চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ফকির আলমগীর: শোকগাঁথা

ফরিদুর রেজা সাগর-এর বই 'প্রিয় মানুষ' থেকে

১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। তখন সঙ্গীতের এক বিশেষ ধারা পপ সঙ্গীত তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একদল নবীন শিল্পী তখন পপগান গাইছে। ওদের গান তখন মানুষের মুখে মুখে। প্রচণ্ড জনপ্রিয়। এই নতুন ধারার গান, নতুন জাগরণ তুলল আমাদের সঙ্গীত জগতে। স্কুল কলেজ ও হলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চ, বেতার ও টেলিভিশনে পপ শিল্পীদের উপস্থিতি নিয়মিত। সেই সময় আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছোটদের প্রচুর অনুষ্ঠান করে থাকি। প্রযোজক ছিলেন বিখ্যাত কাজী কাইয়ুম। অসম্ভব মেধাবী প্রযোজক। ছোটদের জন্য বহু অনুষ্ঠান তিনি প্রযোজনা করেছেন। সেইসব অনুষ্ঠান এখন ইতিহাস হয়ে আছে। নাচ গানের পরিবেশনা ছাড়াও পাপেট শো, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি এমনকি নতুন কুঁড়িরও প্রযোজক তিনি। সেই সময় কাজী কাইয়ুম একদিন আমাকে বললেন, সাগর-পপগান তো এখন খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। এই গানগুলো নিয়ে ছোটদের জন্য কোনো অনুষ্ঠান করা যায় কিনা দ্যাখো তো।

আমি সবিনয়ে বললাম, ছোটরা কি পপগান গাইবে? কেমন লাগবে ওদের কণ্ঠে?

কাজী কাইয়ুম স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ছোটরা কেন গাইবে? পপগানের শিল্পীরাই পপ গান গাইবে। ছোটদের অনুষ্ঠানে বয়স্ক শিল্পীরা অংশ নিতে পারবে না এমন তো কথা নেই।কাজী কাইয়ুমের পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠান নির্মাণে তৎপর হয়ে উঠলাম। সেই অনুষ্ঠানে পাঁচজন শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। একজন শিল্পীর নাম এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে করতে পারছি না। বাকি চারজন হলেন, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই এবং ফকির আলমগীর। সেই বিশেষ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের আগে ফকির আলমগীর ছোটদের উদ্দেশ্যে বললেন, আমরা ভিন্নধারার গান করে থাকি। এই গানগুলো খুব জনপ্রিয় অর্থাৎ পপুলার। পপুলার শব্দটার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো পপ। সে কারণে আমরা আমাদের গানকে বলি পপগান।

ফকির আলমগীরের কথাটা আমার খুব মনে ধরে। সারাজীবন সেটা মনে গেঁথে আছে। ফকির আলমগীর বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়। তাকে অগ্রজদের মতোই সম্মান দিতাম। কিন্তু তিনি ছিলেন বন্ধু ভাইসব। পঞ্চাশ বছর ধরে তার সঙ্গে সম্পর্ক। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের বাইরেও বহুবার, বহু জায়গায় বহুভাবে তার সঙ্গে সময় কেটেছে। ঢাকা, ঢাকার বাইরে, বিদেশে কত মধুর স্মৃতি তার সঙ্গে। একেবারেই মাটির মানুষ ছিলেন তিনি। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারতেন। হাটে মাঠে ঘাটে সবখানেই গান গাইতেন। তাই তিনি হয়ে উঠলেন গণশিল্পীর প্রতীক। মুকুন্দ দাশ, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ধারায় ফকির আলমগীর নিজেকে বদলে ফেললেন। বাংলাদেশের যে কোনো গণ-আন্দোলন ফকির আলমগীরের পরিবেশনা ছাড়া অসমাপ্ত থেকে যেত।

গত দুই যুগ ধরে ফকির আলমগীর বারবার নিজেকে বদলে ফেলেছেন। ও সখিনা গেছস কিনা, মায়ের একধার দুধের দাম- এই ধরনের গান গেয়ে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের সঙ্গীত ভুবনে ঋষিজের অবদান বিশাল। পয়লা বৈশাখের সকালে শিশুপার্কের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তারা আয়োজন করত বর্ষবরণ। ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে শুরু হতো ফকির আলমগীরের নেতৃত্বে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। বর্ষবরণের এই ধারায় ঋষিজও এখন ইতিহাস। পহেলা মে মানেই ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনা। ফকির আলমগীরের দরাজ কণ্ঠস্বরে মেহনতি মানুষের পক্ষে সঙ্গীত পরিবেশন।

দেশপ্রেম, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে থাকবেন সবার মধ্যে। অনেক কাজ করতেন তিনি। কিন্তু কখনোই তার মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিল না। তিনি সাধারণ মানুষের মতো মেলামেশা করতেন। যে কোনো সমালোচনাকে তিনি সহজভাবে নিতে পারতেন। মানুষের ভালোবাসা ছিল তার শক্তি।

অনেকের হয়তো জানা নেই যে, তিনি ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। দীর্ঘসময় তিনি চাকরি করেছেন বাংলাদেশ কেমিকেল কর্পোরেশনে।

খুব অস্থির ও ছটফটে ছিলেন নতুন কিছু করার জন্য। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, চে’গুয়েভারা, নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন কিংবা মে দিবস- এইসব বিশেষ দিবস মানেই ফকির আলমগীর। তিনি গান গেয়ে এইসব দিনগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চে তার গান অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এ এক অসাধারণ সাফল্য। আমি প্রায়শ ঠাট্টা করে বলতাম, ফকির ভাই এ বছর কয়বার নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন পালন করলেন?

ফকির ভাই হো হো করে প্রাণখুলে হাসতেন। এসব ঠাট্টা তিনি কখনোই গায়ে মাখতেন না। নিজের কাজের প্রতি ছিল তার অসীম নিষ্ঠা ও অবাধ আস্থা। চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। যখন যেটা ইচ্ছা হতো সেই অনুষ্ঠানই তিনি নির্মাণ করেছেন চ্যানেল আইয়ের জন্য। গান দিয়ে শুরু, বিশেষ দিনের সঙ্গীত, বিজয় মেলা- নিজের অনুষ্ঠান মনে করে নিজেই শিডিউল করে নিজের মতো অংশ নিতেন। তার ছোটভাই ফকির সিরাজ সবসময় আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। চ্যানেল আইয়ের আর্কাইভে ফকির আলমগীরের কত গান যে সংগ্রহ করা আছে তার হিসাব নেই!
নিজের কাজের ব্যাপারে খুব আস্থাবান ছিলেন তিনি। তাই স্মৃতিকথা ধরনের বেশ কয়েকটা বইও লিখেছেন। তিনি ছিলেন জীবন্ত আর্কাইভ। তার স্মৃতিতে ছিল অসংখ্য ঘটনা। অনর্গল গল্প করতে পারতেন। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো ফকির আলমগীরকে দেখে কিন্তু বোঝার উপায় নেই, তিনি কতটা গোছানো জীবন যাপন করতেন। পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া কিছুই করতেন না। ফকির আলমগীরের মতো শিল্পী দুই বাংলাতেই বিরল। তিনি আর গান গাইবেন না, এ কথা ভাবতেই পারছি না।