জার্মান কিংবদন্তি ফ্রেঞ্জ বেকেনবাওয়ারের ক্যারিয়ার ছিল কাব্যের মতো সাজানো, ভালোবেসে মানুষ তাকে ডাকতো কাইজার বা সম্রাট নামে। রক্ষণের খেলোয়াড় হয়েও প্রতিপক্ষের জন্য ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। সোমবার রাতে ৭৮ বছর বয়সে মারা গেছেন জার্মানদের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ও কোচ। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারের ক্যারিয়ারজুড়ে রয়েছে অসংখ্য সোনালী অর্জন।
১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া বেকেনবাওয়ার শৈশব থেকেই ‘১৮৬০ মিউনিখের’ ভক্ত ছিলেন। ফুটবলে তার হাতেখড়ি মিউনিখের আরেক ক্লাব বায়ার্নে। সেখানে একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলা শুরু করেন।
পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ১৯৬৪ সালে। পরে মাঝমাঠ থেকে সময়ের আবর্তনে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে শুরু করেন বেকেনবাওয়ার। জার্মানির ক্লাব ফুটবলে দ্বিতীয় সারির দল বায়ার্নকে বুন্দেসলিগায় নিতে সহায়তা করেন। পরে ১৯৬৮-৬৯ মৌসুমে দলটির নেতৃত্ব নিয়ে প্রথমবার এনে দেন বুন্দেসলিগা শিরোপাও।
ধীরে ধীরে বায়ার্ন হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এক দল। ১৯৭২-৭৪ সালের মধ্যে ঘরোয়া লিগে হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতে বেকেনের দল। খেলোয়াড় হিসেবে বায়ার্নের হয়ে সবমিলিয়ে জিতেছেন ৫টি শিরোপা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন তিনবার।
বেকেনের ঝুলিতে আছে একটি ইউরোপিয়ান কাপ, চারটি জার্মান কাপ, একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও। এনএএসএল সকার বোল চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। এতসব অর্জনের স্বীকৃতিতে ১৯৭২ ও ১৯৭৬ সালে ব্যালন ডি অ’র জেতেন দুবার। ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ সালে দেশের বর্ষসেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পেয়েছেন বেকেনবাওয়ার।
বেকেন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন ২০ বছর বয়সে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সুইডেনের বিপক্ষে পশ্চিম জার্মানির হয়ে অভিষেক। ১৯৬৬ সালে অভিষেক বিশ্বকাপে ফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে হেরে রানার্সআপ হয় পশ্চিম জার্মানি। তারপর থেকেই মূলত সোনালি সময়ে প্রবেশ করে জার্মানি। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে পশ্চিম জার্মানি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয়। ১৯৭৪ সালে দেশটি জিতে নেয় বহুল কাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপই, বেকেনের অধিনায়কত্বেই। জার্মানির হয়ে খেলেছেন ১০৩টি ম্যাচ।
বায়ার্নের হয়ে সবমিলিয়ে ৫৮২ ম্যাচে করেছে ৭৪ গোল। গোল করিয়েছেন ৭৫টি। জাতীয় দলের হয়ে ১০৩ ম্যাচে ১৪ করেছেন, গোলে সহায়তা করেছেন ১০টিতে।
১৯৮৩ সালে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে সেবছরই পশ্চিম জার্মানির কোচের দায়িত্ব নেন বেকেনবাওয়ার। কোচের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমবার ১৯৮৬ সালে দলকে নিয়ে যান বিশ্বকাপের ফাইনালে। আরেক কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডনার আর্জেন্টিনার সঙ্গে পেরে উঠেনি পশ্চিম জার্মানি। সন্তুষ্ট থাকতে হয় রানার্সআপ হয়ে।
পরের বিশ্বকাপে সেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জেতেন বেকেনবাওয়ার। খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের অভিজ্ঞতা তখন ছিল কেবল ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি মারিও জাগালোর। পরে সেটি করে দেখান ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশমও।
কোচ হিসেবে বেকেনবাওয়ারের কীর্তি অবশ্য সেখানেই থামেনি। ফরাসি ক্লাব মার্শেইকে ১৯৯০-৯১ লিগ ওয়ান শিরোপা জেতান। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে কোচ হিসেবে বুন্দেসলিগার শিরোপা এনে দেন বায়ার্নকেও। কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি টেনে বায়ার্নের সভাপতি এবং জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন বেকেন।
কোচিং ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে বায়ার্নের হয়ে ৯টি লিগ শিরোপা, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৬টি জার্মান লিগ কাপ, একটি উয়েফা কাপ ও একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জেতেন। অলিম্পিক মার্সেইর হয়ে একবার একবার ফ্রেঞ্চ চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল।