৭৫’র নির্মম হত্যাকাণ্ড, ২১ বছর পর ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে প্রচলিত আইনে বিচার শুরু, রায় ঘোষণা ও তা কার্যকর করা একদা দেশবাসীর কাছে অকল্পনীয় মনে হলেও রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক বিচার হয়েছে সত্য, তবু সে সময়ের অসংখ্য বিষয় এখনও ইতিহাসে অমীমাংসিত হয়েই আছে। বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে ও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ঘোষিত মুজিববর্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায় ১৯৭৫’র “আগস্ট ট্রাজেডি”-এর ৪৫ বছর পূর্ণ হলো, কিন্তু অমীমাংসিত হাজারো সত্য এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
একজন বিশ্লেষক, গবেষক, পর্যবেক্ষক, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ বা গোয়েন্দা দৃষ্টিতে নয় একেবারেই দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার কিছু সহজ প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা আছে; জানি না প্রশ্নগুলো কার কাছে করবো বা কার কাছে করা উচিত। আমার সরল বুদ্ধিতে যতটুকু সম্ভব প্রায় সকল চেষ্টাই করেছি। বিভিন্ন পত্রিকা, বই, ম্যাগাজিন, অনলাইন সোর্স থেকে কিছুটা জানার চেষ্টা করেছি। রাজনীতিবিদ, সমরবিদ, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংক্ষুব্ধজন, আমলা, আইনজ্ঞ, বিচারক এমনকি তদন্তকারী অফিসার; অনেককেই প্রশ্ন করেছি, কেউই এই সরল প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে না।
খুব সহজ জিজ্ঞাসা হলেও দায়িত্বশীলদের জন্য প্রশ্নগুলো বিব্রতকর। আমি একজন রাজনৈতিক মাঠকর্মি; আমার নেতৃবৃন্দ আমার কাছ থেকে এমনতর প্রশ্নের উত্তর দেয়া তো দূরের কথা, শোনার জন্যও প্রস্তুত না। দিনশেষে নিজেকে আমি দেশপ্রেমিক ভাবি; কিন্তু প্রশ্নগুলো দেশপ্রেমিক অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্যও তেমন সুখকর নয়। এবংবিধ আমার বিশ্বাস এই সহজ জিজ্ঞাসাগুলো প্রতিটি সচেতন নাগরিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৭১ ও ৭৫ এর শত্রুরা বারবার পিছন থেকে ছুরি মেরেছে, বারবার হোঁচট খেয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে দুর্বার বেগে এগিয়ে চলা স্বদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, নিম্ন আয়ের দেশ থেকে আত্মমর্যাদাশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। আজও যদি আমরা এই সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে না পারি তবে অনেক অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে।
আমার সরল প্রশ্নগুলো:
০১। ১৫ আগস্ট নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোথায়? ১৫ আগস্ট নিহত সকল শহীদের অর্ধেক নামও কি আমরা জানি?
০২। সে রাতে একটি ১০৫ এমএম হাউইটজার কামানের গোলা ছোড়া হয় যা আঘাত করে মোহাম্মদপুর শাহজাহান রোডের ৮, ৯ বাড়ি এবং শেরশাহ সুরি রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড) ওপর, নিহত হয় ১৪ জন, আহত ৪০জন। তারাও তো ১৫ আগস্টের শহীদ। তাদের নামগুলো আমরা স্মরণ করি না কেন? তাদের প্রতি কেন এত অবহেলা?
০৩। হত্যাকাণ্ডের ছবিগুলো কোথায়? ১৫ আগস্ট বিকালে দৈনিক বাংলার চিফ ফটোগ্রাফার গোলাম মওলাকে সেনাসদস্যরা ধরে নিয়ে যায় ৩২-এ। তার রলিফ্লাক্স ক্যামেরায় ৩/৪ রিল ছবি তোলা হয়। ৩২ নম্বরের সেই সোনার মানুষগুলোর শেষ ছবিগুলো আমরা কি আর দেখতে পাবো না কোনদিন? কেন এতদিন তার খোঁজ করলো না কেউ?
০৪। ৭৫ এর সকল হত্যাকাণ্ডের ন্যূনতম বিচারও কি জাতি পাবে না কখনও? সেই কালরাতে ৪টি জায়গায় হামলা হয়েছিল, মামলাও হয়েছিল পৃথকভাবে ৪টি, যদিও তা ২১ বছর পর, ১৯৯৬ সালে। ক) বঙ্গবন্ধু ভবন, ধানমন্ডি ৩২ এর ৬৭৭ নং বাড়ি খ) শেখ মনির বাড়ি ধানমন্ডি ১৩/এ এর ১৭০ নম্বর বাড়ি গ) আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা, ২৭ মিন্টু রোড এবং ঘ) মোহাম্মদপুর শাহজাহান রোডের ৮, ৯ বাড়ি এবং শেরশাহ সুরি রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ি (টিনশেড)। এরমধ্যে শুধু ধানমন্ডি ৩২ নং এ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক বিচার হয়েছে- বাকী ৩টির ১টিরও বিচার হয়নি, এমনকি মামলাগুলোর হদিসও তেমন কেউ জানে না।
০৫। অনলাইনে বিশেষত উইকিপিডিয়ায় আগস্ট হত্যাকাণ্ড আজীব সব অসত্য ও খণ্ডিত হাইপোথিসিস দিয়ে ভরা। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে অনেক ট্রোল হয়েছে এদেশে কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই প্রত্যাশার চেয়েও অনেক এগিয়ে আছে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ চলা। তথ্য-প্রযুক্তিতে দলের এমনতর অবদান থাকা সত্ত্বেও আমরাই সবচেয়ে বেশি তথ্যসন্ত্রাসের শিকার। উইকিপিডিয়ায় আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত আর্টিকেল বা তথ্য রয়েছে সবই বিএনপি-জামাত তথা এন্টি আওয়ামী এক্টিভিস্টদের দখলে। ১টি বারের জন্যও তারা জাতির পিতা বলা তো দূরের কথা বঙ্গবন্ধু শব্দটাই উচ্চারিত হয় না উইকিপিডিয়ায়র কোন পেইজে। দলের এত গবেষণা সেল, এত গবেষক, বুদ্ধিজীবী, এক্টিভিস্ট কেউই খেয়াল করে না, উদ্যোগ নেয় না এমনকি নোটিশ পর্যন্ত করে না। কেন এই উদাসীনতা? বিশ্ববাসী ও নতুন প্রজন্মের কাছে অন্তর্জাল থেকে যে ভুল তথ্য যাচ্ছে- এ দায় কার?
০৬। বঙ্গবন্ধু ব্যাতিত ১৫ আগস্ট নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও নিকট আত্মীয়দের সমাহিত করা হয় বনানী কবরস্থানে যেখানে সমাধিসমূহ অদ্যোবধি সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। শ্বেতপাথরে বাঁধানো লম্বা একটি সমাধিক্ষেত্রের দুই পাশে দুটি স্মৃতিফলকে ১৮ জনের নামের তালিকার পাশে লেখা রয়েছে “ও নাম না জানা আরও অনেকে”। ১৫ আগস্ট নিহত শহীদদের সমাধিসমূহ এখনও সুনির্দিষ্ট করা হয়নি কেন? মোহাম্মদপুরের ১৪ জন শহীদের সমাধি কোথায়, কী অবস্থায় আছে?
০৭। ১৫ আগস্টের ঘাতকদের তালিকা কই? সেনা কোরের মধ্যে আর্মার্ড বা ল্যান্সার বাংলায় সাজোঁয়া বাহিনী এবং আর্টিলারী বা গোলোন্দাজ বাহিনী এই ২টি ইউনিট হামলায় অংশ নেয়। ধারণা করা হয় মোট ১৮টি কামান এবং ২৮টি ট্যাংকসহ কয়েকশত সেনা সদস্য সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। ইতিহাসের নির্মমতম এই হত্যা ষড়যন্ত্রে দেশী-বিদেশী যারা জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করা বেশ কঠিন কাজ হলেও যে সকল সেনাসদস্য সেদিন ব্যারাক থেকে বেড়িয়ে সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা কেন তৈরি করা হয়নি, হয়ে থাকলে সেই তালিকা কোথায়?
০৮। লাশের গায়ের গহনাগুলো কোথায়?
৭৫ পরবর্তি ২১ বছর কখনও সেনাশাসনে পিষ্ট হয়েছে স্বদেশ, কখনও ক্ষতবিক্ষত হয়েছে স্বৈরাচারী দুঃশাসনে। কিন্তু ৭৫ থেকে মুজিববর্ষ সময়তো গড়িয়েছে ৪৫ বছর। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতিকে পাপমুক্ত করতে ৭১ ও ৭৫ এর শত্রুদের আইনের আওতায় নিয়ে এলেও এই সরল প্রশ্নগুলো কেউ তোলেনি, উত্তরও অজানা! ১৫ আগস্ট নিয়ে দেশি-বিদেশি অসংখ্য বিখ্যাত লেখক-সাংবাদিক, গবেষক, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, ভূক্তভোগী/সংক্ষুব্ধজন, বিশেষজ্ঞসহ নানা মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠান অনেক গবেষণা করেছেন। শত-সহস্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গবেষণাপত্র, বই-পুস্তিকা, তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। শুধুমাত্র এবারের বাংলা একাডেমি বইমেলায় বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই বেড়িয়েছে ১৪৪টি। বিশ্বব্যাপি কোভিড অতিমারী যদি আঘাত না হানতো তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আয়োজনের ব্যাপকতা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অনন্য অধ্যায় যুক্ত করতো। মুজিববর্ষ ঘোষণা ও করোনা পরবর্তি পুনঃবিন্যাস্ত আয়োজন-উদযাপন স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হলেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতসব মহা আয়োজনেও এই সহজ সত্যজিজ্ঞাসাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে না কোথাও।
১৫ আগস্ট নিয়ে অনেক বড় বড় জিজ্ঞাসা আছে, যেমন জাতির পিতা হত্যা ষড়যন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত কি হবে না? সরকার নতুন করে কমিশন করার কথা ভাবছে- সেটা এখনও হলো না কেন? হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারী কারা, তাদের তালিকা কি হবে না? মরণোত্তর পুরস্কার প্রথা থাকলে মরণোত্তর বিচার কেন হবে না? এগুলো বড়দের প্রশ্ন, অনেক জটিল বিষয়। আমরা যারা স্বাধীনতার প্রথম প্রজন্ম অর্থাৎ যাদের জন্ম স্বাধীন দেশে- যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি- কিন্তু হৃদয়ে ধারণ করি বঙ্গবন্ধুকে তাদের একজন ক্ষুদ্র কর্মি হিসেবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চাই; এই অমীমাংসিত বিষয়গুলো ঝুলিয়ে রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করি না। আমাদের মত ছোটদের এই সহজ, সরল প্রশ্নগুলো এমন কোন রকেট সায়েন্স নয় যার সমাধানসূত্র আবিষ্কার করা মহাযজ্ঞের বিষয়। সামান্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগই এর সমাধান দিতে পারে।
আমার এই ৮টি ছোট প্রশ্নগুলোর মধ্যে মৌলিক বিষয় মাত্র কয়েকটি- শহীদদের তালিকা, ঘাতকদের তালিকা, ছবি ও গয়নাগুলোর সন্ধান, সমাধি সুনির্দিষ্টকরণ, বাকি ৩টি মামলার বিচার এবং অনলাইনে খণ্ডি ইতিহাস প্রতিরোধ।
৭৫ এর শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা অদ্যোবধি জাতি জানে না। বনানী গোরস্থানে শায়িত যারা তার অর্ধ্বেকই অজ্ঞাত পরিচয়। জাতির পিতার সাথে শহীদ হয়েও অজ্ঞাত পরিচয় নিয়েই তারা ঘুমিয়ে আছে আমাদেরই চোখের সামনে ৪৫ বছর ধরে। বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নির্মমতার শিকার যারা, সেই মহান শহীদদের প্রতি এই অমার্জনীয় অবহেলার জাবাব চাইবো কার কাছে?
সকল শহীদদের দাফনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার লেঃ কর্নেল হামিদের উপর। ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ নামের তথ্যবহুল বইয়ের লেখক লেঃ কর্নেল হামিদ হলেন দাবারু রানী হামিদের স্বামী, কায়সার হামিদের বাবা। তার বক্তব্যেই পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর লাশের কফিনে অন্য লাশ রাখা হয়েছিল এবং তার সন্দেহ হওয়ায় সাপ্লাই ট্রাকের লাশের স্তুপ থেকে বঙ্গবন্ধুর লাশ সনাক্ত করে তিনি আলাদা করেছিলেন। তার নেতৃত্বে বনানীতে মোট ১৮ টি কবর খোড়া হয়। তিনি জানান, “শেখ পরিবারের ৭ জন সদস্যের কবর আছে বনানীতে। প্রথম কবরটা বেগম মুজিবের। ২য়টা শেখ নাসেরের। ৩য় টা শেখ কামালের। ১৩ নংটা শেখ মণির। লাশগুলো দাফনের পর আমি আমার অফিসে ফিরে এসে এক এক করে নামগুলো আমার অফিস প্যাডে লিপিবদ্ধ করি। রেকর্ডটি বহুদিন ধরে আমার কাছে রক্ষিত রয়েছে। কেউ কোনদিন খোঁজও করে নি। এ ছাড়া আর কোথাও সমাধিগুলোর রেকর্ড নেই।” (পৃষ্ঠা ২৫৯, বেলা-অবেলা, মহিউদ্দিন আহমেদ)
“আগস্টে নিহতদের নিয়ে এক সামরিক কর্মকর্তার প্রতিবেদন” শিরোনামে ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন অনুবাদ করে প্রকাশ করে। মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ নামের সেই সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন লেঃ কর্নেল হামিদের সহকারী। ১৯৯৯ সালে মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ মারা যান। কর্নেল হামিদের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি ৩টি বাড়িতেই যান লাশগুলো সংগ্রহ করার জন্য। খুবই হৃদয়বিদারকভাবে তিনি প্রতিটি লাশের অবস্থা ও অবস্থান বর্ণনা করেছেন তার প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী বনানী গোরস্থান: সারি নম্বর ৭–এ যাদের কবর দেওয়া হয়ঃ
১. বেগম মুজিব ২. শেখ নাসের ৩. শেখ কামাল ৪. সুলতানা কামাল ৫. শেখ জামাল ৬. রোজী জামাল ৭. শিশু রাসেল ৮. অজ্ঞাতপরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি বালক ৯. ফাঁকা ১০. অজ্ঞাতপরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক ১১. গৃহপরিচারিকা, বয়স ৪৫ ১২. অজ্ঞাতপরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা ১৩. শেখ মনি ১৪. মিসেস মনি, ১৫. অজ্ঞাতপরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক, ১৬. অজ্ঞাতপরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক ১৭. আবদুর রব সেরনিয়াবাত ১৮. অজ্ঞাতপরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক।
নোট: ৯ নম্বর কবরের নাঈম খানের লাশ লে. আবদুস সবুর খানের (এনওকে) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ, আর্টিলারি, স্টেশন স্টাফ অফিসার, স্টেশন হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা। ১৮ আগস্ট ১৯৭৫।
খেয়াল করে দেখুন ১৮টি সমাধির মধ্যে ৮টি অজ্ঞাতনামা। আরও নির্মম বিষয় সর্বকনিষ্ঠ শহীদ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের নাতি, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ৪ বছর বয়সী শিশু সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ১১ বছর বয়সী ভাই আরিফ সেরনিয়াবাত, বোন বেবি সেরনিয়াবাতসহ অনেকেরই নাম এই তালিকায় নেই; হয়তো আছে অজ্ঞাত তালিকার মধ্যে! এই ৩ বাড়ির সদস্যদের তালিকাটিই যেখানে সুনির্দিষ্ট নয় সেখানে অন্যান্য যারা নিহত হয়েছেন যেমন কর্মরত অফিসার, নিরাপত্তা রক্ষী, অতিথি, গৃহকর্মী তাদের নাম আর কে খোঁজ করবে?
আগস্ট ট্রাজেডিতে সবচেয়ে কম উচ্চারিত নাম মোহাম্মদপুরের হতভাগ্য ১৪ জন শহীদ। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি আর্টিলারি গ্রুপ কামান নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবনের দক্ষিণে অবস্থান নেন। সেখান থেকে নিক্ষেপিত মর্টার শেল আঘাত হানে মোহাম্মদপুরে। কামান থেকে ছোড়া এমন আন অবজার্ভড গোলা ৩০ মাইল দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ নং বাড়ি এবং শাহজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়িতে (টিনশেড বস্তি) মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় এবং নিহত হন ১৪ জন, আহত ৪০। ওই ঘটনায় আহত ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় উল্লেখিত নিহতরা হলেনঃ ০১. রেজিয়া বেগম ০২. নাসিমা ০৩. হাবিবুর রহমান ০৪. আনোয়ারা বেগম, ০৫. আনোয়ারা বেগম (২) ৬. ময়ফুল বিবি ৭. সাবেরা বেগম ৮. আবদুল্লাহ ৯. রফিকুল ১০. সাফিয়া খাতুন ১১. শাহাবুদ্দিন ১২. কাশেদা ১৩. আমিনউদ্দিন ১৪. হনুফা বিবি। সবাই মর্টার আগুনে নিহত হন।
২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদালত। ১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া মামলার বাকি ১২ আসামি পলাতক রয়েছেন। আদালতের নথিপত্রে ৫৮ জন সাক্ষীর কথা বলা আছে। ঢাকার চার নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, “মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, এর মধ্যে আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করা ম্যাজিস্ট্রেট মারা গেছেন বলে শুনেছি। তার মৃত্যু সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই আমরা সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করার আবেদন করব। আশা করছি, মুজিববর্ষেই এ মামলা নিষ্পত্তি হবে।”
এই ১৪ জন কতটা দূর্ভাগা দেখুন- ২৪ বছর কেটে গেছে আর রাষ্ট্রের আইনজীবী বলে মুজিববর্ষের মধ্যেই মামলা নিষ্পত্তি হবে অথচ ম্যাজিস্ট্রেট জীবিত না মৃত তাও তিনি জানেন না। এই ১৪ জনের দাফন কোথায় হয়েছে তাও কোনখানে উল্লেখ নেই। এত অবহেলা কি মানা সম্ভব? ধারণা করি, নিহতরা ছিলেন বিহারী তবু আমার সক্ষমতা থাকলে এই ১৪ জনের নাম-ছবিসহ শেরশাহ সুরি রোডে ১টি মনুমেন্ট বানাতাম।
শেখ মনি হত্যা মামলার সর্বশেষ অবস্থা কেউ জানে না; নথি না-কি হারিয়ে গেছে। শেখ মনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন ১৯৯৬ সালের ২০ নভেম্বর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমান ২২ শে আগস্ট, ২০০২ তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। মুন্সী আতিকুর রহমান আবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামী। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, মামলার নথি পাওয়া যাচ্ছে না। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে মামলার নথি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে (১৬ আগস্ট ২০২০, দৈনিক সমকাল)। আরেকটি সূত্রে জানা গেছে (১৫ আগস্ট, ২০১০, ডেইলি স্টার) ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০০২ চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে এবং অভিযোগকারীকে অবহিত না করে গোপনে সকল আসামীকে খালাস দেয়।
২৭ মিন্টো রোড, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় ঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার ঝুলে আছে ২ যুগ ধরে। এ বাড়িতে নিহতরা হলেনঃ ১. আবদুর রব সেরনিয়াত ২. চৌদ্দ বছর বয়সী কন্যা বেবী ৩. বারো বছরের পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত ৪. চার বছর বয়সী নাতি সুকান্ত বাবু (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ’র জ্যেষ্ঠ সন্তান) ৫. ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত ৬. ভাগ্নে আব্দুর নাঈম খান রিন্টু ৭. পোটকা ৮. লক্ষীর মা। এরসাথে আবদুর রহিম খান নামক একজনকে পাওয়া যায় যার বিস্তারিত জানা যায় নি (প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট, ২০১৮)। ১৫ আগস্ট, ২০২০ বিডিনিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় নিহদের মধ্যে ছিলেন ৩ জন অতিথি এবং ৪ গৃহকর্মী। এ ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২১ অক্টোবর আবুল হাসানাতের স্ত্রী সাহান আরা বেগম বাদী হয়ে ঢাকার রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বর্তমানে হাইকোর্টের আদেশে মামলার বিচারকাজ স্থগিত আছে। তবে মূল মামলাটি বতর্মানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। এ বিষয়ে ওই আদালতের প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার দুলাল বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে মামলাটি এখনো মুলতবি আছে। তাই বিচারকাজ এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। ৭৫ এ শিশু সন্তান হারা মা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম গত ৭ জুন ইন্তেকাল করেন।
ঐতিহাসিক ৩২ নং রোডের বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ পরিবারের নিহত সকল সদস্যের শতাধিক ছবি তোলা হয়েছিল। বুলেটবিদ্ধ বঙ্গবন্ধু পড়ে ছিলেন সিঁড়িতে, সেই ছবি অনেক দিন দেখিনি কেউ। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা যখন দেশে ফিরে এলেন তখন তিনি এর নেগিটিভ সাথে নিয়ে এসেছিলেন লন্ডন থেকে। শেখ সেলিমের সম্পাদনায় ১৯৮১ সালে বাংলার বাণী পুণঃযাত্রা করে। সেখানের ডার্ক রুমে নেত্রী নিজে উপস্থিত থেকে ছবি ডেভলপ করিয়েছেন ফটো সাংবাদিক স্বপন সরকারকে দিয়ে। এই প্রথম সিড়িতে পড়ে থাকা জাতির জনকের নিথর দেহের শেষ ছবি দেখে কেঁদে উঠেছিল বাংলাদেশ।
পরবর্তিতে জানা গেল ছবিগুলো তুলেছিলেন তৎকালীন সরকারি পত্রিকা “দৈনিকবাংলা”-এর প্রধান ফটো সাংবাদিক গোলাম মওলা। ৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বিকালে সেনা সদস্যরা তাকে অফিস থেকে তুলে বঙ্গবন্ধু ভবনে নিয়ে যায়। অস্ত্রের মুখে তাদের নির্দেশণায় প্রায় শতাধিক ছবি তুলেন গোলাম মওলা। সেনা সদস্যরা সকল ফিল্ম খুলে নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যায় আবার সৈন্যরা যায় দৈনিক বাংলা অফিসে ছবিগুলো প্রিন্ট করতে। মওলা সাহেব তার সহকারী ওয়াসে আনসারীকে দিয়ে ছবিগুলো ডেভলপ ও ওয়াশ করান। ডার্করুমের ভিতরে বন্দুক তাক করে ছিল সৈন্যরা। শুধু নেগিটিভ আর প্রিন্টগুলোই নয় সকল ওয়েস্টেজ ভিজে ছবিগুলোও তারা রোল করে নিয়ে যায়। যাবার সময় গোলাম মওলা অনুরোধ করেন সম্পাদককে এক নজরে ছবিগুলো দেখানের জন্য। তারা রাজি হয়। মওলার তোলা ছবিগুলো উপস্থিত সহকর্মীদের মধ্যে দেখেছিলেন বার্তা সম্পাদক ফজলুল করিম, রিপোর্টার জহিরুল ইসলাম। ফিচার এডিটর সৈয়দ আব্দুল কাহহার, বিচিত্রার সহকারী সম্পাদক মাহফুজ উল্লাহ প্রমুখ। এই শতাধিক ছবি থেকেই ১টি ছবি সেনাবাহিনী থেকে বিদেশী মিডিয়ায় সরবরাহ করা হয় যেটির নেগেটিভ বঙ্গবন্ধু কন্যা লন্ডন থেকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন। যে ছবি দেখে সেনা সদস্যরা গোলাম মওলাকে আবারও দোষী করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার মানবিক দৃঢ়তায় সেনারা মিথ্যা অভিযোগ স্টাবলিশ করতে পারেনি। গোলাম মওলা তারপর সিঙ্গাপুরে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি মারা যান।
এই ছবিগুলো এখন কোথায় আছে, কেউ জানে না। ছবিগুলো তারা নষ্ট করেছিল কিনা তাও কেউ জানে না। যতটুকু বুঝি এই ছবিগুলোর খোঁজও কেউ নেয়নি গত ৪৫ বছর, যেমন নেয়নি সমাধি তালিকা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তথ্য-প্রমান সংগ্রহ করতে দীর্ঘদিন অহর্নিশ পরিশ্রম করেছিলেন চৌকষ তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ। সে ও এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন আমাকে।
বনানী কবরস্থানে শায়িত শহীদদের মধ্যে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ছাড়াও মেহেদীরাঙা হাতে চিরশয্যায় শায়িত আছে তার দুই নবপুত্রবধু; শেখ মনির অন্তসত্ত্বা স্ত্রী এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের চতূর্দশী কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত। খুব দামী না হলেও এই ৫ জন নারীর শরীরেই থাকার কথা কিছু না কিছু অলংকার। সেই গয়নাগুলো কোথায়? এই ৫ মহিয়সী বাঙালি নারীর শরীরে থাকা শেষ গয়নাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিচিহ্ন জাতির জন্য- এতটা বছর কেউ তার খোঁজ করলো না! এই অলংকারগুলোই যে আমাদের অহংকার তার গুরুত্বই আমরা বুঝলাম না।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু নিয়ে এত গবেষণা করেন- আপনার কি মনে হয়নি ৭৫ এর শহীদ ও ঘাতকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি ৪৫ বছরে কেউ করলো না কেন? উত্তরে বললেন, “আমাদের ইতিহাস চর্চায় আমরা অনেক কিছুই জানি না। এটা অনেক কারণে হয়েছে, সেটা রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক বা অন্য কোনো কারণে হতে পারে। যেমন আমরা এখনো ৭১ সালের শহীদের তালিকা করতে পারিনি। এটা হওয়া উচিত। আমাদের শেকড় হচ্ছে একাত্তুর কিন্তু তাও অনেক ঘটনা আমাদের অজানা। আমরা সেনাবাহিনীর তথ্য সবটা জানি না, ভারতীয়দের কাছে যে তথ্য আছে তা পাইনি, এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসের দলিল পোড়ানো হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে। এই তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। যেহেতু ক্ষমতা ও সুযোগ কেবল তাদেরই আছে। সাধারণ নাগরিক এটা পারবে না। আমার মানি এরকম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের ঘটনা সম্পর্কে জানা আমার জন্য, আমাদের রাষ্ট্রের ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক। তবে ৭১ বা ৭৫, দুটো সম্পর্কে আমাদের জানার সীমাবদ্ধতা আছে, এটাও স্বীকার করা দরকার।”
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ৩০ লাখ শহীদের তালিকা আমরা তৈরী করতে পারিনি। ৭১ তো আমার শিকড়! বাংলাদেশের ৭১ সম্পর্কিত তথ্যইতো পাওয়া যায় না। ইন্ডিয়ার কাছে অনেক তথ্য আছে,- তাদের কাছে চাইলে বলে “সব পুড়ে গেছে ”। এ জাতি ইতিহাসের মর্ম বুঝে না তাই চর্চাও করে না। যে কাজ করবে রাষ্ট্র সেই কাজ তুমি আমি কতটুকু করতে পারি?
৩০ লাখ শহীদের তালিকা তৈরি করা একটু কঠিন কিন্তু অবশ্যই সম্ভব। সেই তুলনায় ৭৫ এর ঘাতকদের তালিকা করা কি আদৌ বড় কোন কাজ? ২টা মাত্র ইউনিট সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছে আর্টিলারী এবং আর্মার্ড কোর, কয় হাজারই বা সৈন্য? ১৪ আগস্ট রাত ১০টায় বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলোর মধ্যে ২৮ টি ট্যাংক ও শকটযানসহ ১৮টি কামান জড়ো হলো পুরাতন বিমানবন্দরের বিস্তীর্ণ বিরান মাঠে। রাত সাড়ে ১১টায় জড়ো হলো মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদসহ ঘাতকরা। ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহর রাত সাড়ে ১২টায় পরিকল্পনা ব্রিফিং করে মেজর ফারুক। এই প্রথম সবাই জানতে পারল সে রাতেই হত্যা করা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এখান থেকেই ঘাতকের তালিকা তৈরি শুরু করলে হয়- যে অফিসার ও সৈন্যগণ যারা সরাসরি হামলায় জড়িত ছিল; পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উম্মোচন না হয় পরের ধাপে হবে।
মনে রাখতে হবে টেকনাফে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকান্ডে যে ক’জন পুলিশ সদস্য জড়িত তারাই দায়ী এমনতর ন্যাক্কারজনক ঘটনার, গোটা পুলিশ বিভাগ এর জন্য কোনভাবেই দায়ী নয়; তেমনি ৭৫ এর ঘটনায় কয়েকজন সেনা- অফিসার ও কয়েকশত সৈন্য জড়িত, দায় তাদেরই, গোটা সেনাবাহিনীর নয়। তাই একটি পেশাদার, চৌকষ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ার প্রাক শর্তই হচ্ছে সেনা বাহিনীর বিপথগামী/অপরাধী সকল সদস্যের অতীত অপকর্মের বিচার করা। আর কতকাল লুকোচুরি খেলা হবে? গোপনীয়তার নামে ক্লাসিফাইড ডকুমেন্টস ফর এভার নিয়ম কোন সভ্য দেশে থাকতে পারে না। উইকিলিকস অনেক গোপন তথ্য লিক করে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রও এখন নির্দিষ্ট মেয়াদের পর অতি গোপনীয় ডকুমেন্টস পাব্লিক করে দিচ্ছে। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষে জনকের হত্যা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য ৪৫ বছর পরও কেন আমরা জানতে পারছি না? উত্থাপিত এই সরল প্রশ্নগুলো আজও উচ্চারিত না হলে ১০০ বছর পর হলেও উত্তরপ্রজন্মের কাছে উত্তর কিন্তু দিতে হবে। রাজনীতির সেই প্রবাদ পুরুষ, জাতির জনকের শেষসহযাত্রী ৭৫ এর সকল শহীদগণ। সকল শহীদদের সবাইকে যদি আমরা যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা যতদিন না দিতে পারবো, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ তথা আত্মমর্যাদাশীল সমৃদ্ধশালী জাতি গঠন সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)