বঙ্গবাজারের মহানগর মার্কেটে ‘রহমানিয়া ফ্যাশন’ নামে শিশুদের কাপড়ের ব্যবসায়ী জাভেদ ওমর বলছিলেন, সোমবার মোটরসাইকেল বেচে ক্যাশ ৪ লাখ টাকাও দোকানে রাখছিলাম। তাও পুড়ে গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন পথের ফকির।
জাভেদ ওমরের মতো ক্ষতির শিকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন কোনভাবেই দাঁড়াতে পারব না।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার। এমন দাবি করে প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজারের আগুন দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। তাদের ৪৮টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
সকাল ৬টা ১০ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কয়েকটি ইউনিট। পরে ক্রমান্বয়ে ইউনিট বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত ৪৮টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়। এতে সম্মিলিতভাবে যুক্ত হয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা।
ইমরান হোসেন নামের আরেক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, আমি এক টাকার মালও বের করতে পারিনি ভাই। আমার সব শেষ।
“মহানগর মার্কেটে ‘ইমরান এন্টারপ্রাইজ’ নামে বাচ্চাদের কাপড়ের দোকান আর অ্যানেক্স মার্কেটের ৭ তলায় একটা গোডাউন ছিল। সব শেষ। আমার ৩০ লাখ টাকার মাল ছিল। গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই।”
মহানগর মার্কেটে ‘রহমানিয়া ফ্যাশন’ নামে শিশুদের কাপড়ের ব্যবসায়ী জাভেদ ওমর বলেন, ‘আমার দোকানে ৭৫ লাখ টাকার মাল ছিল। তার মধ্যে মাত্র এই ৪ বস্তা মাল বাঁচাইতে পারছি। বাদবাকি সব আগুনে গেছে। গতকাল আমি আমার মোটরসাইকেল বেচে ক্যাশ ৪ লাখ টাকাও দোকানে রাখছিলাম। তাও পুড়ে গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন পথের ফকির। এখন ঈদের আগে এই ৪ বস্তা কাপড় আমার ভ্যানে বিক্রি করা লাগবে। না হলে পোলাপাইন নিয়ে চলতে পারব না। আমার আরও ১০ লাখ টাকা ঋণ আছে। সেটা এখন কীভাবে শোধ করব, সেটা মাথায় আসতেছে না।’
আরেক ব্যবসায়ী মামুন বলেন, ‘আমার জীবনের সব উপার্জন যে আগুনে পুড়ে গেল, এই ক্ষতির দায় নেবে কে? কে আমার ঋণ পরিশোধ করবে? আমার তো কিছুই নেই। সব তো শেষ হয়ে গেছে।’
ব্যবসায়ী মামুন বলেন, যাদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে মালামাল কিনেছি তাদের বলেছি, ঈদের আগে সব টাকা পরিশোধ করে দেব। এখন তো সবকিছু আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেল। কীভাবে ঋণ পরিশোধ করব? কীভাবে সংসার চালাব?
বঙ্গবাজার মার্কেটে ‘মায়ের দোয়া’ নামে ৬টি দোকান ছিল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হেলাল খানের। তার দাবি, এসব দোকানে ৬ কোটি টাকারও বেশি মালামাল ছিল। কোনো রকমে একটি দোকানের মালামাল বের করতে পেরেছেন। গোডাউনের মালামাল বের করতে পারেননি। কিছু পুড়েছে, বাকি সব পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
হেলাল খান জানান, ‘ঈদ উপলক্ষ্যে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকার মালমাল তুলেছি। সব নষ্ট হয়ে গেল। এখন সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, তাহলে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতে পারব। নয়তো আমাদের মরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
শিল্পী ফ্যাশন নামে একটি দোকানের কর্মচারী জাকির হোসেন বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটগুলোতে লাখের ওপরে কর্মচারী রয়েছে। অধিকাংশ দোকানের কর্মচারী গত মাসের বেতনও পায়নি। এর মধ্যে আগুনে সব পুড়ে গেছে। এখন মালিক কবে গত মাসের বেতন দেবে সেটাও জানি না। আর ঈদের আগে মার্কেট ঠিক করা সম্ভব হবে কি না, দোকান আবার খুলবে কি না সেটাও জানি না। এই অবস্থায় আমরা কীভাবে ঈদ করব বলেন। কীভাবে ঘর ভাড়া দেব, কীভাবে ছেলে-মেয়ে, মা-বাপেরে টাকা পাঠামু?
বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার। এমন দাবি করে প্রাথমিকভাবে ৭০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চেয়েছন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।
বঙ্গবাজারে মঙ্গলবার সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে ৫ হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। একইসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।
ক্ষতির শিকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, অসংখ্য ব্যবসায়ী পথে বসে গেছে। সরকার যদি আমাদের কিছু ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। মালামালের তুলনায় বলতে গেলে আমরা কিছুই বের করতে পারিনি। এই অবস্থায় সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে, তাহলে কোনোরকম উঠে দাঁড়াতে পারবো। নয়তো আমাদের মরণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।