শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন সিনেটর। চিঠিতে প্রফেসর ইউনূসকে বিদ্যমান হয়রানি বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, কমপক্ষে এক দশক ধরে বাংলাদেশে অন্তত ১৫০টি অপ্রমাণিত বিষয়ে মামলা করা হয়েছে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে।
উল্লেখ্য, চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে যুক্তরাষ্ট্র। এই সম্পর্কে আছে ঘনিষ্ঠ দ্বিপক্ষীয় এবং অভিন্ন স্বার্থের বিষয়ে বহুজাতিক সহযোগিতা। একটি দেশের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দেওয়া একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকির শামিল। তাছাড়া, দ্বাদশ নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই মামলার রায় প্রদানের একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পরে সরকারের কাছে ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি পাঠানোর ঘটনাটিকে বেশ কিছু কারণের মধ্য দিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত: কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে তথা বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার কি সিনেটরদের রয়েছে? এখানে সিনেটরদের যোগ্যতা এবং বিশ্লেষণের মাপকাঠি নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করার অবকাশ পাবে। সিনেটরগণ কি আদতেই মানুষের মানবাধিকারের চর্চা করেন? এ ধরনের বহু প্রশ্ন এখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে ঘুরপাক খাবে। সম্মানিত পাঠক আপনারাই চিন্তা করুন যেখানে ফিলিস্তিনের গাজায় আমেরিকার সরাসরি মদদে নিরীহ শিশু এবং নারীদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে সেখানে নারী ও শিশুদের রক্ষায় সিনেটরদের কোন বিবৃতি কারোর চোখে পড়ছে না। অর্থাৎ আমেরিকার সরকারের ন্যায় তাদের ভূমিকা, কাজেই সিনেটরদের প্রকৃত বিবেচনাবোধ কতটুকু তা প্রকৃতপক্ষে গাজায় নিহত শিশু ও নারীদের পরিসংখানই সাক্ষ্য দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার বিপক্ষে ইসরাঈলের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দানেও সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে কেন সিনেটরদের কোন বার্তা আমরা দেখছি না? তাহলে সিনেটরগণ কোথায়, কীভাবে, কোন উদ্দেশ্যে ভূমিকা পালন করেন সেটি কিন্তু একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়। বলা যায়, একটি বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তারা ড. ইউনূসের মামলার রায়ের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেই সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এটি প্রকারান্তরে দেশের সার্বভৌমত্বের উপর প্রচ্ছন্ন হুমকি।
দ্বিতীয়ত: একটা সময়ে আমেরিকার সিনেটরদের পাঠানো বিবৃতি একটি অর্থবহ বার্তা বহন করলেও বর্তমানে সিনেটরদের অবিবেচনাপ্রসূত বার্তা মর্যাদা হারিয়েছে। কেননা বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, সিনেটরদের অনেকেই প্রয়োজনে লবিষ্ট হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে থাকে কার্যোদ্ধার করার নিমিত্তে। যখন কোন কারণে কার্যোদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে পড়ে তখন যাদের জন্য কাজটি সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তখন তারা উক্ত ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করে থাকে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে সঙ্গত কারণেই সিনেটরদের বার্তা দেখলেই মানুষের মনে এক ধরনের দ্বিধা ও শঙ্কার আবির্ভাব ঘটে থাকে এবং ব্যাপারগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত।
তৃতীয়ত: গুরুত্ব বিবেচনায় সিনেটরগণ বার্তা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছেন কিংবা নিজেরা ইচ্ছে করেই স্বার্থের সন্ধানে যেখানে প্রয়োজন মনে করছেন সেখানে বার্তা প্রদান করছেন এবং যেখানে প্রকৃতই প্রয়োজন সেখানে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করছেন। মানবাধিকার ইস্যুতে যেখানে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন সেখান নির্বিকার থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যেখানে স্বার্থ হাসিলে ব্যর্থ সেখানে বার্তা প্রদান করে দায়িত্ব পালনের নমুনা দেখিয়ে যাচ্ছে আমেরিকার সিনেটরগণ।
চতুর্থত: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমেরিকার ভূমিকা বিশেষ করে আমেরিকার কূটনীতিকের রাজনীতিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে সারা দেশের মানুষ অবগত। যেহেতু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আমেরিকা প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সে জায়গায় অন্য প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উপর একটি চাপ সৃষ্টির হেতু ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে সিনেটরদের বার্তা প্রেরণের ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে। যদিও ড. ইউনূসের মামলার রায় আদালতে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেখানে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমেই বিজ্ঞ বিচারক শ্রম আইনের মাধ্যমে রায় ঘোষণা করেছেন। কাজেই একটি নিষ্পত্তিকৃত মামলার রায়কে ঘিরে আমেরিকার সিনেটরদের বার্তার উদ্দেশ্য পূর্বপরিকল্পনার অংশবিশেষ।
পঞ্চমত: রাজনীতির মেরুকরণের কারণে বাংলাদেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল হিসেবে সিনেটরদের এ বার্তাটি আসতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ এমন একটি পর্যায়ে নিজেদের নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে যেখানে বাংলাদেশকে কৌশলের অংশ হিসেবে সবাই পাশে রাখতে চায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে রাখতে চায়। তারই অংশ হিসেবে সিনেটরদের এ বার্তা প্রেরিত হয়ে থাকতে পারে।
ষষ্ঠত: আমেরিকাতে সিনেটরদের সঙ্গে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ব্যাপারে সরকারকে অবগত করানোর লক্ষ্যেই সিনেটরদের প্রদত্ত বার্তা আসতে পারে। পরিশেষে এ ইস্যূতে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার অপকৌশল হিসেবে সিনেটরদের পক্ষ থেকে এ ধরনের বার্তা আসার নমুনায়ন পরিলক্ষিত হতে পারে। তাছাড়া নির্বাচনের মাঠে পরাজিত গোষ্ঠীরা যারা নির্বাচনকে বানচাল করতে চেয়েছিল তারাই ইউনূস ইস্যূতে রাজনীতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবার অপপ্রয়াস হিসেবে মীমাংসিত ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের মাধ্যমে বার্তা প্রদান করিয়েছে। এখন যে বিষয়টি আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে সেটি হচ্ছে সিনেটরদের বার্তার উপযোগিতা কতটুকু? স্বাভাবিকভাবে এ দেশের জনগণ এ বিশেষ বার্তাটিকে গ্রহণ করবে না। কেননা বাংলাদেশের শ্রম আদালতে সকল ধরনের নিয়ম-কানুন, শুনানি, যাচাই-বাছাই বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির রায় প্রদান করেন বিজ্ঞ আদালত। সে জায়গায় বাংলাদেশের আদালতকে খাটো করে এমন বিবৃতি প্রদান এ দেশের জনসাধারণ গ্রহণ করবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তপ্ত করার লক্ষ্যে কোন ইস্যু না থাকায় ড. ইউনূস ইস্যুকে বেছে নিয়েছে সিনেটরগণ।
আমি মনে করি আমেরিকার সিনেটে বর্তমানে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের প্রত্যেকের উচিত হবে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করে দায়িত্ব পালন করা। পুরো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ যেখানে চাচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে বিরতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সেখানে আমেরিকার হস্তক্ষেপে যুদ্ধ এখনো চলমান এবং কবে নাগাদ শেষ হবে তার কোন সদুত্তর কারো কাছে নেই। অথচ পুরো পৃথিবীকে অশান্ত ও উত্তপ্ত করে তোলার ক্ষেত্রে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের বিভীষিকা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সিনেটরদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিষ্পত্তিতে কাজ করা উচিত, সেখানে তারা কোন ভূমিকা পালন না করেই বাংলাদেশে শ্রম আদালতে ঘোষিত ৬ মাসের জেলহাজতের বিপরীতে জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত ড. ইউনূসের ইস্যূতে বিবৃতি প্রদান করে সিনেটরদের গ্রহণযোগ্যতাকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। আমরা মনে করি সিনেটরদের উচিত ইসরায়েলের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বার্তা প্রদান করা যাতে অনতিবিলম্বে আমেরিকার সরকার ইসরায়েলের ওপর থেকে সকল ধরনের সমর্থন প্রত্যাহার করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)