বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি ধারা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি যেমনভাবে রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে রয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিদের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাবার সুযোগ করে দিয়েছে ৭৫ পরবর্তী রাজনীতি।
আবার একটি পক্ষই রয়েছে যারা কেবলমাত্র ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার বাসনা থেকে রাজনীতিতে রয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে বিদেশী শক্তির যোগসূত্রতা রয়েছে। ভিন্ন পক্ষও রয়েছে যারা জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে রাজনীতিতে ত্যাগের মুখোমুখি হয়েছেন, জেল-জুলুম খেটেছেন, রাজনীতির জন্য নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ইতিহাস সকল কিছুর স্বাক্ষী এবং জনগনও ইতিহাসের ভাবধারায় রাজনীতিবিদদের মূল্যায়ন করে থাকেন। আবার নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির বিভিন্ন পট পরিবর্তন, জোট-উপজোটের ঘটনাও দেখা যায়। আবার নির্বাচন এলে বিদেশী শক্তির একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখা গেলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতগণ প্রকাশ্যে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছিল। অনেকেই বলে থাকেন, বিএনপির বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা স্বত্ত্বেও বিদেশ নির্ভরতার কারণে দলটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দলের নেতাকর্মীর চেয়ে বিদেশীদের দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হওয়ার কারণে দলটি নানা ধরনের প্রশ্নের সন্মুখীন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
সম্প্রতি মিয়ানমারের মধ্যকার অভ্যন্তরীন সংঘর্ষের কারণে বিএনপির নেতাদের বক্তব্য নিয়ে কূটনৈতিক মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক উপস্থাপন করে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে মনে হয়েছে কোন একটি দেশের ইন্ধনে মূলত তারা সরকারকে দায়ী করে বক্তব্য প্রদান করছে। অথচ এ রকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল দায়িত্বশীলতার পরিচয় প্রদান করা, পরিস্থিতিকে পর্যালোচনা করে দক্ষতার সঙ্গে বিবৃতি প্রদান করা। কিন্তু দেখা গেল সরকারকে দোষারোপ করার জন্যই মূলত বিএনপি কূটনৈতিক ভাষা লঙ্ঘন করে বিবৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ বিএনপির এ ধরনের ভাষা ব্যবহারকে সীমা লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। তারা মনে করছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দের এ ধরনের বক্তব্য প্রদান রাজনৈতিক বিরোধিতার অংশ।
বিএনপির রাজনীতির বিদেশ নির্ভরতা দলটিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বলতে গেলে বিএনপির অতিমাত্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রাজনীতির গতিপথ দলটিকে মারাত্মক সংকটে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ দেবে সেই চাপে সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিবে আর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এমন একটি সহজ সরল দিবাস্বপ্নের হিসেব-নিকেশই বিএনপি ঘোরের মধ্যে ছিল। বিএনপির রাজনীতিতে এখন মার্কিন নির্ভরতা স্পষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সরকারকে চাপে ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পতন ঘটাবে এমন একটি আভাস বিএনপি নেতারা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের তারা হিসাবের বাইরে রেখে বিদেশীদের উপর ধরনা দিয়ে দল পরিচালনা করেছেন বলেই নেতাকর্মীরা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। পাকিস্তানের ইমরান খানের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নির্বাচনের ফলাফল দেখে বিএনপি শিক্ষা নিতে পারে।
বিভিন্ন গনমাধ্যমে এসেছে সরকারকে চাপে ফেলার লক্ষ্যে বিএনপি বিদেশে লবিষ্ট নিয়োগ করে সরকারকে চাপে ফেলার পায়তারা করেছে। অথচ দেশে কোনরূপ কার্যাকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মূল কথা হচ্ছে বিএনপি তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে দলীয় কর্মী সমর্থক ও নেতাদের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি। তাছাড়া সংবিধানের মাধ্যমে একটি স্বত:সিদ্ধ বিষয়ের ব্যাপারে বিএনপির অহেতুক আন্দোলন দলের সমর্থনকারীদের মধ্যেও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চেয়েছিল কিন্তু দল থেকে বহিস্কারের ভয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থেকেছে। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তকে বিএনপির নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া বিএনপির যারা নেতৃস্থানীয় শীর্ষ নেতৃত্ব রয়েছেন তারা কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থির থাকতে পারেন না। দেখা যায়, সকালে সিনিয়র নেতারা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু বিকালে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। কেননা বিএনপির মূল সিদ্ধান্ত আসে বিদেশ থেকে মানে লন্ডন থেকে। এ ব্যাপারগুলো বিএনপির সাধারণ সমর্থকগণ মনে প্রাণে মেনে নিতে পারছেন না বিধায় বিএনপির আহবানে তারা সাড়া প্রদান করছেন না। সঙ্গত কারণেই দলের ঘোষিত আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির তৃণমূলের সাড়া মেলেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করার পরপর বিএনপি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ লক্ষ্য করা গেছে। তারা মনে করেছিল এই ভিসানীতির ফলে সরকারের উপর স্যাংশন চলে আসবে এবং তাদের ক্ষমতায় আসার রাস্তা অনেকটা পরিস্কার হয়ে যাবে। অনেকেই বলেছেন, সরকার পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের দরকার হবে না, যা করার যুক্তরাষ্ট্রই করে দিবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ কোনভাবেই মেনে নেওয়ার অবকাশ নেই। বাংলাদেশের সক্ষমতা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় শক্তিশালী হয়েছে বিধায় বাংলাদেশের উপর কারোর হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নাই। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছিল তারা বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে; সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে।
একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান শক্তি হলো জনগণ। কিন্তু বিএনপি এখন জনগণের শক্তির ওপর কতটা নির্ভরশীল সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ নির্বাচন পেরিয়ে গেলেও বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেনি, দলটি বিবৃতি প্রদান করেই ক্ষান্ত। বিবৃতিতে দেখা যায় কেবলমাত্র বিরোধিতার জন্য বিবৃতি প্রদান করে থাকে। বিএনপি প্রায় প্রতিদিনই একদফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে সরকার পতনের কথা বলছে। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে, গণআন্দোলন গড়ে তুলবে ইত্যাদি কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট। বাস্তবে তারা পুরোপুরিভাবে তাকিয়ে আছে বহির্বিশ্বের দিকে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। তারা মনে করেছিল বিদেশী শক্তি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অলৌকিকভাবে হলেও তাদের জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু সেটিকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দিয়েছে এ দেশের জনগণ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা এ দেশের মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিকভাবে সবার মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরি হয়েছে, দেশের কর্তৃত্ব কেউই অন্যের উপর হস্তান্তর করতে চায়নি, এটি জনগণ বুঝলেও বিএনপির নেতৃত্ব বুঝতে পারেনি। সে কারণেই এ দেশের রাজনীতি দলটির জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যাদের জন্য রাজনীতি প্রকৃতঅর্থে তাদেরকে একীভূত না করে রাজনৈতিক বৈতরণী পার হওয়া অসম্ভব। সে জায়গা থেকে বিএনপি বার বার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপরিপক্কতার পরিচয় দিচ্ছে।
অনেক সিনিয়র নেতৃত্ব দল ছেড়ে দিয়ে অবসরে চলে গেছেন, অনেকেই দলে নামমাত্র থাকলেও আড়ালে থাকছেন কর্মসূচিতে। নির্বাচন এলেও দলটিতে নানা সমীকরণের ভিত্তিতে মেরুকরণ হয়ে থাকে। তাছাড়া দলের কমিটি প্রদানের ক্ষেত্রেও দলের মধ্যে স্পষ্ট বিভেদ লক্ষ্য করা যায়। দল অন্তপ্রাণ কর্মীর তুলনায় ব্যক্তিগত পছন্দের কর্মীর মূল্যায়ন হওয়ায় দলটিতে তৃণমূলের আস্থা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ফিলিস্তিনে ইসরাঈলের অবর্ণণীয় অত্যাচারের পরেও বিএনপি মুখে কুলুপ এঁটেছিল কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর ভয়ে। কিন্তু দলটি এ প্রেক্ষাপটে এ দেশের জনগণের সমর্থন হারিয়েছে। পাশাপাশি দলের কৌশল নির্ধারণে বিদেশীদের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা তৃণমূলে দলের গ্রহণযোগ্যতাকে তলানিতে নিয়ে এসেছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)