চলচ্চিত্র-নির্মাতা মোহাম্মদ নূরুজ্জামানের কথা প্রথম শুনি ‘পুতুল’ ও ‘আদিম’ ছবির পরিচালক যুবরাজ শামীমের কাছে। শামীম সর্বদাই তাঁর শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে অকৃত্রিম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করতো। সেই থেকে তাঁর ও তাঁর কাজের প্রতি একটা আগ্রহের বোধ তৈরি হয়েছিল মনে। এরই মধ্যে খবর পেলাম তাঁর নতুন ছবি ‘আম-কাঁঠালের ছুটি’ মুক্তি পেয়েছে। তখন থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম ছবিটি দেখার জন্য। তারপর আচমকা একদিন খোদ মোহাম্মদ নূরুজ্জামান নিজেই তাঁর ছবির পরবর্তী প্রদর্শনীটি দেখার আমন্ত্রণ জানাতে আমাকে ফোন করলেন, সম্ভবত শামীমের কাছ থেকেই আমার নম্বর নিয়ে। চট্টগ্রাম থাকার কারণে তাঁর সে আমন্ত্রণ আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব না হলেও, সেদিনের আলাপের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার এমন এক প্রগাঢ় আত্মীয়তার সন্ধান পাওয়া গেল যে, তাঁর প্রতি আগ্রহ ও অনুরাগের পারদ যেন আরও ঊর্ধ্বমুখী হল। জানা গেল, সেও আমার মতো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র, যদিও ভিন্ন বিভাগ স্থাপত্যকলার এবং অনেক পরের শিক্ষাবর্ষের। শুধু তা-ই নয়, সে নাকি আমাদের বৃহত্তর ক্যাডেট পরিবারেরও সদস্য, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, আর আমি ফৌজদারহাটের। অবহিতজনেরা জানেন, এ এমন এক সুগভীর আত্মিক বন্ধন, যার মায়া ও মোহ অন্তহীন।
তো, সেই মায়ার টানে অতঃপর আমি নিজেই তাঁর এই ছবিটির একটি ঘরোয়া প্রদর্শনীর আয়োজন করে ফেলি দেশের বরেণ্য চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল ভাইয়ের ধানমন্ডিস্থ বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অন্তরঙ্গ মিলনায়তনে, গেল নভেম্বরের ৪ তারিখ সন্ধ্যায়। বাংলাদেশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা ও আমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব মিলে, নূরুজ্জামান ও তার টিমের কজন সদস্যর উপস্থিতিতে, সেদিন খুব আনন্দ নিয়ে, অখণ্ড মনোযোগ ও মুগ্ধতার সঙ্গে ছবিটি দেখি ও তার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি আমরা। আমাদের যাদের শৈশব, কৈশোর কেটেছে ষাট, সত্তর এমনকি আশির দশকেও, তাদের কাছে ‘আম-কাঁঠালের ছুটি’ এই শব্দবন্ধটির যে কী আবেদন ও আকর্ষণ ছিল, তা হালের এই ‘সামার ভ্যাকেশন’ প্রজন্মের সদস্যদেরকে ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। এই একটি ছবির নব্বই মিনিটের কালসীমায় কী এক অলৌকিক শক্তিতেই না নূরুজ্জামান আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই সোনালি শৈশবের দিনগুলোতে, যখন আমরা মুখিয়ে থাকতাম বছরের মাঝামাঝি নাগাদ কখন আমাদের ইশকুলগুলোতে আম-কাঁঠালের ছুটি ঘোষণা করা হবে, আর আমরা বাবা-মায়ের হাত ধরে রেলে, লঞ্চে কিংবা নৌকায় চড়ে এক লহমায় পৌঁছে যাব আদর আর মায়াভরা আমাদের দাদু-নানুর বাড়িতে। তারপর দিনভর দুষ্টুমি; ফড়িংয়ের পিছু নেওয়া, পাখির বাচ্চা কিংবা ডিমের সন্ধান, পুকুরে নেমে সাঁতার শেখা, নৌকা বাওয়া, এঁদো ডোবায় নানা কায়দায় মাছ ধরা আর খোদ গাছ থেকে পেড়ে আশ মিটিয়ে আম-জাম-কাঁঠাল-লিচু খাওয়ার মহোৎসবে মত্ত হওয়া!
একটি ঘরবন্দি, বিষণ্ণ ও বিরক্ত শহুরে ছেলে শুভর আচমকা তার দাদির সঙ্গে গ্রামে বেড়াতে যাওয়া এবং সেই গ্রামের ডানপিটে, দামাল দুই ভাই, আনোয়ার-মনোয়ারের পাল্লায় পড়ে গ্রামের আগাপাশতলা চেনা, তার প্রতিটি আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানো এবং গ্রামজীবনের নানান আচার, ঐতিহ্য ও উপরোল্লিখিত অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতাসমূহের স্বাদ পাওয়া, এ-ই হল এছবির মূল গল্প। এর ভেতর দিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও প্রসঙ্গকে সামনে নিয়ে এসেছেন নূরুজ্জামান। যেমন: শিশুকিশোরদের সুস্থ ও সুষ্ঠু বিকাশের জন্য একটি মুক্ত, স্বাধীন, নির্মল কৈশোর কতখানি প্রয়োজন এবং তা থেকে বিশেষ করে আমাদের শহরনগরের খাঁচাবন্দি শিশুরা কীরকম নির্মমভাবে বঞ্চিত আজ। এর সঙ্গেই একই সূত্রে গাঁথা, শিশুকিশোর নির্বিশেষে সামগ্রিকভাবেই এইসময়ের মানুষদের আত্মঘাতী প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতার বিষয়টিও। আরও একটি সমান জরুরি বিষয়ের ওপরেও আলোকপাত করে ছবিটি। সেটি হচ্ছে একটি জাতি ও জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও আত্মউন্নয়নের সঙ্গে তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, আচার, অনুষ্ঠান, সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদিও কতখানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছবিটি দেখার এতদিন পরেও যেন কানে বাজে শিশুকিশোরদের মুখেমুখে আবৃত্তি করা সেইসব অসাধারণ ছড়া কবিতা ও প্রবাদ প্রবচনের অপরূপ ধ্বনিমাধুর্য আর সুগভীর অর্থের দ্যোতনা!
একেবারেই অল্প বাজেটে, অতি সাধারণ ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি দিয়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, একদমই আনকোরা কয়েকজন প্রধানত কিশোরবয়সী অভিনেতা ও অভিনেত্রী নিয়ে পরিচালক নূরুজ্জামান ও তাঁর নিতান্তই অপেশাদার কারিগরি দলটি কীভাবে এমন টানটান, আদ্যোপান্ত উপভোগ্য, নয়নসুখকর এবং সময়োপযোগী বক্তব্যসমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সক্ষম হলেন, সেটি এক বিস্ময় বটে। অবশ্য এর জন্য তাঁকে কম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি! সবমিলিয়ে আট বছর লেগেছে তাঁর এই ছবিটি শেষ করতে এবং এর জন্য বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনার শিকারও হতে হয়েছে। কিন্তু কোনকিছুই যেন তাঁদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁরা শেষপর্যন্ত ছবিটি ভালোভাবেই শেষ করেছেন, এতটাই যে, দেশের ভেতরে তো বটেই, বাইরেও অনেকগুলো চলচ্চিত্রোৎসবে তা সসম্মানে আমন্ত্রিত, প্রদর্শিত, প্রশংসিত এমনকি পুরস্কৃতও হয়েছে। সেটি সম্ভব হয়েছে তাঁদের সততা, বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার জন্য, এবং স্বদেশের মাটি, মানুষ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় দায়বোধের কারণে। সেইসঙ্গে চলচ্চিত্র মাধ্যমটির নিজস্ব ভাষা ও ব্যাকরণ, তার প্রযুক্তি ও প্রয়োগকৌশল, তার নানাবিধ চ্যালেঞ্জ, শক্তি ও সম্ভাবনাসমূহকে বোঝা, সেগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর ক্ষমতা, সর্বোপরি শৌখিন কুশীলবদের কাছ থেকে সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক অভিনয় আদায় করে নেবার দক্ষতা- এসবই মূলত নূরুজ্জামানকে তাঁর কাংক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রভূত সাহায্য করেছে। সবমিলিয়ে একথা বলাই চলে যে, আমাদের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের সাম্প্রতিক তৎপরতাসমূহের মধ্যে এটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে, যা থেকে এই প্রজন্মের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা সহজেই খুঁজে নিতে পারবেন বহুবিধ প্রেরণা ও পথনির্দেশনা।
লেখক: আলম খোরশেদ। ফিল্ম ক্রিটিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক