পূর্ব বাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) টেলিভিশনের আগমন ঘটে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় EPTV নামে। প্রথমে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে। জাপানের সহযোগিতায়। প্রথম আবির্ভাবে বাজিমাত। অবাক বিস্ময়ে ঢাকার বিত্তবানরা ও তাদের বাসায় জড়ো হওয়া আশেপাশের প্রতিবেশীরা দেখলো সাদাকালো পর্দার টেলিভিশনে মানুষের উপস্থিতি। সঙ্গীত, নাটক ও শিশুদের অনুষ্ঠান ও সংবাদে মুখরিত ছোট্ট একটি পর্দা। খবরের কাগজে নয়, সিনেমা হলে গমন করে নয়, বাসায় বসে নিশ্চিন্তে বিনোদিত ও দেশ-বিদেশের সংবাদ জানার পরিসর তৈরী হলো। সময়টি বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। উত্তাল সেই ৬০-এর দশকে একদল সংস্কৃতিবান সৃষ্টিশীল দেশপ্রেমিক মানুষ নতুন এই টেলিভিশনে যোগদান করেছিলো। তাদের পরিশ্রম ও মেধার মিশ্রণে বাঙলা ও বাঙালির সংস্কৃতি নতুনভাবে চলমান আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে। একদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি স্বদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তি আন্দোলনরত জনগণ অন্যদিকে শহীদ মিনার, টেলিভিশন ও মঞ্চকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্পী ও নতুন শিল্পের উদ্ভব ঘটতে থাকে। এই সময় একদল শিশু-কিশোরদের আমরা টেলিভিশন পর্দায় নানা অনুষ্ঠানে দেখতে পাই। তাদের মধ্যে ফরিদুর রেজা সাগরকে দেখতে পেতাম।
১৯৭১’র মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর আহবানে অসহযোগ আন্দোলনকালে টেলিভিশন শিল্পী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানী শাসনমুক্ত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে বাংলাদেশ টেলিভিশন যাত্রা শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। সংবাদ, নাটক, নৃত্য, স্বদেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের গানে ভরপুর বাংলাদেশ টেলিভিশন। সে এক আনন্দ উন্মাদনার সময়। দেশ গড়ার দৃপ্ত শপথে আগুয়ান হওয়ার আহবান টেলিভিশন পর্দায়।
তার অল্প ক’দিন পর ঘটে গেল বিশ্ব ইতিহাসের নির্মমতম হত্যকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্য করা হলো। বেঁচে গেল তার দু’কন্যা। বদলে গেল বাংলাদেশের প্রশাসন-রাজনীতি-সংস্কৃতি ও সম্প্রচার নীতিমালা। সেনাশাসন-স্বৈরশাসনে সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলো। কিন্তু এর মাঝেই বাংলাদেশ টেলিভিশন বিকশিত হতে থাকে। নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন আমলে ১৯৯৭ সালে প্রথম এটিএন বাংলা নামে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আগমন ঘটে। তারপরই ১৯৯৯ সালে হৃদয়ে বাংলাদেশ শ্লোগান নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে চ্যানেল আই। আজ ১ অক্টোবর ২০২২ চ্যানেল আই ২৪ বছর পদার্পণ করছে। আজ চ্যানেল আই সারাবিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে প্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল।
চ্যানেল আই প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা শিশুসাহিত্যিক ও উপস্থাপক ফরিদুর রেজা সাগরের নেতৃত্বে ইমপ্রেস গ্রুপ। সাগরের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু শাইখ সিরাজ সঙ্গী হয় এই স্বপ্নযাত্রায়। আরো জড়িত হয় ইমপ্রেসের আবদুর রশিদ মজুমদার, মুকিত মজুমদার বাবু, জহিরউদ্দিন মাহমুদ মামুন, এনায়েত হোসেন সিরাজ, রিয়াজ আহমেদ খান। মূলত ফরিদুর রেজা সাগরের অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, জনসংযোগ ও সৃষ্টিশীল মন এবং শাইখ সিরাজের কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান ও সংবাদ নির্মাণ-কৌশল চ্যানেল আই’র সাফল্যের প্রধানতম উপাদান।
১৯৯৯ এ ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী’র একটি আবাসনে ছোট্ট ৪টি ফ্ল্যাটে চ্যানেল আই’র যাত্রা শুরু। অপরিসর অফিস ও স্টুডিও প্রথম দর্শনে অপেশাদারি মনে হতো অনেকের। কিন্তু চ্যানেল আই’র প্রত্যয়ী কর্মীদল সাগরের নেতৃত্বে আস্থা রেখে অনুষ্ঠান নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করে চমৎকার সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে দর্শকের মন জয় করে নেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকায় নির্মিত অনুষ্ঠান ক্যাসেটবন্দী করে প্রতিদিন সিঙ্গাপুরে বিমানে করে পাঠিয়ে সেখান থেকে এশিয়া সেট স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে দর্শকের জন্য সম্প্রচার করা হতো। একবার ভেবে দেখুন প্রিয় পাঠক কী ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল পুরো প্রক্রিয়া। যদি বিমান বিলম্ব করে বা যদি ফ্লাইট মিস করে তবে কী হতে পারতো। প্রারম্ভিক কষ্ট ও পরিশ্রমের মূল্য দর্শক দিয়েছে খোলা হৃদয়ে। অনুষ্ঠান গ্রহণ করছে সানন্দে। এবং দ্রুত চ্যানেল আই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টেলিভিশন’র স্থান দখল করে নেয়। ২৩ বছর অতিক্রম করেও চ্যানেল আই এখনো প্রথম ৩টি চ্যানেলের একটি। তবে প্রায়শঃ প্রথম স্থান দখলে রাখে।
কেন লাল সবুজের দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে তা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে চ্যানেল আই! উত্তর অনুষ্ঠান। কিন্তু ৩০টির বেশী চ্যানেল তো অনুষ্ঠান করে। তবে কেন চ্যানেল আই এত প্রিয়।
কারণ বিভিন্ন জরুরি ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনুষ্ঠান খুব চিন্তাভাবনা নিয়ে নির্মাণ করেছে। শুধুমাত্র বিনোদন নয়, জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় রাষ্ট্র ও মানুষের জন্য জরুরি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার করে এই চ্যানেল আই দেশের একটি অনিবার্য টিভি চ্যানেল। বিষয়গুলো এমন: (১) শাইখ সিরাজের কৃযিভিত্তিক অনুষ্ঠান: হৃদয়ে মাটিও মানুষ; (২) পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে মুকিত মজুমদার বাবুর পরিকল্পনা, উপস্থাপনায় ও পরিচালনায় প্রথম কোন টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান: প্রকৃতি ও জীবন; (৩) রাজনৈতিক বিষয় : জিল্লুর রহমানের তৃতীয় মাত্রা; (৪) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক: মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন; (৫) সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠান: গান দিয়ে শুরু; (৬) জনপ্রিয় অনুষ্ঠান তারকাকথন ১৮ বছর ধরে সম্প্রচার করে আসছে; (৭) কেকা ফেরদৌসীর রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠান : রান্নাবান্না; (৮) এছাড়া প্রকৃতি মেলা, রবীন্দ্র মেলা, নজরুল মেলা, হুমায়ূন মেলা, বিজয় মেলা ইত্যাদি দর্শকনন্দিত অনুষ্ঠান।
প্রথমেই বলতে হয় শাইখ সিরাজের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’র কথা। এটি চ্যানেল আই’র সিগনেচার অনুষ্ঠান। এ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশনে শাইখ সিরাজ বেশ ক’বছর করেছিল। সেই অভিজ্ঞতায় বেসরকারি চ্যানেলের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের কাছে গিয়ে তাদের সাফল্যগাথা দেশবাসীকে অবহিত করে। বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল দেশ। বিগত দিনের অভাব অনটন, মঙ্গা-দুর্ভিক্ষের সময় যেন পুনরায় ফিরে না আসে তার জন্য অধিক ফলন ও উৎপাদন করার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কৌশলের খবরাখবর কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে এই অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একই সাথে সেচ ও উৎপাদনের অপ্রতুল সার-বীজ নিয়ে কৃষকের অভিযোগ এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষের গোচরে এনেছেন নিয়মিত। মৎস্য চাষ, হাস-মুরগির খামার জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে। শহুরে মধ্যবিত্তের মাঝে ছাদবাগান বা ছাদকৃষিকে জনপ্রিয় করতে শাইখ সিরাজের অবদান অনস্বীকার্য। এ অনুষ্ঠানটি ২০০৪ থেকে আজ অবধি ধারাবাহিক সম্প্রচারিত হচ্ছে।
জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠান আই’র আরো একটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন মতবাদের মানুষকে একটি প্লাটফর্মে এনে তুমুলঝগড়া বা তর্কে লিপ্ত করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত করার কৌশলটি সর্ব সাধারণে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০০৩ থেকে এখনও অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন চ্যানেল আই’র আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদনকারী রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ অনুষ্ঠান অভিনব। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অসীম সাহসী লড়াই করেছে ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে সে কথা সরাসরি দর্শক শুনেছে জেনেছে। শহীদ পরিবারের স্বজন হারানোর বেদনার কথা জেনে দর্শক অশ্রুপাত করেছে। পাকিস্তানী সেনাসদস্য ও রাজাকার আলবদর কর্তৃক বাঙালি নারীদের ধর্ষিত হওয়ার কথা শুনে নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিস্মিত হয়েছে। ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের মুখে শুনেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অনিবার্যতা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও পরিকল্পনার কথা। এ অনুষ্ঠান ২০০৭-২০১১, ৪ বছর ধারাবাহিকভাবে সম্প্রচারিত হয়ছে। এ অনুষ্ঠানটিও ২০০০ পর্ব অতিক্রম করেছে।
আব্দুল মুকিত মজুমদার, তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা টেলিভিশন নির্মাতা। চ্যানেল আইয়ের পর্দায় দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক বাংলাদেশে প্রথম প্রকৃতি ও জীবন অনুষ্ঠানটি রচনা, উপস্থাপনা, পরিকল্পনা ও পরিচালনা করে যাচ্ছেন চ্যানেল আইয়ের সম্মান বৃদ্ধিতে।
কেকা ফেরদৌসীর রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানটি দীর্ঘ ২২ বছর দর্শকপ্রিয়তা নিয়ে এখনো চ্যানেল আই’র পর্দায় সরব। এ অনুষ্ঠান নারী দর্শকদের প্রিয় অনুষ্ঠান।
এছাড়াও সেরাকণ্ঠ, ক্ষুদে গানরাজ, বাংলার গান ও সকালের সঙ্গীতানুষ্ঠান গান দিয়ে শুরু সকাল শুরু ২০১২ থেকে নিয়মিত চলছে। এটি সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা। বাঙলা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে এ অনুষ্ঠান সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
২০০১ এ চ্যানেল আই সংবাদ প্রচার শুরু করে। দেশের মানুষের কাছে চ্যানেল আই তার প্রচার সংবাদ আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতার জায়গাটি এখনো ধরে রেখেছে। তবে সংবাদ উপস্থাপনে কারিগরী কৌশলক্ষেত্রে আধুনিকতার প্রয়োজন আছে বলে অনেকে মনে করেন। চ্যানেল আই উলেখিত প্রতিটি বিষয় নিয়ে তার জন্মলগ্ন থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে। দেশের সংস্কৃতির বিকাশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি ও বাংলার কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে চ্যানেল আই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ধীরস্থির ফরিদুর রেজা সাগরের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরামর্শে প্রতিটি অনুষ্ঠান দেশ ও মানুষের কল্যাণে নির্মিত হয় এই চ্যানেলে।
চ্যানেল আই বাংলাদেশের টেলিভিশন-সংস্কৃতি বিকাশের একটি উজ্জ্বল নাম। শত বৈচিত্র্য নিয়ে স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ফরিদুর রেজা সাগরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় নিরন্তর পথ হাঁটছে চ্যানেল আই। ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজের চিন্তা, ভাবনা ও রুচির প্রতিফলন ঘটিয়ে চ্যানেল আই’র পর্দাকে আনন্দময় ও তথ্যবহুল করতে যে কর্মী ও কর্মকর্তাগণ দশকের পর দশক পরিশ্রম করছেন তাদেরকে জানাই অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
যতদিন বাংলাদেশ তত দিন লাল সবুজের চ্যানেল আই।
জয় হোক চ্যানেল আই’র।