
দেশে সাধারণত জুন মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। কিন্তু এবার মে মাসেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ অবস্থায় জ্বর হলেই দ্রুত এনএস-১ পরীক্ষা এবং বাড়তি সতর্কতা জরুরী বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রোগ প্রতিরোধে এডিস মশার নিধন, ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাইডলাইন অনুসরণের পাশাপাশি রোগ ও রোগীর অবস্থাভেদে চিকিৎসার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আজ শনিবার ৩ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিলন হলে এ সেমিনারের আয়োজন করে ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগ।
সেমিনারে বলা হয়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রথম প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গ ছিল জ্বর, কাশি, র্যাশ ও মাথাব্যথা। কিন্তু ২০২১ সালের পর ডেঙ্গুর উপসর্গ পরিবর্তন হয়। তখন ডেঙ্গুতে নতুন উপসর্গ হিসেবে যোগ হয় পেটে ব্যথা ও পাতলা পায়খানা। এটি এখনো চলছে।
২০২২ সালে ডেঙ্গুতে সর্বমোট ২৮১ জন মারা যান, যা অতীতের তুলনায় সর্বাধিক। ২০২৩ সালে ২ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৯৩ জন আক্রান্ত হন এবং মারা যান ১৩ জন। ২০২৩ সালে জানুয়ারিতে ৫৫৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন ও মে মাসে ৭৮৫ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

বক্তারা জানান, সাধারণত দেশে জুন মাসে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। কিন্তু, এবার মে মাসেই সারা দেশে সর্বাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। এজন্য এ বছর বাড়তি সতর্কতা জরুরী। জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। জ্বর হলে প্রথম দিনেই ডেঙ্গু পরীক্ষা এনএস-ওয়ান করাতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়লে পর্যাপ্ত তরল খাবার এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে। অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সময়ে অ্যাসপিরিন জাতীয় ও ব্যথার ওষুধ বন্ধ রাখতে হবে। বমি, পাতলা পায়খানা, পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট, শরীরে কোথাও রক্তপাত হলে দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট অথবা রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই উত্তম। সেজন্য মশারি ব্যবহার, বাচ্চাদের ফুল হাতা জামা পরিধান, বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সাধারণ জনগণকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বছর ৬২ হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ২৮১ জন। এ বছর জুন- জুলাই আসার আগেই আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার জন এবং এরইমধ্যে ১৩ জন মারা গেছেন, যা উদ্বেগের বিষয়। সকলকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে। ডেঙ্গুর জন্য দায়ী যে এডিস মশা, তাকে চিনতে হবে। নতুন বিল্ডিং তৈরি করার সময়, উন্নয়নমূলক কাজ করার সময় এবং বৃষ্টির পরে ছাদে পানি জমে থাকে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খালি পাত্র থাকলে তা উল্টিয়ে রাখতে হবে, যাতে পাত্রের ভেতরে পানি জমে না যায়। ডেঙ্গু হয়েছে কি না, তা জানতে জ্বর হলে শুরুতেই এনএস-ওয়ান করতে হবে এবং জ্বর হলেই অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ফলমূলসহ পানি জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। ডেঙ্গু প্রথমবার হলে মৃত্যুর হার কম, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার হলে মৃত্যুহার বেশি। যারা ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন, তাদেরকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, জ্বর হলে প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি টেস্ট এবং বার বার টেস্ট যাতে না দেওয়া হয়। ডেঙ্গু জ্বরের কারণে প্লাটিলেট কমে গেলেই রক্ত দিতে হবে, এই ধারণা ভুল। আবার রক্ত দেওয়া যাবেই না, এটাও ঠিক না। রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন, রোগীকে কী কী চিকিৎসা দিতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাজ আজাদ বলেন, ডেঙ্গু ও কোভিডে একই ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়। উভয় রোগেই জ্বর, সর্দি, কাশির লক্ষণ দেখা যায়। এজন্য জ্বর হলেই ডেঙ্গু ও কোভিড পরীক্ষা করাতে হবে। বর্তমানে পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীও অনেক পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য জ্বর হলে প্রথম দিনেই এনএস-ওয়ান টেস্ট করাতে হবে।
সেমিনারে এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশররফ হোসেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মোঃ টিটু মিয়া, অধ্যাপক ডা. এমএ জলিল চৌধুরী, বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেছা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ডেঙ্গু গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাসার প্রমুখ।
সেমিনার শেষে কেবিন ব্লকের সাধারণ জরুরী বিভাগে ডেঙ্গু কর্নারের উদ্বোধন করা হয়।