বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ব্যাস্ত তখনই শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যার কঠিন প্রভাব পড়ে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে।
আজ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এক বছর অতিক্রম করলো। এই এক বছরে দেশের অর্থনীতির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নানান ঝড়ঝাপটা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। মূল্যবৃদ্ধি , ডলার সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় দেশে।
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ওপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ফলে প্রত্যক্ষ প্রভাব পরে দেশের অর্থনীতিতে। মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম লাগাম ছাড়া হয়ে যায়।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুদ্ধের পর থেকে বিশ্বজুড়ে চলমান বাণিজ্য সংকোচনের কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে কারণ খাদ্য-পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ও রাশিয়া যেসব খাদ্য-পণ্য বড় আকারে রপ্তানি করে তার মধ্যে রয়েছে ভুট্টা,গম, সূর্যমুখী তেল এবং বার্লি। যুদ্ধের কারণে এসব খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহে ঘাটতি হয়। ফলে দাম অনেক বেড়ে যায়। গম সংকটের কারণে আটা-ময়দার পাশাপাশি বেকারি পণ্যের দামও হু হু করে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
যুদ্ধের প্রভাবে নাস্তানাবুদ হয় ভোজ্য-তেলের বাজারও। বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ইউক্রেন ও রাশিয়া সরবরাহ করে। বাংলাদেশে সূর্যমুখী তেল তেমন আমদানি না হলেও যুদ্ধ অন্য সব ভোজ্য-তেলের বাজারও অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
বাংলাদেশে ভোজ্য তেল হিসেবে মূলত পাম এবং সয়াবিন তেল ব্যবহার হয়। যুদ্ধের ফলে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে পাম তেল এবং সয়াবিন তেলের চাহিদা ও দাম দুটোই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল এবং এসব সারের একটি বড় অংশ আমদানি করা হয় রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। বাংলাদেশ পটাশ সারের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ১২ লাখ টনের বেশি সার আমদানি করে রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ায় দেশটি থেকে সার আমদানি করা যাচ্ছে না। যার ফলে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশে আমিষের একটি বড় চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে ফার্মের মুরগি থেকে। এই মুরগির দামও এখন চলে গেছে নাগালের বাইরে। তার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়াকে দুষছেন। দেশের পোল্ট্রি ফিড সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬% ভুট্টা সরবরাহ করে। এরমধ্যে বাংলাদেশও চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে ইউক্রেন থেকেই। যুদ্ধের কারণে যেহেতু ইউক্রেন থেকে ভুট্টা সরবরাহ আসতে পারছে না সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে মুরগি ও ডিমের দামের ওপর ।
ইউক্রেনে রুশ হামলার পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে। কারণ রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশ। মহামারী চলাকালে আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারের নীচে যুদ্ধের পরে তা ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকে। এর ফলে বাংলাদেশেও সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে ৪২.৫% থেকে ৫১.৫% বাড়ানো হয়। নতুন দর কার্যকর করা হলে গণ-পরিবহনের ভাড়াও বেড়ে যায় ।
তেলের কারণে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় একই পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বাড়তি ডলার খরচ করতে হচ্ছে অর্থাৎ আমদানি ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় রপ্তানি না বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
আবার রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেখা গিয়েছে ডলার সংকট। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের অর্ধেকের বেশি বা ৬৪% তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপের অর্থনীতিতে একটি মন্দাভাব চলে আসায় ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতায় লাগাম পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে নতুন অর্ডারের হারও কমেছে। তাছাড়া চিকিৎসা বা শিক্ষার জন্যও দেশের বাহিরে যেতে পোহাতে হচ্ছে নানান ঝামেলা।
যুদ্ধের বহুমাত্রিক প্রভাব খুব সহসাই কাটছে না। প্রধানমন্ত্রী তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হাতে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী দরকার না হলে নতুন প্রকল্পে হাত না দেয়ার নির্দেশও দেন তিনি। আসছে জুনে প্রকাশিত হবে নতুন বাজেট। তাছাড়া চলতি বছরই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখন দেখার বিষয় আসন্ন বাজেট ও নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মূল্যবৃদ্ধিকে কিভাবে সামাল দেয় সরকার।