চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সবকিছুই বদলে গেছে, শুধু রয়ে গেছে শুক্রবার

আমাদের সপ্তাহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন শুক্রবার। সেই শৈশব থেকে। শুক্রবারে স্কুল ছুটি থাকতো, বোধকরি শুক্রবারের প্রতি প্রথম ভালোবাসা ওখান থেকেই। তাছাড়া সপ্তাহের ওই দিনটাতেই বাবা বাসায় থাকতেন। বাবা বাসায় থাকা মানে সব কিছু একটু হলেও ভিন্ন রকম। ছুটির দিন হলেও এদিনে মায়ের ব্যস্ততা থাকতো আকাশছোঁয়া। বাবা বাজার থেকে ফিরলে শুরু হতো মূল ব্যস্ততা। আর তার প্রস্তুতি হিসেবে ভাই বোনদের ঝটপট নাশতা সেরে নিতে হতো। বাজার এলে মা ঢুকতেন রান্না ঘরে। খুব যে আহামরি কিছু তাওনা। হয়তো মোরগ পোলাও সাথে আলু অথবা বেগুন ভাজা। তবে হ্যাঁ, এতোটুকু বলতে পারি, সেই মুরগি রান্নার গন্ধ চলে যেতো রান্না ঘরের জানালা গড়িয়ে বড় রাস্তা অব্দি।

কোন কারণ ছাড়াই হয়তো সংসারের বড় মেয়েটা শুক্রবারে লতার গান ছেড়ে বসার ঘর গোছাতে লেগে যেতো। সোয়া ১২টার দিকে জুম্মার আযান হলে তোড়জোর শুরু হতো মসজিদে যাওয়ার। গোসল শেষে ভাঁজভাঙা পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে, তুলোয় আতর মেখে কানে গুঁজে তৈরি। তারপর বাবার হাত ধরে জায়নামাজ বোগলে নিয়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা। এসব অবশ্য ছিল একটা বয়স পর্যন্ত। সাবালক হওয়ার পর যেন একটু একটু বদলালো কিছু কিছু। যেমন বাবার সাথে মাসজিদে যাওয়া বন্ধ হলো। ১২টা থেকে বন্ধুদের পাল বাড়তে থাকতো আড্ডায়। কিন্তু নামাজ মিস হতো না। খুদবার ঠিক আগমুহূর্তে হলেও গিয়ে ঠিক ঠিক বসে যেতাম। কারণ গরিবের হজ নাকি জুম্মাই।

যাই হোক, একে একে মুরুব্বিরা চলে যেতে লাগলেন আর আমাদের নামাজ শেষে কবর জিয়ারতের সুযোগও যেন বাড়তে লাগলো। ঘনিষ্টজনের কবর জিয়ারত, সেটাও হয়ে উঠলো শুক্রবার কেন্দ্রিক। বিকেলে একটু কোথাও ঘুরতে যাবো তাও শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা। যদিও আমাদের তো আর চাকরির বালাই ছিল না। যে কোন দিনই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে পারতাম। কিন্তু ওই একই ঘটনা। শুক্রবার হলেই যেন সব ঠিক হয়।

বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ক্যাবল টিভি আসার আগে শুক্রবারের দুপুরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই ছিল না। কেননা তখন বিটিভিতে সিনেমা দেখাতো। বৃহস্পতিবার রাতে যে মুভি অব দ্যা উইক নামে বিদেশি সিনেমা দেখানো হতো ওটার কারণও কিন্তু ছিল ওই শুক্রবারই। এখন তো শুধু সকালের দিকটায় শুক্রবারের রাস্তা ফাঁকা থাকে। ২০ বছর আগে সারাদিনই মোটামুটি ফাঁকা থাকতো শুক্রবারে। মেঘে মেঘে বেলা অনেক কেটে গেছে। ক্যাবল টিভি এসেছে। ইন্টারনেটের হাত ধরে এসেছে স্মার্ট ফোন। মানুষের ব্যস্ততা আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা শুধু একটি কাজ করেন। বেঁচে থাকার জন্য আর বেঁচে থাকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান টাকার জন্য নারী-পুরুষ সবাই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। কোন দিক দিয়ে সময় যায় কেউ খেয়াল করেন না।

তারমধ্যে মুসলিমদের নানা ধরনের ভাগ তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে নাস্তিক নামের নতুন জীব। বহুতল মসজিদ তৈরি হয়েছে। সেই মসজিদ শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। দল বেঁধে মসজিদে যাবার রেওয়াজও মনে হয় উঠে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জুম্মা মোবারক লিখে পোস্ট দেয়া শিখে গেছি আমরা। ছোটদের মসজিদে দেখলে অনেকেই বিরক্ত হন, তাই বাবা-ছেলে হাত ধরাধরি করে জুম্মায় যাওয়ায় কিছুটা কমেছে। রান্নায় অনেক ঝামেলা তাই হয়তো ঘরে বাড়তি ঝামলা না করে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছেন অনেকেই।
পুরো পরিবার একসাথে মুভি দেখার প্রশ্নেই ওঠে না, কারণ এখন একসাথে ছবি দেখতে বসা মানেই বিব্রত হওয়া। কী বাংলা কী বিদেশি মুভি!!

আসলে সবকিছুই একটু একটু করে বদলে গেছে। শুধু রয়ে গেছে শুক্রবার। ঘুম ভেঙে যদি দেখি দিনটা শুক্রবার তাহলে কেমন জানি এক আনন্দস্রোত বয়ে যায় সারা শরীরে। জানি আমাকে ছুটতে হবে প্রতিদিনের মতোই। তবু এক ধরণের আলস্য ভর করে শরীরে। সকালের দিকটা সব কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা কারণ দিনটা শুক্রবার। মসজিদের ভেতরে জায়গা জোটে না, রাস্তায় বসে নামাজ পড়তে হয়, কারণ নামাজটা জুম্মার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)