সাতচল্লিশের দ্বি-জাতিতত্ত্ব তথা ধর্মভিত্তিক ইসলামী জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশ অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সত্যের উপর ভিত্তি করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচিত ও গৃহীত হয়। ওই সংবিধানে রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়, যথা: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের সময় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক অধিকার শূন্য করা হয় এবং কার্যত রাষ্ট্রকে ধর্মের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা হয়।
মনে রাখা দরকার, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার কর্তৃক যে ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারি করা হয়, সেখানেই বাংলাদেশের জনগণের জন্য ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়।
আর এই ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা রাষ্ট্রের জন্ম আদর্শকে ভিত্তি করেই বাহাত্তরের সংবিধান গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ওইদিন তিনি পরিষ্কার করেই বলেছিলেন, “বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মের ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।” ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালেও জাতির পিতা তার ভাষণে বলেছিলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। …আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়া চুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।”
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য এই যে, বঙ্গবন্ধুর এই ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বেশিদিন বেঁচে থাকল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথে কার্যত ওই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকেও হত্যা করা হলো। বাংলাদেশ পুনঃপাকিস্তানীকরণের পথে উল্টোযাত্রা করলো। দুঃখজনকভাবে আজও সেই উল্টোযাত্রাই অব্যাহত আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতা দখল করে জেনারেল জিয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করলেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকার শূন্য করার যে বিধান বাহাত্তরের সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছিলো, তা রদ করা হলো। আর সংবিধানের মূলনীতি থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মুছে দিয়ে সেখানে ‘পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’র পরিবর্তে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিস্থাপন করা হলো।
জিয়ার পরে আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনী করে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ প্রবর্তন করলেন। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সারাদেশের সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির প্রতিবাদ অগ্রাহ্য কওে সংসদে অষ্টম সংশোধনী বিল পাস করানো হলো এবং ৯ জুন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সম্মতির মধ্য দিয়ে তা আইনে পরিণত হলো। এই দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রধর্মেও সেই কালো বিধানকে বহন করে চলতে বাধ্য হয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনসহ পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর এইসব সাম্প্রদায়িক বিধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে তার জন্ম আদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পাকিস্তানকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছিল, সেই মুক্তিযুদ্ধকেই কার্যত এ দুই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে অস্বীকার করা হয়েছে। অস্বীকার করা হয়েছে লাখো শহিদের রক্তকে। মনে রাখতে হবে, একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতিদান তথা বিশেষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করা হলে রাষ্ট্রের বাকি সব ধর্মাবলম্বীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। এতে করে সংখ্যাগুরু- সংখ্যালঘুর মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন সৃষ্টি করা হয়।
শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় জনগোষ্ঠী তখন অন্যায় আর অবিচারের দিকে ঝুঁকতে থাকে আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী প্রতি মুহূর্তে কুঁকড়ে যেতে শুরু করে। কার্যত আজকের বাংলাদেশে আমরা সেই চিত্রই দেখছি। সংখ্যাগুরু ধর্মানুসারী জনগোষ্ঠী দ্বারা সংখ্যালঘুর উপর অত্যাচার, অনাচার, হামলা, নির্যাতন এখন প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত ভয়ের সংস্কৃতিতেই বেড়ে উঠছে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান বিকাশের পথ অবশিষ্ট নেই। এর ফলে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ রুদ্ধ করা হয়েছে। অথচ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ এই তিন অঙ্গিকার করা হয়েছিলো সুস্পষ্টভাবে।
সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ যখন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ প্রবর্তন করেন, তখন দেশের অন্য সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি যুথবদ্ধভাবে তার বিরোধিতা করেছিলো। তৎকালীন সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এই সংশোধনী বাতিল করবে।’ স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আরেক নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘সংবিধানের এই সংশোধনী জাতিকে বিভক্ত করবে, এই সংশোধনী গ্রহণযোগ্য নয়।’
দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি এ বিষয়ে একমত ছিল যে এই রাষ্ট্রধর্মের বিধানের সাথে বাংলাদেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মচর্চার কোনো যোগ নেই, বরং এর পুরোটাই রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এর প্রমাণও আমরা দেখতেপাই তিন জোটের (আট দল, সাত দল ও পাঁচ দল) অভিন্ন রূপরেখায়। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই তারা পরিষ্কার করেই বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রধর্মের বিধান বাতিল করা হবে।
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমানভাবেই সেদিনের অঙ্গিকার ভুলে গিয়েছে। বরং আজ রাষ্ট্রধর্মের বিধান ও ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতেই যেন এইসব দলগুলোর অঘোষিত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেওয়া জেনারেল জিয়ার বিএনপি পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধেও বিরোধিতাকারী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জামায়াতে ইসলামীর সাথে আনুষ্ঠানিক গাঁটছড়া বেঁধেছে।
আওয়ামী লীগের পালেও আজ সাম্প্রদায়িকতার হাওয়া লেগেছে জোরেশোরেই। আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বড় প্রবক্তা জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি আজকের বাংলাদেশে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ নিয়ে সুখেই আছে। ২০০১ এ ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্প্রদায়িকতাকে উগ্র-সন্ত্রাসবাদের রূপে প্রতিষ্ঠিত করে। এর বিপরীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।
সেবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল জনসমর্থনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর লক্ষ্যে একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে। স্বাভাবিকভাবেই তখন জনগণের মাঝে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবার আশা জাগে। ওই বিশেষ কমিটি সকল রাজনৈতিক দল এবং প্রথিতযশা সামাজিক ব্যক্তিবর্গের সাথে আলোচনায় বসে। জাতীয় পার্টির মতো হাতেগোণা কিছু দল ও ব্যক্তি ছাড়া প্রায় সবাই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবার পক্ষেই মত দেন।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রাধান্যে রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগ বাহাত্তরের সংবিধানে পুরোপুরি ফিরতে পারল না। চার মূলনীতি যথা: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ফেরত এলো বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রয়েই গেল।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় রয়ে গেলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যদিও তার সাথে সন্নিবেশিত বাংলা অনুবাদে ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ যুক্ত হলো, রয়ে গেলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকার। পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী বামপন্থী দল ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং ন্যাপ ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রেখে ‘হ্যাঁ ভোট’ই দিয়েছিল।
পরবর্তী কোনো সময়েও এই বামপন্থী দলগুলোর তরফ থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলে যে বেসরকারি সদস্য বিল উত্থাপনের সুযোগ ছিল, তারও কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। যদিও তারা মুখে সবসময়ই রাষ্ট্রধর্মেও বিরোধিতা করেন, তবে এ বিষয়ে তাদের হাতে যে সংসদীয় উদ্যোগের সুযোগ আছে, তার প্রয়োগে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। অর্থাৎ ধর্মেও রাজনৈতিক অপব্যবহারে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যেই একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
তাহলে একই সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তনের মাধ্যমে সংবিধানকে একটি গোঁজামিলের সংবিধানে পরিণত করা হলো। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, সংবিধানের এই মারাত্মক ক্ষতিটা করেছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ। কারণ হাইকোর্টের এক রায়ে যখন সাত্তার, সায়েম ও জিয়ার শাসনামল ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া হলো এবং পরবর্তীতে ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল ২০১০ সালে যখন সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিলেন, তখন সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ, এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিলো, “এতে করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্জীবিত হলো।” এই বিষয়ে হাইকোর্টের মতামতও ছিলো তাই। ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়েই রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ২(ক) বাংলাদেশের সংবিধান থেকে তখন অপসৃত হয়।
কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম-বিষয়ক অনুচ্ছেদটি যুক্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের স্বীকৃতি দিলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দল। ক্ষমতাসীনেরা জেনে- বুঝেই রাষ্ট্রধর্ম পুনর্বহাল করলো এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধের বিষয়টি পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনর্বহাল করলো না।
পঞ্চদশ সংশোধনী করার সময় ভোটের রাজনীতি বিবেচনায় সাম্প্রদায়িকতার সাথে আওয়ামী লীগের আপোসকামিতার নজির আমরা দেখেছি। বিশেষ কমিটির সাথে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন, “মানুষের ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়। এখানকার সমস্যা হচ্ছে যাদের ধর্মে- কর্মে মন নেই, তারাই বেশি বেশি ধর্মের কথা বলেন।” তিনি বলেন, “এটা যৌক্তিক ছিলো না। করা উচিতও হয়নি।” আবার তিনিই বললেন, “তবে ধর্ম বিষয়ে মানুষের অনেক আবেগও জড়িত। কাজেই রাষ্ট্রধর্মেও বিষয়টি সংবিধান থেকে বাদও দেওয়া যাবে না।” এই আপোসের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কতোখানি লাভ হয়েছে তার হিসাব তারাই বুঝবেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার জনগণের প্রভূত ক্ষতি হয়ে গেছে। যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সকলঅতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত করে দিয়ে গেছে, সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে বেঈমানি করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানাতে শেখায়নি, মুক্তিযুদ্ধ এক দেশে কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে আলাদা আলাদা নাগরিক মর্যাদার মাপকাঠী নির্ধারণ করতে শেখায়নি, মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর ভিন্ন মনস্তত্ত্ব তৈরি করে বিভাজিত জাতি হিসেবে বিকশিত হতে শেখায়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে বেঈমানির যে পথ জিয়া-এরশাদ সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন, খোদ আওয়ামী লীগ সেই পথই যে অনুসরণ করলো এই ক্ষতি পোষাণোর জায়গা আর কোথায়?
১৯৭২ সালে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি ধর্মনিরপেক্ষতার একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করেছি। এই চারা কেউ যদি ছিড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।” আজ রাষ্ট্রধর্ম আইনে পরিণত হওয়ার কালো দিনের ৩৫তম বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর এই ভবিষ্যদ্বাণীই স্মরণ করতে চাই।
রাষ্ট্রধর্মের দেশে রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো লাভালাভ ঘরে তুলতে পারে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই আজ অস্তিত্ব সংকটেই ভুগছে। বাস্তবতার দোহাই দিয়ে যারা রাষ্ট্রধর্ম বহালের উল্টোরথে চড়ে বসে আছেন, তাদেরকে মনে রাখতে হবে, আদর্শের পথে দৃঢ়চেতা থাকতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর নাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ান মুখে আনাও অপরাধ হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)