গল্প বলা আর লেখার মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে মনোযোগী, প্রিয় শ্রোতার সামনে আমরা যত অনায়াসে বলে যেতে পারি, লিখতে গেলে সেই স্রোত থাকে না। কিন্তু উম্মে ফারহানার ‘ফওজিয়ার আম্মা ও অন্যরা’ (২০২২) এই দৃঢ় বিশ্বাসকে একটু হলেও নাড়া দেয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাধাহীন বয়ে চলা ঢেউয়ের মতো গল্পগুলো আমাদের একে একে নিয়ে যায় পরিচিত সব ঘর, পথ আর সময়ের গলির ভেতর। পড়তে পড়তে মনে হয় চরিত্রগুলো চারপাশের চেনা জগত থেকে উঠে এসে আবার আশেপাশের বাতাসেই মিশে যাচ্ছে।
এই বইয়ের প্রথম গল্প “কড়ইঅশোক”। শুরু হয় কথকের সরল একটা আলাপ দিয়ে। সে সরাসরি কথা বলছে পাঠকের সাথে। যেন সামনাসামনি বসে বলা কাহিনি, মাঝে মাঝে উঁকি দেয় রবীন্দ্রসংগীত বা জনপ্রিয় সিনেমার গানের দুই লাইন। আবার, “দর্জির দোকান” গল্পের চরিত্রগুলো, সাইদ, শ্যামল বা পিয়া — সবাইকে মনে হয় পাশের বাড়ির লোক। উম্মে ফারহানার মাধ্যমে তাদের আমরা নতুন করে চিনি। তাদের মন খুঁড়ে খুব গোপন কোন ‘ডিজায়ার’ বা অপরাধবোধকে তিনি যখন আলাপের ছলে তুলে এনে আমাদের সামনে মেলে ধরেন, আমাদের বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না।
ভাষার ক্ষেত্রেও এই গল্পগুলো অনন্য। শিরোনাম, বর্ণনা বা সংলাপগুলোকে ঠিক বইয়ের ভাষা মনে হয় না। ফলে অনায়াসেই পাঠকের সাথে যোগাযোগ তৈরি করে ফেলে কথক আর চরিত্রগুলো। ‘পপুলার কালচার’ এবং কখনও কখনও ‘হাই কালচারে’র রেফারেন্স এই যোগাযোগে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে।
বইয়ের তৃতীয় গল্প “ঘুম” নিয়ে আমি বিশেষ করে বলতে চাই। এতো ‘কমন’ শিরোনামের একটা গল্প কতদূর নিয়ে যেতে পারে পাঠককে, একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে আশা করি। “যখন আমি ঘুমাই— আমার শরীরের একেকটা অংশ এক এক কইরা ঘুমায়া পড়ে। শুরুটা হয় পা থাইকা, পায়ের আঙুল থাইকা গোড়ালি ধীরে ধীরে হাঁটুর দিকে গড়ায়া গড়ায়া আসে। আমি টের পাই ঘুম আগায়া আসতেছে।”
গল্পের এই কাতর শুরুটুকু আমি যখন প্রথম পড়েছিলাম, আমার তখন কোনভাবেই ঘুম ঘুম লাগার কথা না। যথেষ্ট চনমনে শরীর আর মন নিয়ে পড়তে বসার পর মনে হচ্ছিল ঘুম আসলে একটা মানুষ, তার দায়িত্ব আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে হাত বুলিয়ে দেয়া। এবং পরক্ষণেই মনে হলো ঘুম আসলে একটা পোকা। সে পা থেকে বেয়ে বেয়ে মাথায় উঠে যাবে। আমার নিজের শরীরেও একটা রি রি করা অনুভূতি টের পেলাম।
এই গল্পের আরেকটা বড় আকর্ষণ বুলবুল। উম্মে ফারহানার প্রথম গল্প সংকলনের একটা সমালোচনা আমি প্রায়ই করতাম যে পুরুষ চরিত্রগুলোতে বৈচিত্র্য কম। এইবার আর সেই সুযোগ থাকছে না। এই এক বুলবুল চরিত্র একাই এতো বেশি বিচিত্র যে তার মৃত্যু বিশাল একটা শূন্যতা তৈরি করে। গল্প শেষ করে মনে হয়েছে বুলবুলের মৃত্যু আসলে সমস্ত ঘুম একাকার করে তৈরি হওয়া বিষণ্ণতা এবং মায়া।
“দরজা” উল্লেখ করার মতো আরেকটা অনবদ্য গল্প। এর চরিত্রায়ন আর ন্যারেটিভ টেকনিক একটা ঘোর তৈরি করে। আপাত গুরুত্বহীন একটা প্রসঙ্গ চলতে চলতে জীবন, মৃত্যু আর আত্মহত্যার মতো কঠিন বিষয়কে ছুঁয়ে পৌঁছে যায় শেষ সীমানায়। ছাদের উপর আকাশ তখন “নীল কমলা আকাশি আর সোনালি মিলে নেশা ধরানো একটা দৃশ্য”। পাঠকের মনেও তখন একটা ছায়া পড়ে। নেশায় ডুব দিয়ে পড়তে হয় পরের অংশটুকু।
“আমার মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক বাদুড় উড়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করে পড়তে শুরু করি, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইউল কাইউম।’”
“জিজ্ঞাসাবাদ” গল্পটা এসে এক পর্যায়ে পুরো বইয়ের স্বাদ বদলে দেয়। কম বিবরণ দেয়া থ্রিলার। সংলাপের মধ্য দিয়েই সাসপেন্স এগিয়ে চলে। অপরাধ আর তদন্তের দোলাচলে একটা ভিন্নরকম সংকটের সাথে পরিচয় ঘটে।
“ফওজিয়ার আম্মা” গল্পের মুখ্য ব্যক্তি রুখসানাকে নিয়ে বলাটা কঠিন, অনেকগুলো ‘লেয়ার’ আছে তার গল্পে। তার চরিত্রকে আমরা প্রথমে দেখি বেড়ে উঠছে এমন একজন কিশোরীর ‘ইনোসেন্সে’র মধ্য দিয়ে। পরিণত হয়ে সেই কথকই পুরুষতন্ত্র আর কড়া জাতীয়তাবাদের মিশেলে তৈরি হওয়া পরিচয়ের রাজনীতিকে নির্দেশ করে, রুখসানা যেখানে ‘আদার’ বা অপর। নাম গল্প বাদেও এই বইয়ে আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ মায়ের দেখা মেলে। শিরোনাম রবীন্দ্রনাথ থেকে নেয়া, “আর কারো মা হলে”। পুরো গল্পটা আসলে মায়ের কাছে লেখা মেয়ের চিঠি। সম্পর্কের অজস্র জটিলটা আর মোহ উঠে আসে এই এক চিঠিতেই। যোগাযোগহীন গভীরতম সম্পর্কের একমুখী বয়ানে কত কত যে সূক্ষ্ণ বিষয় উঠে আসে! ‘হাকিমপুরি জর্দার গন্ধ’, ‘ লালবাগের হাঁসমার্কা তেল’ থেকে শুরু করে ধর্ম, দেহ, দর্শন, রূপকথা — একটা জীবন ঘিরে থাকা নানারকমের প্রসঙ্গ। আবেগ, স্মৃতি আর যুক্তির অনিবার্য সংকট, সংঘর্ষ আস্তে আস্তে মূর্ত হয়ে ওঠে।
লেখকের নিজের দাবি এই বইয়ের গল্পগুলো তিনি লিখেছেন সব চেনা মানুষদেরকে নিয়ে, সচরাচর ঘটতে থাকা ঘটনা তাঁর মূল উপজীব্য। কিন্তু পর্যবেক্ষণের যে গভীরতা, অনুভবের যে স্বত:স্ফূর্ততা গল্পগুলোতে প্রকাশ পায়— এই অতি পরিচিত মানুষ, দৈনন্দিন ঘটনাগুলো আলো আর অন্ধকারের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকে, আবছা ইশারায় বারবার আগ্রহ জাগিয়ে তোলে।
‘ফওজিয়ার আম্মা ও অন্যরা’ লেখক: উম্মে ফাহানা প্রকাশক: ঐতিহ্য। প্রকাশকাল: মার্চ ২০২২। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৩৬। মূল্য ২৭০ টাকা
লেখক পরিচিতি:
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
কবি, গল্পকার ও শিক্ষক