধ নেবার জন্য, একটা স্বাধীন দেশের জন্য বেঁচে থাকতে হবে। তাই এই মৃত্যু উপত্যকাতেও মাহমুদ-সুবলরা দাঁতে দাঁত কামড়ে লাশ মাটি চাপা দিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু এরপর কী হলো? মাহমুদ একাই বেঁচে ফিরতে পেরেছে। সুবল, সিদ্দিকুর, মালতী, শেফালি, বাসন্তী কেউই আর সঙ্গে নেই। এখন আছে ওমর, আজিজদের মতো মুক্তিযোদ্ধা! তারা এখন নতুন সম্ভাবনার জন্য যুদ্ধ করছেন’!
জানালার পাশের সিটে বসে আমি ‘ট্রানজিট ১৯৭১’-এ ডুব দিয়েছিলাম মূলত। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই উপন্যাসটিই আমার ট্রেনের সঙ্গী হয়ে আসছে। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে মনোযোগ ফিরে যায় চা ওয়ালার ডাকে। এককাপ চা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বাইরের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি ততোক্ষণে অন্ধ্রপ্রদেশ পেরিয়ে তেলেঙ্গানায় প্রবেশ করেছি আমরা। একটু পর পর সুসজ্জিত মসজিদ চোখে পড়ছে। পড়ন্ত সূর্যের মৃদু রোদ এসে চোখে লাগছে। সম্ভবত বেলা সাড়ে ৫টা। আমাদের ট্রেন হায়দ্রাবাদ থেকে ৬৫/৭০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে! হায়দ্রাবাদে মুসলিম সংখ্যা আনুমানিক ৫০ শতাংশ। ঢাকার মতো এত মসজিদ না থাকলেও কমও নয়। যদিও এখানে হিন্দু-মুসলিম আলাদা করে চলে না। তারা এক জনগোষ্ঠী, সমমনা, সাংস্কৃতিক বন্ধন খুব শক্তিশালী। ভারত আসলে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের দেশ। বাংলাদেশে বসে আমরা যেমনটা ভাবি তার থেকে বিপরীত এই দেশের জীবনযাত্রা ও মানুষের চিন্তাধারা। এই দেশ বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। এগিয়ে যেতে যেতে এতোটাই এগিয়েছে যে, একেবারে চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
হ্যাঁ, চাঁদের কথাই বলছিলাম। ওপাশের কামরা থেকে মৃদু উল্লাস ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। কান পেতে শুনলাম। ‘চন্দ্রযান-৩’ চাঁদে অবতরণ করেছে’! তার মানে সেই কাঙ্ক্ষিত সময় এখন। সম্ভবত সন্ধ্যা ৬টা বেজে ১৫ মিনিট। এরই মধ্যে চাঁদে অবতরণের খবর ট্রেনেও চলে এসেছে। অনলাইনের যুগ। সবই তো হাতের মুঠোই। আমি তাদের অংশ মৃদু উদযাপনে অংশ নিলাম। ভালোভাবে জানতে চাইলাম। ৬টা ৪ মিনিটেই চাঁদে অবতরণ করেছে ভারতের চন্দ্রযান-৩। ট্রেনে তার কয়েক মিনিট পর শব্দ হচ্ছে। গুটি কয়েক মানুষ হয়তো খবরের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা খুবই উল্লাস করছেন কয়েকজন। তবে নিরবে, নিভৃতে। যেন যাত্রীদের কোনো সমস্যা না হয়। তাদের নীতিই ভালো। ‘উদযাপন করো, আনন্দ করো, তবে অপরের ক্ষতি করে নয়’। চাঁদে পৌঁছে গেল ভারত। এতো বিরাট ব্যাপার ঘটে গেল, অথচ তেমন কোন আওয়াজ ছাড়াই! শুধু বিরাট ব্যাপার নয়, তার থেকেও বেশি কিছু। আমাদের ভাবনার জগতের চেয়েও বেশি! আর এই ব্যাপারটা এতো সহজে ঘটেনি। দীর্ঘ প্রস্তুতি, দীর্ঘ প্রচেষ্টা, বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, ত্যাগ-তিতিক্ষার ফল এটি।
শৈশবে কতোবারই পড়েছি যে মানুষ চাঁদেও চলে যাচ্ছে! ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের বুকে প্রথম মানুষ হিসেবে নীল আর্মস্ট্রং পা রেখেছিলেন। চাঁদে নেমে তিনি বলেছিলেন, “এটা একজন মানুষের ছোট একটা পদক্ষেপ হতে পারে, কিন্তু সমগ্র মানবজাতির জন্য বিরাট একটা লাফ!” হ্যাঁ, বিরাট লাফই তো বটে। আর সেই লাফের অর্ধ শতকেরও বেশি পরে ভারতের চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবরতণ করেছে। মহাকাশে দীর্ঘ এক মাস ৯ দিনের যাত্রা শেষে চন্দ্রযানটি সফলভাবে অবতরণ করে। এর মধ্যদিয়ে ভারতকে বিশ্বের এলিট ‘স্পেস ক্লাবে’ জায়গা করে দিয়েছে। এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারত এই গৌরব অর্জন করল। বাকি তিন দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন/রাশিয়া এবং চীন। আর চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের দিক থেকে ভারতই প্রথম দেশ। গত ১৪ জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রযান-৩ এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর আজ সেটির সফল অবতরণ হল। কি এক কাকতালীয় ব্যাপার যে, দক্ষিণ ভারত থেকেই চাঁদ গেছে ভারতের দক্ষিণ মেরুতে। আর আমার আগমনও হয়েছে সেই দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদের বুকে।
হায়দ্রাবাদের প্রধান রেল জংশন সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশনে নেমে আমি বাইরে এসে অটো খুঁজছি। আমাকে যেতে হবে বানজারা হিলস এলাকায়, যেখানে আমার হোস্টেল বুকিং করা আছে আগে থেকে। সেকেন্দ্রাবাদ থেকে ৮ কিলোমিটারের পথ। জর্জ বলে দিয়েছিল, অটো নিতে এবং ভাড়া নিবে ২০০ রূপি। আমি বেরিয়ে অটো খুঁজতে গিয়ে তো অবাক। চারশ রূপি চাইতে থাকল অটো চালকরা। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে। আচ্ছা, এরা কি জানে তাদের দেশ এখন চাঁদে উঠে গেছে? না, জানার কথা না। আর জানলে তো তাদের অটো ভাড়াটা ফ্রি করে দেবার কথা খুশিতে। তবে আমি সেকেন্দ্রাবাদের এই বাস-অটো স্টেশনে অন্তত তেমন কোন উদযাপনের ছাপ দেখছি না। রেলের একটা কামরায় কয়েকজনের মৃদু উল্লাস ধ্বনি শুনেছিলাম; এটুকুই যা। সেকেন্দ্রাবাদ স্টেশনে তার ছিটেফোটাও দেখলাম না। স্টেশনের বাইরে তো একেবারেই কোনো কিছু নেই। মানুষ বাস-অটোতে উঠার জন্য হুড়োহুড়ি করছেন। অফিস শেষে দিক-বেদিক ছুটছেন। আমিও ছুটছি বাসের খোঁজে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর ৪৯ নাম্বার বাস পেলাম, যেটি মূলত বানজারা হিলস এরিয়া দিয়ে চলে যাবে। গুগল ম্যাপ সার্চ করে দেখলাম যে পথ দিয়ে যাবে বাসটি সেখান থেকে আমার হোস্টেলের দূরত্ব কত! মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে আমি নামতে পারব। তাহলে এত টেনশন কেন? বাসেই উঠেছি। প্রচন্ড ভিড়। কোন ব্যাপার না। বাসে ভিড় হলেও ঢাকা শহরের মতো লক্করঝক্কর বাস নয়। বেশ সুন্দর, গোছানো এবং ভালো বাস। মানুষজনও বেশ সুভাষী, সবাই চুপচাপ বসে-দাঁড়িয়ে আছেন। অযথা ধাক্কাধাক্কি করছেন না। অসাবধানতাবশত একটু ধাক্কা লেগে গেলেও দুঃখ প্রকাশ করছেন। মুসকি হেসে উত্তর দিচ্ছেন। আমার বাস ভাড়া পড়েছে মাত্র ৩০ রূপি। অটোতে চেয়েছে চারশ রূপি। যত-যাই বলি, হায়দ্রাবাদের অটোওয়ালাদেরকে আমার কাছে ঢাকার মতোই মনে হয়েছে। ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। তারা চাইবে ৫০০ টাকা। এখানেও অটো বা সিএনজিওয়ালাদের একই চরিত্র মনে হলো! তবে একটু ব্যতিক্রম হলো রেপিডো অ্যাপ রয়েছে যেটাতে বাইক-অটো, কার সহজেই মেলে এবং কেউ কেনসেল করে দেয় না। ৪০ টাকার বাইক কিংবা ৬০ টাকার অটো ভাড়া দেখালেও তারা চলে আসে রেপিডো কলিংয়ে। এই ব্যাপার দারুণ ইতিবাচক! আমি যেহেতু বাসে উঠে বসেছি কাজেই আর এসব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। আপাতত হোস্টেলে উঠতে চাই। ঢাকায় থাকতেই হোস্টেলটি বুকিং দিয়েছিলাম। অনলাইনে সার্চ করে বুকিং ডটকমে গিয়ে দেখি দারুণ একটি বাড়ি। এমন সাদা পাথরের বাড়িটিতে থাকবে কয়েকদিন ভেবেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি বাসের মধ্যে। সেই রোমাঞ্চ সাথে করেই মিনিস্টার কলোনির ইলিজিয়াম ইন বাড়িটির দিকে ছুটলাম!
উদার আকাশের দিকে তাকাচ্ছি বারবার। আর ভাবছি, ভারত কতটা সহজে, কতো স্বল্প খরচ; মাত্র ৮০০ কোটি টাকায় চাঁদে উঠে গেল! মানুষের মাঝে তেমন উল্লাসিত ধ্বনিও নেই। কতটা স্বাভাবিক ঘটনা তাই না? আমি তো আশা করেছিলাম দক্ষিণের এই শহরে চাঁদের ব্যাপক জোয়ার!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)