আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাসমর্থিত খোন্দকার মোশতাক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান থাকাকালীন ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল।
‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের স্বাক্ষর রয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর রয়েছে। অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
একটি হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হলো আর তার বিচার হবে না? রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বোচ্চ অবস্থান গ্রহণ করে আইন প্রণয়ন করে হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে দিবে – এটা কি করে সম্ভব? খুনিরা প্রকাশ্যে খুন করার বাহাদুরি করবে আর একটি রাষ্ট্র, একটি জাতি, একটি সমাজ শুধু নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে?
এরপর, ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী গৃহীত হয়। পঞ্চম সংশোধনীটি নিজে কোনও আইনের সংশোধনী নয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সকল অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে আইনি বৈধতা দান করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীর মূলকথা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখসহ ওই দিন থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের যে কোনো ঘোষণা বা আদেশ বলে সম্পাদিত সংবিধানের সকল সংশোধনী, সংযুক্তি, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলুপ্তি বৈধভাবে সম্পাদিত বলে বিবেচিত হবে এবং কোনো কারণেই কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে এসবের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এভাবে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
কেন পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তির কথাটি বললাম তার যথেষ্ট কারণ আছে। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অতএব, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিলনা। কিন্তু ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’র ক্ষমতাবলে ভবিষ্যতে কেউ যাতে ১৫ আগস্ট খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে পারে সে ব্যবস্থাটিকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ পরিণত করা হলো। একই সাথে এটাও বোঝানো হলো যে, যেহেতু এটি সংবিধানের অংশ হয়ে গেছে এটি আর পরিবর্তন করা যাবে না। আর এই দোহাই দিয়েই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রদ করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াত।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬–এক সুদীর্ঘ ২১ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। অতঃপর, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আইনগত দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আমিন উল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তার রিপোর্টে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতোই প্রায় ১৬টি আইন পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীকালে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা হয়েছে। সুতরাং, কমিটির মতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিও একই রকমভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই সংসদে বাতিল করা সম্ভব।
কমিটির এই রিপোর্ট আইন কমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এফ কে এম মুনীরের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশনও তা সমর্থন করে। এরপর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল সংসদে উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ সংসদে মানবতা ও সভ্যতাবিরোধী কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন প্রণয়ন করা হয়। ঘোচানো হয় ২১ বছরের জাতীয় কলঙ্ক। আর সেই সাথে সুগম হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় একটি ফৌজদারী মামলা দায়েরের মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে পনেরো (১৫) জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আসামি পক্ষে পনেরো জন উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয় এবং ৩ জনকে খালাস দেয়া হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভের পর আওয়ামীলীগ সরকার আবার এ বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিল-এর মাধ্যমে এর বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে বারো জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন মহামান্য আদালত। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তারিখে এদের মধ্যে পাঁচ জনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বাকি ছয় জন এখনও বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে পলাতক অবস্থায় আছেন। পলাতকদের মধ্যে একজন এরই মাঝে বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
মজার ব্যাপার হোল, ঢাকায় একটি সিনেমা হলের মালিকানা নিয়ে ১৯৭৭ সালে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক রিট মামলাকে কেন্দ্র করে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বিষয়টি আদালতের সামনে আসে। ঐ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট। ফলে আবারও প্রমাণিত হলো সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী যা নাকি ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রণীত কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে ধারণ করে ছিল, তা অবৈধ এবং অসাংবিধানিক।
আজ আরও একটি শোকাবহ ১৫ আগস্ট জাতি অতিক্রম করছে। এরই মাঝে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের খলনায়কদের বিচার হয়নি আজও।
প্রায় ৩৫ বছরপ রএই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি জড়িত সাবেক সেনাসদস্যদের দণ্ড দেয়া হলেও বেসামরিক কোন ব্যক্তির বিচার হতে দেখা যায়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কোন নিছক হত্যাকাণ্ড নয়, বরং এর পেছনে সুস্পষ্ট একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল।বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়েও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আরো কারা ছিলেন এবং কি উদ্দেশ্যে ছিলেন সেটি নিয়ে আরো তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
আজকে শোকাবহ ১৫ আগস্টে আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হলেও, এই হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের দিকটি অপ্রকাশিত থেকে গেছে। আরও বিশ্বাস করি, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের খলনায়কদের বিচারের আওতায় এনে জাতির সামনে সত্য উন্মোচিত হওয়া অত্যন্ত জরুরী। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে, মাননীয় আইনমন্ত্রী জনাব আনিসুল হক বলেছিলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং যোগসাজসের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করা হবে এবং এবিষয়ে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। কিন্তু আফসোস আজ প্রায় ৪ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও এব্যাপারে জাতি এখনও অন্ধকারেই আছে!
আজকের বাস্তবতায় তাই একটাই দাবি-বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের খলনায়কদের বিচার চাই, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিচার চাই। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে মৃত ব্যক্তির বিচারের বিধান চাই। আর সেটা সম্ভব। আইন মানুষের জন্য, আইনের জন্য মানুষ নয়। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আইন তাই কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)