
ইসলাম ধর্মে ফজিলতপূর্ণ দুটি রাত রয়েছে। একটি লাইতুল মীলাদ তথা প্রিয়নবী (স.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন। গুরুত্বের দিক থেকে সেই রাত শ্রেষ্ঠ। আরেকটি লাইলাতুল কদর তথা ভাগ্যরজনী। একে ফার্সি ভাষায় ‘শবে কদর’ বলা হয়। উপমহাদেশের মুসলমানদের কাছে এই নামটিই বেশি প্রসিদ্ধ। ইবাদতের দিকে এটি শ্রেষ্ঠ রাত বলে বিবেচিত। লাইলাতুল কদর কতটুকু শ্রেষ্ঠ, তা স্বয়ং পবিত্র কুরআন বলে দিয়েছে। সূরা কদরের আয়াত, ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চাইতে শ্রেষ্ঠ।’ (সূরা কদর, আয়াত: ৩)। হাজার মাসকে বাৎসরিক হিসেবে গণনা করলে ৮৩ বছরের অধিক সময় গণনায় বেরিয়ে আসে। ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, ইবনে কাছীরসহ প্রায়সকল তাফসীরকারক এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, এ রাতের ইবাদত, কিয়াম, দরুদ ইত্যাদি হাজার মাস করার চাইতে দামী। অর্থাৎ প্রায় ৮৪ বছর ইবাদতের সওয়াব এক রাতেই নিহিত।
উম্মতে মুহাম্মদীকে শবে কদর উপহার দেয়ার একটা বিশেষ কারণ রয়েছে। পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মত থেকে আমাদের নবীর উম্মতের হায়াত কম। যেকারণে এ উম্মত ইবাদতের সময় কম পেয়ে থাকে। যাতে অন্য উম্মতের সামনে উম্মতে মুহাম্মদীর ইবাদত কম না হয়, অন্যের সামনে ছোট হতে না হয়, তাই শবে কদর উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। একদিন নবী কারিম (স.) বনী ইসরাইলের এক ব্যক্তির আলোচনা করলেন। তিনি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় হাজার মাস জিহাদ করেছিলেন। তার এমন ইবাদত দেখে উপস্থিত মুসলিমরা ঈর্ষান্বিত হলেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা হাজার মাসের চেয়ে দামী রাত লাইলাতুল কদর ঘোষণা করে সূরা কদর নাজিল করেন। (ইমাম বাইহাকীর শুয়াবুল ইমান ও ফাজাইলুল আওক্বাত)।
শবে কদর অর্থ মর্যাদার রজনী। কেননা এ রাতের ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদার কথা কুরআন-হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। শবে কদরের আরেক অর্থ ভাগ্য রজনী। কেননা এ রাতেই সকল মানুষের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়। সুরা দুখানে লাইলাতুম মোবারকা তথা বরকতময় রাতের বর্ণনায় অধিকাংশ তাফসীরকারক লাইলাতুল কদরকে উদ্দেশ্য করেছেন। আল্লাহ বলেন: ‘হা-মীম। সুস্পষ্ট কিতাবের কসম। আমি একে (কুরআন) এক বরকতময় রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। আমার পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, আমিই প্রেরণকারী। আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা দুখান: আয়াত ১-৬)।
শবে কদরের ফজিলত প্রসঙ্গে প্রিয়নবী (স.) ইরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় রোযা পালন করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ইমানের সাথে, সওয়াব লাভের আশায় লাইলাতুল কদরে রাত জেগে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়।’ (বুখারী ও মুসলিম)।

এই রাতেই ঘটেছে ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কুরআন মাজীদ নাযিল। পৃথিবীবাসী মানবজাতির মুক্তির সনদ কুরআন মাজীদ শবে কদরেই পেয়েছে। সূরা কদরের শুরুতেই বলা হয়েছে, আমি এই কুরআন নাযিল করেছি কদরের রাতে। কুরআন নাযিল হওয়ার কারণে শবে কদরের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফজিলতের দিক থেকে শবে কদর অন্যান্য রাতকেও ছাড়িয়ে গেছে। হাদিসের ভাষ্যমতে, এ রাতকে ক্ষমার রাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শবে কদর কবে বা কোন সময়, এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম বিস্তর গবেষণা করেছেন। প্রথমত, এটি রমজান মাসে। আর হাদিস শরীফের বর্ণানুযায়ী রমজান মাসের শেষ দশকে রাসূল (স.) ইতিকাফ করে তা খুঁজে পেয়েছিলেন। হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন: ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর।’ ( মুসলিম ও আহমাদ)। যেহেতু নবী কারিম (স.) বেজোড় রাতগুলোকে ইবাদতের মাধ্যমে অনুসন্ধানের কথা বলেছেন, তাই শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো সুন্নাহ।
বিভিন্ন হাদিসে শেষ দশকের বেজোড় রাত তথা ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ তারিখের কথা কেন উল্লেখিত হয়েছে। এরকারণ, উম্মত যেন অধিক ইবাদতমুখী হয়। তাই প্রিয়নবী (স.) শবে কদর কোন রাতে হবে, তা সাধারণ মজলিসে নির্ধারণ করে বলে যাননি। যদিও তিনি আলামত বলে গেছেন। যার আলোকে মুহাদ্দিসীন ও আইম্মায়ে কেরাম গবেষণা করে বিভিন্ন রাতের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। সাহাবায়ে কেরামের একাংশ ও ইমাম আবু হানিফাসহ ইমামগণের একাংশের মতে, ২৭ তারিখেই শবে কদর। কেননা, হাদিসে বর্ণিত আলামতসমূহ এ রাতেই প্রতিফলিত। এছাড়া সূরা কদর নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায়, সেখানে লাইলাতুল কদর শব্দটি ৩ বার
এসেছে। আর এই শব্দে মোট ৯টি হরফ বিদ্যমান। ৩ এর সাথে ৯ গুন দিলে ২৭ হয়। কুরআনের এই গাণিতিক হিসেবও ২৭ তারিখের দিকে ইঙ্গিতবহনকারী। এজন্য উপমহাদেশে ২৭ তারিখটি বিশেষভাবে ইবাদতের মাধ্যমে পালিত হয়। এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, নিম্নোক্ত সহীহ হাদিস থেকে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী কারিম (স.) এর কাছে এসে আরয করল, হে আল্লাহর নবী! আমি নিতান্তই অসুস্থ অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি। রাতজেগে ইবাদত করা আমার শরীরের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। অতএব আমাকে এমন এক রাতে ইবাদতের নির্দেশনা দিন, যাতে আমি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাব। অতঃপর তিনি নির্দেশ দিলেন:
তুমি ৭ম রাত অর্থাৎ ২৭ তারিখ রাতে ইবাদত কর। (মুসনাদে আহমদ, তাবরানী ও বাইহাকী)।
শবে কদরের আমল:
শবে কদরকে ইবাদতের রাতও বলা হয়। সারারাত জেগে ইবাদত করাই এই রাতের মূল উদ্দেশ্য বা প্রকৃতি। রাস্তাঘাটে ঘুরাফেরা কিংবা আতশ বাজিয়ে মানুষের ইবাদতে সমস্যা সৃষ্টি করা শবে কদরের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এ রাতের প্রধান ইবাদত হল, নফল নামাজ বা কিয়ামু লাইলাতিল কদর। হাদিস শরিফে বর্ণিত রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ইমান সহকারে সওয়াব লাভের আশায় সারারাত জেগে লাইলাতুল কদরের নামায আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ।’ (বুখারী ও মুসলিম)।
শবে কদরের ইবাদতসমূহের মধ্যে সালাতুল আওয়াবিন, দান-সদকা, তাসবীহ-তাহলীল, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ, কবর জিয়ারত প্রভৃতি অন্যতম। বিশেষ করে সেই দোয়াটি বেশিবেশি পাঠ করা উচিত, যা প্রিয়নবী (স.) এ রাতের জন্য উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: একবার আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি বলে দিন, আমি যদি লাইলাতুল কদর কোন রাতে হবে, তা জানতে পারি, তাতে আমি কী (দোয়া) পড়বো? রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করলেন, তুমি বলবে: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আ’ফুয়্যুন; তুহিব্বুল আ’ফওয়া; ফা’ফু আ’ন্নী।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)।