যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বেসরকারি মানবাধিকারের সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতি। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছর ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর নেতা এবং সমর্থকরা ক্ষমতাসীন দলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। সহিংসতার জন্য তারা একে অপরকে দোষারোপ করেছে। সরকারের উচিত নিরপেক্ষভাবে সহিংসতার সমস্ত ঘটনা তদন্ত করা।
গতকাল (২৬ নভেম্বর) রোববার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল; বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একটি পরিকল্পিত সমাবেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতিতে চলমান সহিংসতায় ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও আহত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র এশিয়া গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেছেন, যখন রাষ্ট্রপক্ষ অর্থাৎ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিরোধীদের কারাগার পাঠাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক অংশীদারদের সাথে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার দাবি জানিয়েছে। কূটনৈতিক অংশীদারদের স্পষ্ট করে জানানো উচিত যে সরকারের স্বৈরাচারী দমন-পীড়ন ভবিষ্যতে দেশটির অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে বিপন্ন করবে।
১৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে সাক্ষাৎকার, ভিডিও এবং পুলিশ রিপোর্টের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রমাণ পেয়েছে যে সাম্প্রতিক নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী শক্তি প্রয়োগ, নির্বিচারে গণ-গ্রেপ্তার, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। ২৮ অক্টোবরের এই সহিংসতার পর, বিএনপি ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এসময় পুলিশ, বিরোধী দলের সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
বাংলাদেশ সরকার বিরোধীদলগুলোকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করেছে এবং এই অপরাধের জন্য বিএনপি দলীয় কার্যালয়গুলো সিলগালা করেছে। গত ৫ নভেম্বর ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় বিএনপি কর্মীরা যানবাহন লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনার পর পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ কর্মীরা দোষীদের খুঁজতে আসে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনার ভিডিও অনুযায়ী, অন্তত একজন আওয়ামী লীগ কর্মী ধাতব রড হাতে নিয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বা আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে মারধরের ভয়ে রাস্তার লোকজন ভয় পায়।
আমার বাংলাদেশ পার্টির একজন মুখপাত্র হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, তাদের অনেক সমর্থক রাতের বেলা পুলিশ অভিযানের কারণে আত্মগোপনে আছে। কারাগারগুলোতে বর্তমানে বন্দির সংখ্যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি।
আটকের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের কারাগারে ৪২ হাজার বন্দী রাখার সক্ষমতা থাকলেও আমরা এতে ৯০ হাজার বন্দী রাখতে পারি। তাই এখনই কারাগারের সক্ষমতা বাড়ানোর দরকার নেই।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কয়েকজনকে মারধর ও নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একজন মহিলা তার ভাইকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে জানিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, আমি লক্ষ্য করেছি যে তার বাম হাতের একটি আঙ্গুল ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।
একজন বিএনপি কর্মী বলেছেন, তার ভাইয়ের হৃদরোগ আছে। তাকে গত ৩০ অক্টোবর পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। তাকে ১০ দিনের জন্য অজ্ঞাত আটকে রাখা হয় এবং স্বাস্থ্যের উদ্বেগের বিষয়ে তার আবেদন সত্ত্বেও তাকে মারধর করা হয়।
বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বর্ণনা, ভিডিও, ছবি এবং মিডিয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে মানবাধিকারের সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটি জানায়, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারকে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে তাদের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা বজায় রাখার জন্য জোর দেওয়া উচিত।