ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ তুলেছেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তবে এই বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
রোববার (২ এপ্রিল) রাতে এক বিবৃতিতে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “যে বইটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টার প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে রচিত, তাতে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকেই অস্বীকার কিংবা এর গুরুত্ব কমিয়ে দেখানো কীভাবে সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অভিযোগ ওঠায় আমি আশ্চর্য হয়েছি। আমি মনে করি, কোথাও বইয়ের কোনো কোনো অংশ বুঝতে ভুল হয়েছে কিংবা ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে।”
অন্যদিকে রোববার দুপুরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে অধ্যাপক ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ সংগঠন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের সঞ্চালনায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল (বিচ্ছু জালাল), বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন মজুমদারসহ প্রমুখ।
মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের বক্তব্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও ‘সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ’-এর পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এর লেখা ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ নামক বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিজে হাজির হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন। উক্ত বইতে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি।
তার উল্লেখিত পুস্তকে এমন কথাও লিখেছেন যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে ১৯৭১-এ বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা ১৯৪৮ সালের ‘জেনোসাইড কনভেনশনের’ আওতায় পড়ে না। জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞাভুক্ত হতে হলে একটি মানবগোষ্ঠী কর্তৃক অন্য এক মানবগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে হয়।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি চরম অবমাননা করে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো, আসলেই কি ত্রিশ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, নাকি মৃতের সংখ্যা কম ছিল? তার এমন দুঃসাহসিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ লেখনীর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করার অপরাধে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদকে অনতিবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারণ করার দাবি জানাচ্ছি। একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কোন পাকিস্তানি দালাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে পারে না।
ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “এটাও মনে রাখা দরকার যে এখন থেকে ১৪ বছর আগে জোনোসাইডের জন্য দায়ীদের বিচারের দাবি নিয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য-পরিসংখ্যান ব্যবহার করে খুব বেশি লেখালেখি হত না। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ গণহত্যার এপিসেন্টার হিসেবে পরিচিত, সেখানেও এ ধরনের গবেষণার আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছিল না। আমার গ্রন্থ এবং অন্যান্য লেখালেখিতে জেনোসাইড-১৯৭১ নিয়ে ধারাবাহিক ও নিবিড় গবেষণার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।”
‘সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক একটি কলাম লেখেন। ওই লেখায় তিনি সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজের লেখা ‘হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন’ (২০০৯) বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন। “বইয়ের কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অসম্মান বা অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হতে পারে- এমন একটি শব্দও নেই। এমনটি হতে পারে যে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিষয়ে আমার একটি মন্তব্যের সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে।’
অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “তারা হয়ত আমার বক্তব্যের সারবস্তু উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ কীভাবে শেষ করেছিলেন, সে বিষয়ে একটি বিতর্ক সে সময় চলছিল। আমি বলেছি- তিনি যেভাবেই শেষ করেছেন তা ছিল একজন বিচক্ষণ রাজনীতিকের ‘master stroke of a political genius’. আমি এটাও লিখেছি যে ৭ মার্চ স্বাধীনতার আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং ২৬ মার্চ হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। মুজিব নগর সরকার যথার্থভাবেই এ ঘোষণা দিয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “২০০৬ সালের ৭ মার্চ এক আলোচনা সভায় (যেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, সে সময়ে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন) আমাকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৪ বছর পর এখন আমার লেখাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ভুল বুঝতে পারে। এটাও লক্ষণীয় যে বর্তমান সরকারবিরোধী একটি মহলও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে ‘master stroke of a political genius’- আমার এ বক্তব্য গুলিয়ে ফেলা হবে, এটা ভাবতে পারিনি।”
এ অধ্যাপক মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি ‘চরম অবমাননা করে’ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বইটিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বলে মানবন্ধনে অভিযোগ করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী।
সেই অভিযোগের জবাবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “আমি বলেছি, কেউ কেউ মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন। আমি বলেছি- জেনোসাইডে ‘মৃতের সংখ্যা’ মুখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে ‘নিশ্চিহ্ন করার’ অভিপ্রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়ে যা ঘটেছে, কেবল সেটা বিবেচনায় নিলেই আমরা বলতে পারি- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান জেনোসাইড সংঘটিত করেছে।
“এটা গবেষক ও সংশ্লিষ্টদের জানা যে, আমি বারবার বলেছি- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে বলে যে তথ্য রয়েছে, যা এমনকি আরও বেশি হতে পারে যদি আমরা শরণার্থী শিবিরে মৃত্যু ও গর্ভপাত বিবেচনায় নিই। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা প্রাণের ভয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পালিয়ে থেকেছেন, তখনও অনেক নারীর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়েছে। এ বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত হবে।”
বইটি পাকিস্তান নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং এর লেখক হিসেবে তাকে ২০১৪ সালে করাচি ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে যেতে বাধা দেওয়ার কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।