বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ৪৭ বছর অতিক্রান্ত হলো। বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় যথেস্ট পরিমাণে দক্ষিণ পন্থায় ঘুরিয়ে দিয়েছে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার ভয়াবহ ঘটনাটি।
দু’দুটি সামরিক কর্মকর্তা ক্ষমতাসীন হয়েছেন, জামায়াতে ইসলামী বৈধ হয়ে বি এনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কল্যাণে মন্ত্রীত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছে। বহু রাজাকার নানাবিধ নিবাচনে দিব্যি নির্বিঘ্নে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামতে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও আসতে পেরেছে, বাহাত্তরের সংবিধান বে-আইনী পঞ্চম ও অষ্ট সংমোধনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী এক সংবিধানে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে, বালাদেশের স্বাধীনতার চরম এবং সক্রিয় বিরোধ ও বহু হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটপাটের অভিযোগে অভিযুক্ত ও পাক-বাহিনীর ঘনিষ্ঠতম মিত্র জামায়াতে ইসলামী, (বাহাত্তরের সংবিধানে যে দলটিকে এবং একই সাথে, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ও দলসমূহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু) মুসলিম লীগ সহ সকল ধর্মভিত্তিক দলকে অপ্রত্যাশিতভাবে বৈধতা দেওয়া হয়ে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্ত্রাঘাতে দূর করে ‘রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলা’ এমনটা ওই সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে বাংলাদেশের রাজনীতিকে পুনরায় পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টাও সফল হয়েছে।
আবার ২০০৮ এ ব্যাপক ভোটে নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্রার বিচারিক ক্ষমতা হরণকারী আইন বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্রার বিচার ও অভিযুক্তদেরকে আদালত কর্তৃক প্রদত্ত শাস্তি কার্য্যকর করার মত দুঃসাহসী পদক্ষেপ গৃহীত হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ এ বাঙালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংঘটিত নয়মাস ব্যাপী সশস্ত্র যুদ্ধকালীন সময়ে যে অপরাধীরা পূর্ব সিদ্ধান্তক্রমে গণহত্রায় লিপ্ত হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে দেশের স্বাভাবিক আইনে বঙ্গবন্ধু হত্রার, চার জাতীয় নেতা হত্যার এবং গণহত্যার বিচার ও গঠিত বিশেষ আদালতে প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই দুঃসাহসী দায়িত্ব পালন করার জন্য সরকার অবশ্যই প্রশংসা পেতে পারেন এবং পেয়েছেনও।
তাই আজকের ভাবনায় এসেছে যা আমি অতীতে বিভিন্ন পত্রিকায় অনেকবার লিখেছি-বঙ্গবন্ধু হত্রার দায় দায়ীত্ব শুধুমাত্র জনাকয়েক আত্মস্বীকৃত খুনীর উপর বর্তায় না। এই হত্যালীলার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শক্তিশালী মহলের ষড়যন্ত্র ছিল। সেই ষড়যন্ত্র এ যাবত অনুদঘাটিত। শুধু তাই নয়, ওই ষড়যন্ত্র উদঘাটনের ব্যাপারে কোন উদ্যোগই এ যাবত আমাদের রাষ্ট্রের তরফ থেকে গ্রহণ করা হয় নি।ফলে এই ভয়াবহ হত্যালীলার আসল নায়ক কারা তা পূরোপূরি অনুদঘাটিতই রয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সময়টার দিকে যদি সচেতনতার সাথে দৃষ্টিপাত করা যায় এবং স্মৃতিতে তৎকালীন দেশের পরিস্থিতিতে ঠিকমত আনা যায় তবে নিশ্চয়ই আমাদের মনে পড়বে যে ১৯৭৫ সালের আগষ্টে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে কমে গিয়েছিল-দলটির ক্ষমতাসীন থাকলেও তার নেতৃত্বে মধ্যে উপদলীয় কোন্দল যথেষ্ট দানা বেঁধেছিল যদিও সব উপদলই বঙ্গবন্ধুকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা বলে উল্লেখ করতো।

খোন্দকার মোশতাক, যেভাবেই হোক, মুক্তিযুদ্ধের বহু আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত আস্থা ও বিম্বাসের পাত্রে পরিণত হতে পেরেছিলেন। অপরপক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাশীল নেতা, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ খোন্দকার মোশতাকের বিরোধিতার ও চক্রান্ত উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের উচ্চ শিখরেনিতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রীসভা থেকে এক দেড় বছর আগে অবস্মাৎ সরিয়ে দেওয়ার ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথ বহুলাংশে সহজ হয়েছিল।
মুজিবনগরে থাকতেই খোন্দকার মোশতাক সেখানকার বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকার ইঙ্গিতে ও সহায়তায় যে ষড়যন্ত্র করে তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হন। সেই একই ষড়যন্ত্র ভিন্ন রূপে বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যালীলার ষড়যন্ত্রের সাথে আমেরিকা যে ওত:প্রোতভাবে জড়িত ছিল এ যাবত প্রকাশিত হত্যালীলা সংক্রান্ত অজ¯্র বই পুস্তকে তার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয় হয়েছে।
ঘটনার অন্তত: এক বছর আগে থেকেই ঘটনা ঘটার মাসখানেক পর পর্য্যন্ত পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন ও ম্যধপ্রাচ্যের দেশগুলির ঢাকাস্থদূতাবাসের কার্য্যক্রমের দলিলপত্র ঘাঁটলেই বঙ্গবন্ধু হত্রালীলার যাবতীয় ষড়যন্ত্র বেরিয়ে পড়বে বলে অনেকেরই বিশ্বাস।
ঐ একই সময়ে খোন্দকার মোশতাক,তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং তার আরও কয়েজন আওয়ামী লীগ দলীয় সহকর্মী এবং নানা পেশায় নিয়োজিত তাদের সমর্থক গোষ।ঠীর ইতিবৃত্তাত্তের খোাঁজ নিলে তা-ও হয়তো কাজে লাগতে পারে। বারবার কোন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, প্রমুখের নাম স্বভাবত:ই উঠে আসছে এবং তা যুক্তিসঙ্গত কারণেই। সে কারণটি হলো খোন্দকার মোশতাক যখন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন-তখনই অত্যন্ত গোপনে তিনি কলকাতায় নিযুক্ত আমেরিকার সহকারী রাষ্ট্রদূতের সাথে শলাপরামর্শ চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে একটি তথাকথিত ‘শিথিল কনফেডারেশন’ গঠন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আকাশ প্রমাণ জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে তাঁরা কৌশলে বলা সুরু করলেন, বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফিরিয়ে আনতে হলে এ জাতীয় কনফেডারেশনের কোন বিকল্প নেই। অথচ কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তেমনি ১৫ আগষ্ট বোর রাতে যখন ট্যাংক-কামান নিয়ে বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক সৈন্য ও সেনা-কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং ধানমন্ডীস্থ বাড়ী অতর্কিতে আক্রমণ করলো-তখন তিন সেনা প্রধান কেন কোন প্রকার ভূমিকা নিলেন না-কেন তাঁরা কেউ ছুটে এসে তাঁদের অধীনস্থ সেনাদেরকে নিরস্ত করতে উদ্যত হলেন না-তা অত্যন্ত গভীরভাবে তলালাশি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
মুজিবনগর সরকারের তথা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ফ্রিডম ফাইটার অর্থাৎ এফ এফ বা মুক্তিবাহিনীকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর (ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা মুক্তিবাহিনীসহ) অকস্মাৎ ভারতের মাটিতে বসে সেখানকার সেনাবাহিনীর মার্কিন সমর্থক গোষ্ঠীর সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর নাম সুকৌশলে ব্যবহার করে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে অপর একটি বাহিনী গঠন করা হয়েছিল এবং তাদের লিখিত অলিখিত নির্দেশনা কী কী দেওয়া হয়েছিল তা খুঁজে বের করলে সম্ভবত: বঙ্গবন্ধু হত্রা রহস্যের নির্ভরযোগ্য সন্ধান পাওয়া যাবে।
যে সকল দেশ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পর উল্লাস প্রকাশ করেছিল এবং স্বীকৃতিও দিয়েছিল-প্রাথমিকভাবে তারা এই নির্মম হত্যালীলার ষড়যন্ত্রকারী বলে ধরে নিয়ে উপযুক্ত ও নির্ভরযোগ্য তদন্ত শুরু করা অত্যন্ত জরুরী।
আওয়ামী লীগ ও সামরিক বাহিনীর যে সকল কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্রার পূর্ব থেকে সুরু করে পরবতী অন্তত: ছয় মাস লুকিয়ে থেকে হত্রাকারীদেরকে হত্যালীলা চালিয়ে যাওয়ার অবাধ সুযোগ দিয়েছিল তাদেরকেও চিহ্নিত করে অনুরূপ তদন্ত সুরু করা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে তৎকালে কর্মরত বিদেশী দূতাবাসগুলির কর্মকর্তা ও দেশীয় (বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছে-তাঁরা এখন জীবিত বা মৃত যাই হন না কেন তাদের সম্পর্কে বিশেষ তদন্তের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরী।
তদুপরি ঐ সময়ের সংবাদপত্র এবং তার মালিক ও সম্পাদকদের ভূমিকাও বিশেষ তদন্তের আওতায় আনা প্রয়োজন ।
সাজাপ্রাপ্ত পলাতক খুনীরা
আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি-যখনই বৎসরান্তে আগষ্ট মাস ঘুরে ফিরে আসে-তখনই বঙ্গবন্ধু হত্রার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনীদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি সরকারিভাবে আলোচনায় উঠে আসে। তখন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, পলাতক খুনীদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড বার্য্যকর করার জন্র জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং শীঘ্রই ওই প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখবে। এ ব্রাপারে বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সরকার এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সাথেও পররাষ্ট্র দফতর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে।
কিন্তু এ প্রচেষ্টা যেন কদাপি শেষ হবার নয়। এক বছর অন্তর অন্তর প্রতিটি আগষ্টেই আমরা একই বয়ান শুনে আসছি আজ ৪৭ বছর ধরে। এর সমাপ্তি কোথায় তা যাঁরা এমন আশাবাদী উচ্চারণ বছর বছর করে চলেছেন তাঁরাও তা জানেন বলে মনে হয় না। দেশবাসীকে আপাতত: তুষ্ট করার জন্যই এ সকল স্তোকবাক্য বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে কি না-তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
পরিশেষে জনগণের ভাবনা
বঙ্গবন্ধু হত্রা, আমরা সবাই জানি, আদৌ কোন ব্যক্তির হত্রা নয়। বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি মানুষ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতির আশা-আকাংখা, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় চার মৌলনীতি প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ ও ভরসার শ্রেষ্ঠতম প্রতীক।
সাদা অর্থে তাঁকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে হত্যাকারীরা এমন কঠিন ঝুঁকি নিয়েছিল-এমনটি ভাবাও যুক্তি সঙ্গত: নয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী ভাবাদর্শ অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রয় ক্রিয়াকলাপে ধর্মের ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। তাই তিনি কদাপি আপোষ করেন নি কোন সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সমাজতন্ত্রের সমর্থক পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রের বিরোধী। এটিও একটি বড় কারণ যার জন্য পুঁজিবাদী বহুদেশ এবং সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগলি আমাদের স্বাধীনতা-আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করেছে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু অটল থেকেছেন। ১৯৭২ এর সংবিধানে তাই তিনি যে চার মৌল রাষ্ট্রনীতি লিপিবদ্ধ করেছিলেন- তা হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ স্পষ্টত:ই যারা এই চার মৌল রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিরোধী নি:সন্দেহে তারা হয় খুনী, খুনের ষড়যন্ত্রকারী বা খুনের সমর্থক। আজ একথা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)