চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

‘আমার চরিত্রগুলোকে মুখোমুখি হতে হয় একাকীত্বের, দ্বন্দ্বের’

চিত্রকলায় আমুগ্ধ নির্মাতা টড হেইন্স। পড়াশোনাও চিত্রকলাতেই। কিন্তু সিনেমার প্রতি ছিলো প্রবল ঝোঁক। নিজের বানানো ‘সুপারস্টার: দ্য ক্যারেন কার্পেন্টার স্টোরি’ নামের শর্টফিল্মটিই তার গতিপথ ঠিক করে দেয়। ১৯৮৮ সালে নির্মিত এই শর্টফিল্মটি তৎকালীন সময়ে বিতর্ক তৈরি করলেও বেশকিছু নামিদামি ফেস্টিভালে প্রশংসা কুড়ায়। যদিও তার আরো দশ বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন প্রথম শর্টফিল্ম ‘সুইসাইড’। তবে ‘সুপারস্টার: দ্য ক্যারেন কার্পেন্টার স্টোরি’ সিনেমা অঙ্গনে তাকে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিতে মূল সহায়ক। কারণ এর ঠিক তিন বছর পরেই, অর্থ্যাৎ ১৯৯১ সালে নির্মাণ করেন প্রথম ফিচার ফিল্ম। ‘পয়জন’। এইডস’কে প্রধান উপজীব্য করে নির্মিত এই ছবিটিও তুমুল বিতর্ক তৈরি করে। টড হেইন্স নির্মিত সর্বশেষ ছবি ‘ওয়ান্ডারস্ট্রাক’। গেল বছরে নির্মিত ছবিটিও সিনে আলোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে বেশ। যদিও তার নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে ২০১৫ সালে নির্মিত ‘ক্যারল’। পঞ্চাশের দশকের সমকামী দুই নারীর গল্পে নির্মিত ছবিটি কান থেকে শুরু করে , গোল্ডেন গ্লোব, বাফটার মতো বাঘা বাঘা ফিল্ম ফেস্টিভালেও সেরার পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছে। সিনেমা নিয়ে আমেরিকার প্রখ্যাত এই নির্মাতার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় ‘দ্য টকস’-এ। গেল বছরের আগস্টে। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন কালিম আফতাব। সেখানে টডের কথায় ওঠে আসে সিনেমা নিয়ে তার ভাবনার জগৎ। ইংরেজি থেকে টড হেইন্সের এই সাক্ষাৎকারটি চ্যানেল আই অনলাইনের জন্য ভাষান্তর করেছেন জুয়েইরিযাহ মউ-

‘পয়জন’ সিনেমার একটি দৃশ্য
Bkash July

আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের পেছনে কোন ভাবনা কাজ করে?
ফিল্ম, শিল্প-সাহিত্য সমস্তই আমি এক্সপ্লোর করতে চেয়েছি তারপর বলেছি ‘হ্যাঁ তুমিও পারো এটা করতে।’। যদিও সবার সে অবস্থা থাকে না বা সবাই তা করতেও পারে না চাইলেই। প্রত্যেকের নিজস্ব পথ থাকে, নিজস্ব সংগ্রাম আছে এ পথ অতিক্রম করার এবং অর্জন করার। আমি নিরীক্ষাধর্মী ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি। আমি কখনোই প্রত্যাশা করিনি অথবা ইচ্ছেও নেই আমার কোন ফিচার ফিল্মমেকার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার।

কী করতে চাইছিলেন তবে আপনি?
আমার মনে হয় পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিলাম এক্সপেরিমেন্টাল চলচ্চিত্র বানানোর এবং শেখানোর। চারপাশে এমন অনেকে ছিল যারা উদাহরণ হিসেবে ছিল, যারা কেবল এ কাজটিই করছিল। ফিচার ফিল্মকে আমার যথার্থ মনে হতো না যে কাজগুলো আমি করতে চাইছিলাম বা চিন্তাগুলো আমি ভাবছিলাম সেগুলোর জন্য। কিন্তু অবস্থা আমাকে এমন কিছু অবস্থার দিকে নিয়ে গেল যাতে আমাকে দ্বন্দ্ব এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ের সম্মুখীন হতে হল।

Reneta June

যেমন ধরুন আপনার প্রথম চলচ্চিত্র ‘পয়জন’। যেখানে এইচআইভি/এইডস মহামারী নিয়ে?
হুম, এটা একটা ক্রাইসিস যা বাধ্য করলো অনেক শিল্পী এবং চলচ্চিত্রনির্মাতাকে কথা বলতে, কিছু করতে। নিজের জীবন বাঁচানোর একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো এটা। ‘আমার জীবন সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় হতে হবে’ বলার মতোন। সবসময় এটাও নয় যে ফিল্ম কিংবা শিল্পকে এজন্যই নির্মিত হতে হবে কিন্তু মাঝে মাঝে সময় এটাও দাবী করে। আমি সেসমস্ত মানুষের সংস্পর্শে ছিলাম তখন যারা এভাবেই ভাবছিল, এটাকে বলা হচ্ছিলো ‘New Queer Cinema’। বিভিন্ন সময় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মানুষ এ টার্মটাকে দেখেছে, কিন্তু এটার পেছনে একটা কারণও ছিল।

আপনার কি মনে হয় সরকারের প্রতিক্রিয়ার জন্য এ রীতি শুরু হয়েছিল?
‘পয়জন’ এর সাথে, আমি নিশ্চিত কিছু মানুষ এ চলচ্চিত্র একেবারেই পছন্দ করেনি, কিন্তু এটা একটা বিতর্কের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল। এটা এমন একটা চলচ্চিত্র যা সমাদৃতও হয়েছিল এমনকি সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসবে(Sundance Film Festival) পুরস্কারও জিতেছিল। সেজন্য এটা পত্রিকার শিরোনামও হল। শিরোনামগুলো এই ধরণের ছিল যে ‘সমকামী চলচ্চিত্র জিতে নিল সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কার যা তোমার সরকারী করের টাকায় নির্মিত’।

এটা সম্ভবত খুবই প্রতিকূল একটা সময় ছিল ?
একদমই, এটা তখনকার কথা যখন এইচআইভি নিয়ে সমকামী-সংক্রান্ত আলোচনা তুঙ্গে। তাই রিপাব্লিকানরা আলোচনা সভা ডাকলো, আমেরিকান ফ্যামিলি এসোসিয়েশনের ডন উইলিয়াম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালেন পাবলিক আর্ট ইস্যুর একটি সিরিজ নিয়ে যার ভিত্তিই ছিল সমকামীতার বিষয়গুলো নিয়ে। তিনি বললেন – আমেরিকানদের করের টাকা থেকে এইসমস্ত শিল্পের জন্য অর্থ সহযোগিতা দেওয়া উচিৎ নয় কারণ এগুলো ‘সমালোচনাপূর্ণ বিষয়’কে প্রমোট করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তার মানে এর প্রভাব বেশ বিস্তৃতই ছিল সমাজে?
অবশ্যই। সেজন্য ‘পয়জন’ অনেকটা আকৃষ্ট করলো দর্শকদের। আমি জানতাম এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক সেজন্য আমি টিভি-মিডিয়ার সামনে গেলাম এবং কথা বললাম এসমস্ত ফান্ড দেওয়া সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। বিতর্কগুলো চমৎকার ছিল এবং আমার নিজেরও ভাল লাগছিল অংশ নিতে। এই চলচ্চিত্র এইডস নিয়ে, সমকামিতা নিয়ে, সমকামীদের দেহ নিয়ে অনেক কথাই বলে। আর নিজের সমাজের মধ্যে থেকেও সমাজের বাইরের একজন হয়ে যাওয়ার মানে কী তাও তো ভাবার বিষয়– এজন্যই এ চলচ্চিত্র আমি বানাতে চেয়েছিলাম আসলে।

পঞ্চাশের দশকের দুই সমকামী নারীর গল্পে নির্মিত ‘ক্যারল’ ছবির একটি দৃশ্য

আপনার অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো যেমন ‘সেফ’ কিংবা ‘ফার ফ্রম হেভেন’ – এগুলোও বিষণ্নতা, একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতার উপরই নির্মিত…
আমার মনে হয় আমি এমন চরিত্র নির্মাণ করি যারা মুখোমুখি হয় একাকীত্বের, দ্বন্দ্বের। যারা নিজেদের সমাজ থেকে কোন না কোন ভাবে বিচ্ছিন্ন। এবং হ্যাঁ অবশ্যই এই একাকীত্ব মাঝে মাঝে আশীর্বাদ মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনের জন্য, যেখানে আপনি প্রত্যাশাই করতে পারেন না একাকীত্বের।

আপনার পপ কালচার ফিল্মগুলোর ব্যাপারে আপনি কী বলবেন যেমন- বব ডিলন বায়োপিক, আই এম নট দেয়ার, অথবা ‘ভেলভেট গোল্ডমাইন’ যেটা রক যুগ সম্পর্কে। এগুলোকেও কি সেই একই থিমের কাজ বলে মনে হয় আপনার?
এগুলো আসলে দ্বন্দ্বমুখর। অথবা হয়তো এগুলো একাকীত্বের কথাই বলে এটা বলার মাধ্যমে যে ‘আমরা ভিন্ন অন্যদের চেয়ে।’ এমনকি বব ডিলনও এমন একজন যিনি যখন সবার দ্বারা গৃহীত হচ্ছিলেন, সমাদৃত হচ্ছিলেন তখন তিনি বললেন যে না উনি কোন দর্শক আর চাইছেন না। তিনি নিজে এই উন্মত্ততায় ডুবে গেলেন কারণ শিল্পীর ক্ষুধার্ত মন তাই চায়। এমন একটা অনুভূতি হয় যে আপনি বাইরে থেকে সমস্ত পৃথিবীটাকে দেখছেন। হয়তো ব্যাপারটা আমার সম্পর্কেও সত্য, অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য একা হতে হয়, বিচ্ছিন্ন হতে হয় আসলে।

এটা কি এমন যে ঠিক এইরকম অনুভূতি আপনি অনুভব করেন হলিউডের মধ্যে থেকে?
আসলে, কিছু জিনিসের দরকার হয় একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। বিশেষভাবে যখন চলচ্চিত্রটি বাহ্যিক চকমকির ব্যাপার নয়, অথবা এটা যখন বড় কোন স্টুডিও প্রোডাকশন নয়। আমার নতুন চলচ্চিত্র , ওয়ান্ডারস্ট্রাক, উদাহরণ হিসেবে এটার কথা বলি, এটা অদ্ভুত ব্যাপার যখন শুধুমাত্র আমাজন এটা দিতে পারে আপনাকে।

আপনি কি চিন্তিত থাকেন কোন বাণিজ্যিক কোম্পানীর সাথে কাজ করার ব্যাপারে যেহেতু আপনি স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা?
দেখুন আমি জানতাম তারা বেস্ট জিনিসটা চায় ‘ওয়ান্ডারস্ট্রাক’ এ। এই নতুন যুগের একটা অংশ তারা কিন্তু এরা অনুগত। তাদের চাহিদাটা হচ্ছে তারা বিশ্বাস করে ফিল্ম নির্মাণে, স্বাধীনধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছ থেকে তারা চলচ্চিত্র নির্মাণের চিন্তাটাকে গ্রহণ করে, এমনকি তাদের সাথে যারা কাজ করছে বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু ইন্ডি ফিল্মস থেকে এসেছে। তাই এরা যথেষ্ট আধুনিক মানুষ যারা ফিল্মের ভাষা নিয়ে ভাবছে, যারা এ অনুষ্ঠান চালাচ্ছে আমাজন-এ। এবং আপনি আসলে জানেন না এসমস্ত জিনিস ঠিক কতদিন চলবে এভাবে। কিন্তু হ্যাঁ, এটা ভালো মুহূর্ত এদের সাথে থাকাটা।

এটা দেখাটাও আপনার জন্য ভালোলাগার বিষয় নিশ্চয় যে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের বীজ আপনি বুনেছিলেন তা দ্বারা আজ আমেরিকান সিনেমা অনেকটাই প্রভাবিত?
আমার মনে হয় ভালো-মন্দ দু’টো জিনিস সবখানেই আছে, সেটা শুধু নির্বাচন করার ব্যাপার। যদি আজকের কথা বলি, দেখবেন স্বাধীন ধারার অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাই শেষ পর্যন্ত টিভি মিডিয়াতে কাজ করছেন। আমি নিজে লং-ফর্মের টেলিভিশনকে খুঁজে পেয়েছি এইচবিও (টিভি চ্যানেল) তে। এবং আমার মনে হয় আমি এ প্রোজেক্টগুলো চালিয়ে যাবো। মাঝে মাঝে এমন মনে হয় একমাত্র জায়গা হল টিভি মিডিয়া যেখানে অনেক ভয়ঙ্কর অন্ধকারের গল্প কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরে বলে যাওয়া যায়। আমরা তো এখন অনেক ক্ষেত্রে ল্যান্ডস্ক্যাপ ও ব্যবহার করতে পারছি যেখানে আরও অনেক কিছুই সম্ভব। তাই আমি ভাবি, যখন সৃষ্টিশীলতা থাকবে, সবকিছুই ভাল হবে, সব সৃষ্টিই। আমি চলচ্চিত্রের প্রেমিক, আমি চাই না এর মেয়াদ ফুরিয়ে যাক। কিছুতেই না।

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View