চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডকেই বেশি মিস করেন সাবেক জাতীয় অ্যাথলেট মিমু

KSRM

গতকাল ছিল সাবেক জাতীয় অ্যাথলেট, কোচ, সংগঠক শামীমা সাত্তার মিমুর জন্মদিন। জন্মদিনে মাঠের লড়াই-এর বন্ধুরাসহ অনেকেই তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ফোনে, কেউ কেউ কেউ সোশাল মিডিয়াতে। জন্মদিনে শুভেচ্ছা পেয়ে মিমু উল্লসিত হওয়ার চেয়ে স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়েছেন অনেক বেশি।

তারুণ্যে যখন পুরোদস্তর অ্যাথলেট ছিলেন তখনতো মাঠেও অনেক সময় জন্মদিন পালন করেছেন। কিন্তু এখন মাঠ পেরিয়ে সংসার নিয়েই বেশি ব্যস্ত। দীর্ঘ ক্রীড়া জীবন আর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গৃহেই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তবুও তার মন পড়ে থাকে সেই মাঠে, রানিং ট্র্যাকে। তবে মাঠ থেকে একদম দূরে সরে যাননি তিনি। এখনও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন আর্চারি ফেডারেশন এবং মহিলা ফুটবলের সাবকমিটির সাথে। অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনে বারো বছর ধরে সদস্যও ছিলেন তিনি। এখন আর নেই।

Bkash July

একসময়ের জাতীয় অ্যাথলেট শামীমা সাত্তার মিমুর স্প্রিন্ট, হার্ডলস, হাইজাম্প, লংজাম্প সবখানেই তার ছিল সক্রিয় ও সরব উপস্থিতি। তবে বড় বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন হাইজাম্প ইভেন্টে। জাতীয় পর্যায়ের এই ইভেন্টের লড়াই-এ টানা ষোলোবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য এক রেকর্ড রয়েছে তাঁর সাফল্যে। ৯২ সালে দীর্ঘ খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে অ্যাথলেটিক্সের লড়াই থেকে বিদায় নেন মিমু। এরপর বিটিএমসিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়ে ৯৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ৯৪ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এনএসসির কোচ ছিলেন। ২০০২ সালে বিকেএসপির উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর বিকেএসপি থেকে অবসরে যান।

আশি ও নববই-এর দশকে ক্রীড়াঙ্গনে প্রমীলা অ্যাথলেট হিসেবে মিমু ছিলেন সবার প্রিয় ও পরিচিত এক নাম। মিষ্টি চেহারার মিমুর ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে জাতীয় পর্যায়ের লড়াই-এ আগমন ঘটেছিল স্বাধীনতার পরপরই ৭৩ সালে। ঐ বছর দিনাজপুর জেলাতে অনুষ্ঠিত জেলা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, লংজাম্প এবং ট্রিপল জ্যাম্পে তিনি প্রথম হন। এরপর জেলা থেকে দিনাজপুর জেলা একাদশের পক্ষে জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে অংশগ্রহণ করার জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়। ৭৩ সালে তিনি যখন নিজ জন্মস্থান দিনাজপুর জেলা একাদশের পক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ক্ষুদে এক অ্যাথলেট হিসেবে অংশ নেন তখন তার বয়স মাত্র ১৩ বছর।

Reneta June

একেবারে কৈশোরে প্রয়াত অ্যাথলেট সুলতানা কামাল, হামিদা বেগম, শামীম আরা টলিদের কাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করে কিশোরী মিমু সেসময় নতুন আভা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে দিনাজপুরের মতো মফস্বল শহর থেকে আসা এই কিশোরী সূচনাতেই চমকে দিয়েছিলেন লং জাম্পে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এই ইভেন্টে প্রথম হয়েছিলেন অ্যাথলেট সুলতানা কামাল (৭৫ এর ১৫ আগস্ট নিহত)। দ্বিতীয় হয়েছিলেন হামিদা বেগম। একই বছরে ১০০ মিটার স্প্রিন্টারে এবং হার্ডলসে তিনি তৃতীয় অর্জন করেছিলেন। ১০০ মিটারে প্রথম হয়েছিলেন শামীম আরা টলি। দ্বিতীয় হয়েছিলেন সুলতানা কামাল ওরফে খুকী।

জাতীয় পর্যায়ে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ মিমুর শুরুটা ছিল এরকমই। অ্যাথলেটিক্সের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে তার ছিল সরব উপস্থিতি। তবে হাইজাম্পে তার একটানা ষোলোবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া এখনও জীবনের এক বড় প্রাপ্তি। আশির দশকে মিমু এবং হাইজাম্প প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল। মিমু যতদিন মাঠে ছিলেন ততদিন হাইজাম্পে তার ধারের কাছে কেউ আসতে পারেননি। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সের প্রতিটি আসরেই এই ইভেন্টে তিনি বাজিমাত করার অনন্য কৃতিত্ব দেখান। তবে ৭৯ সালে হাইজ্যাম্পে সেরা চমক দেখান তিনি। মিমু পরপর চারবার চ্যাম্পিয়ন মেরিনা খানম মেরীকে পেছনে ফেলে নতুন রেকর্ড গড়ে সে বছর চ্যাম্পিয়ন হন। শুধু রেকর্ড গড়াই নয়, প্রিয়দর্শীনি অ্যাথলেট হিসেবেও সবার মন জয় করেন তিনি। ৭৯ সাল থেকে টানা ৮৪ সাল পর্যন্ত মিমু চ্যাম্পিয়ন হয়ে এই ইভেন্টে একজন মডেল অ্যাথলেট হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই ইভেন্টে মিমু এতোটাই খবরদারিত্ব দেখান যে ৯২ সালের ২২ ডিসেম্বর ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডকে চিরবিদায় জানানোর দিনও মিমু প্রথম হয়েই বিদায় নেন। হাইজাম্প থেকে মিমু বিদায় নেওয়ার পর তার যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে আসেন সাথী পারভীন। সর্বশেষ বছরে তিনি বিটিএমসির হয়ে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের লড়াই-এ অংশগ্রহণ করেন।

খেলা থেকে অবসরের পরপরই বিটিএমসির ম্যানেজার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু অ্যাথলেট তৈরির অদম্য বাসনায় পরবর্তীতে কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। কয়েক বছর পর যোগ দেন এনএসসিতে। এনএসসির অ্যাথলেট কোচ হিসেবে তিনি দারণ দক্ষতা দেখান। অবশ্য এর আগেই ভারতের পাতিয়ালা থেকে কোচিং-এর ওপর ডিপ্লোমা সমাপ্ত করেন। উচ্চতরো প্রশিক্ষণ নেন জার্মান থেকেও। তার দক্ষ কোচিং-এর কারণেই ৯৬ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা ইসলামিক গেমসে সে সময়কার যুঁথি, ফিরোজা, নিলুফাররা কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করতে সক্ষম হন। অতঃপর টানা আট বছরের কোচিং জীবনের অবসান ঘটিয়ে মিমু দিনাজপুর বিকেএসপিতে উপ-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন ২০০২ সালের ৬ জুন।

ম্যানেজার এবং কোচ হিসেবেও তার সাফল্য অনেক। ২০১৬ সালে ভারতের গোহাটি-শিলং-এ অনুষ্ঠিত (৫ থেকে ১৬ ফেব্রয়ারি) ১২তম এসএ গেমসে তিনি বাংলাদেশ দলের মহিলা টিম ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় এই গেমস থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের যে অনন্য অর্জন ছিল সেখানে শামীমা সাত্তার মিমুর অবদান কোন অংশেই কম ছিল না। রাতদিন পরিশ্রম করে তিনি নারী অ্যাথলেটদের উজ্জীবিত ও উৎসাহিত করেছিলেন দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে। সাহস ও পরামর্শ দিয়েছিলেন সবসময়। যার ফলাফলও তিনি দেশবাসীকে সাফল্য উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই এসএস গেমস থেকে শীলা, মাবিয়ারা সেবার দেশের জন্যে যে দারুণ সাফল্য বয়ে এনেছিলেন। সেই সাফল্যের নেপথ্যের তিনি ছিলেন অন্যতম একজন।

শামীমা সাত্তার মিমু আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের এক অন্যতম সাক্ষী। নিজে মাঠে খেলেছেন, খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। মাঠ ছেড়ে যাননি, মাঠেই থেকেছেন। ফলে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিও অনেক বড়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সব ইভেন্টে কখনও খেলোয়াড়, কখনও কোচ, কখনও ম্যানেজার, জাজ হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০১৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে আর্চারি দল যে ১০টি গোল্ড পাওয়ার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব দেখায়, সে দলের মহিলা ম্যানেজার ছিলেন তিনিই। আবার ২০০৬ সাল থেকে জাম্প ইভেন্টের একমাত্র মহিলা রেফারি তিনি। বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের সাব কমিটিতে যথাযথ ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি।

মিমু মনে করেন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীর নতুন এক অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে। এই অগ্রযাত্রার সূচক হলো আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং সাফল্য প্রাপ্তি। তার মতে, নারী অ্যাথলেটরা এখন অ্যাথলেটিক্সসহ ক্রিকেট এবং ফুটবল এই তিনটি ধারাতে চমৎকার সব সাফল্য অর্জন করে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সুরভিত এবং সৌন্দর্যময় করছে। ভারতে অনুষ্ঠিত সেই এসএ গেমসের কথা মনে করে বলেন, ‘ভারতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে যে সাফল্য ছিল সেখানে মেয়েদের সামগ্রিক অবদান পঁচাত্তর ভাগ, বাদবাকি ছেলেদের। দেশের পক্ষে অর্জিত চারটি সোনার তিনটিই নিয়ে এসেছিল সেবার মেয়েরা। শিলা আর মাবিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওদের দুজনের সাফল্যই সেবার ছিল সাফ গেমসের বড় সাফল্য। মাবিয়ার চোখের জলের কথা কার না মনে আছে। সেই জলের শক্তিইতো আমাদের এক বড় প্রাপ্তি।’

মিমু আরও মনে করেন বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেককিছুই বদলে গেছে। আগের মতো শহরের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা এখন আর খেলাধুলোতে যুক্ত হতে চায় না। সেভাবে তারা আসছেও না। সেই তুলনায় প্রান্তিক পর্যায়ের পরিবারের মেয়েদের এখন খেলাধূলোর প্রতি আগ্রহ বেশি বলে প্রতীয়মান। মিমু তার অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘ তৃণমূল পরিবারের মেয়েদের মাঝে খেলাধূলো বিষয়ে আরো আগ্রহবোধ জাগাতে হলে আর্থিক সহায়তাসহ আরো বহুবিধ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত হবে। নারী অ্যাথলেটদের এগিয়ে নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে কিছু অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন। বর্তমানে নারী ফুটবল এবং নারী ক্রিকেট যেভাবে এগিয়ে গেছে সেটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বড় এক অবদান। এটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

মিমু কেবলই স্বপ্ন দেখের বাংলাদেশের মেয়েরা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আরও ভাল করছে এবং সাফল্য বয়ে আনছে। মিমু বলেন, ‘এ দেশের মেয়েদের মাঝে অসম্ভব সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। প্রতিটি মেয়েকে এগিয়ে নিতে হবে। তাঁদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েরাই পারবে এদেশকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে।’

জীবনের অনেক বেলা পেরিয়ে এসেছেন সাবেক এই মাঠ কাঁপানো অ্যাথলেট। দেশ ও বিদেশ থেকে পেয়েছেন অনেককিছু। তবে বরাবরই অ্যাথলেটিক্সকে হ্নদয় দিয়ে ভালোবাসেন। পায়ের পাতায় হাত রাখলেই যেনো ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের স্পর্শ পান। এখনও তাই খেলা তাঁকে ডাকে। খেলা বিষয়ক কোন অনুষ্ঠানে যেতে ভুল করেন না। এসব অনুষ্ঠানে অন্যরকম আনন্দ খুঁজে পান তিনি। যেখানেই যান বিনয় আর মিষ্টি হাসি দিয়ে নতুন ও তরুণদের উৎসাহিত করেন।

৬৩তম জন্মদিনে এসেও মিমু মনে করেন ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডটাকেই তিনি বেশি মিস করছেন। এই স্মৃতি তাঁর চোখ ভিজিয়ে দেয়। জীবনের চলা তো আর থেমে থাকে না। জন্মদিনের অনুভূতির কথা জানতে চাইলে বললেন, ‘সুস্থ আছি, ভালো আছি। এটিই বড় প্রাপ্তি। সুস্থ থাকলে জীবনের সব অপূর্ণতাকে তুচ্ছ মনে হয়। সুস্থ জীবন গোলাপের পাপড়ি সদৃশ। এটিই আল্লাহর বড় দান। জীবনের সামনের দিনগুলো সবার ভালোবাসা আর দোয়ায় আরও সুস্থ থাকতে চাই। সুন্দরের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

I Screen Ami k Tumi
Labaid
Bellow Post-Green View