“তিনটে যন্তর বাজতো মাত্র। শোনা যেত কী বলছে, সেটা পরিস্কার ছেল। লালনের গানও বোঝা যেতো কালামও বোঝা যেতো। এখন ৫৮টা যন্তর বাজে, গলাই শোনা যায় না পরিস্কার। গান আর নেই, হয়ে গেছে ‘ফান’। বুঝিছো?”-কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার স্থানীয় একজন বাসিন্দা। পেশায় তিনি কাঠমিস্ত্রী, তবু গানের নেশায় ছুটে এসেছিলেন লালন মেলায়। সাধু-সন্ন্যাসী-বাউলদের মেলা যেমন তেমনি সাধারণের মিলনমেলাও হয়ে উঠে সাঁইজীর আখড়া এই মেলাকে ঘিরে। স্থানীয়রা কুষ্টিয়ায় ‘লালন মেলা’ উচ্চারণ খুব কমই করেন। বলেন–‘লালনে যাচ্ছি’।
প্রতি অক্টোবরে বাউল সাধক লালন শাহ-এর অন্তর্ধান দিবসকে কেন্দ্র করে চলে এই মিলনমেলা। এবারের লালন মেলা শুরু হল গত ১৬ অক্টোবর। তিন দিনব্যাপী এই মেলায় দিন-রাতজুড়ে মানুষের আনাগোণা থাকে আখড়ার প্রাঙ্গনজুড়ে। দিনের মেলা ঝিমোতে থাকে মেলা প্রাঙ্গণ, কয়েকটা দোকান খোলা থাকে। কিন্তু রাস্তায়, চেয়ারে, পাটি পেতে মেঝেতে-মাঠে ঘুমোতে থাকে, ঝিমুতে থাকে প্রায় সবাই। হবে নাই বা কেন! রাতভর মানুষগুলো মজে থাকে আসরে।
হ্যাঁ আসরে। আখড়া কিংবা আখড়ার আশপাশের জায়গায় বৃত্তাকারে বসে অনেক আসর। খাবারের দোকান, মোমবাতি-ধূপ-আগরবাতি-তসবী-রুদ্রাক্ষ মালার ছোট ছোট পসরা, নানান জিনিসের ছোট-বড় দোকান খোলা থাকে দিন-রাত। রুদ্রাক্ষ মালার উপকারীতা শোনাচ্ছিলেন একজন। বলছিলেন এ মালা শরীর ঠান্ডা রাখে, অসুখ-বিসুখ দূর করে। এইরকম কথা শুনতে শুনতে পার হয়ে যেতে হয় দোকানের পর দোকান। মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকতেই দেখা মিলে লালন সাঁইজির প্রতিকৃতি ভাস্কর্যরূপে দাঁড়িয়ে। যদিও সেই ভাস্কর্য যেন আরও সুন্দর হতে পারতো এমন মনে হতে পারে কারও না কারও। চারপাশে সাধু-সন্ন্যাসীদের অস্থায়ী ডেরা। কেউ চাটাই বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন, কেউ বা আবার গাছের ছায়া কিংবা সামিয়ানা টাঙানো জায়গাতেই ঠাঁই নিয়েছেন। জটাধারী সাধু, কোন বাউল একতারা হাতে, কোন বৈষ্ণবী হয়তো যাচ্ছেন পাশের ঘাটেই স্নান সেরে নিতে। কারও কাপড় মেলে দেওয়া আছে আশেপাশের গাছেরই ডালে। কোথাও আবার দলবদ্ধভাবে দুপুরের খাবার রান্নার আয়োজন করছেন কেউ কেউ। মনে হতে পারে এক মিলনমেলায় সবার বসত যেন একই জায়গায় এসে মিশেছে।
দেখা মিলবে মানুষের চরিত্রের বিচিত্র দিকের। দেখা যায় নানান অভ্যেসের মাঝে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া সন্ন্যাসীদের। কেউ কেউ তামাকের কল্কেতে টান দেওয়ার পর ধোঁয়া নাক-মুখ দিয়ে বের করেন না একবারও। কেউ বা বিশাল সাইজের তালাতে জড়ানো শেকল পরে কাটিয়ে দিচ্ছেন বছরের পর বছর, যেমন একজনের কেটে গেছে তেত্রিশ বছর এভাবেই। অদ্ভুত মজার কিংবা সেই পরিস্থিতিতে দরকারী দৃশ্যও চোখে পড়ে বৈকি। এই যেমন এক যুবক দোকান খুলে বসেছেন, তার দোকানে লালন-গান ‘আপলোড’ করে দেওয়া হয় মোবাইলে। মোবাইলের চার্জ ফুরালে চার্জও দিয়ে দিতে পারছেন যে কেউ। কিন্তু বিনিময়ে দশটা টাকা তাকে দিতেই হবে!

একতারা-দোতারা-খঞ্জনি-ডুগডুগিসহ নানারকমের যন্ত্রপাতি নিয়েও কেউ সাজিয়েছেন অস্থায়ী দোকান। স্থানীয় মানুষদের মাঝেও এসময় জেগে থাকে মেলার আমেজ। এক আশির্দ্ধো বৃদ্ধা মেলার প্রথম রাত শেষে বাড়ি ফিরছেন নাতনীর জন্য রঙিন খেলনা হাতে নিয়ে।
মূল মাজারের ভেতরে ফকির লালন সাঁই এর সমাধি, সেই সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ ভক্তদের কয়েকজনের সমাধি। লালন সাঁই এর নিজ হস্তে মুরিদ হয়েছেন এমন ভক্তরা যেন শুয়ে আছে তাঁরই পাশে। সেই সমাধিস্থলজুড়ে আগরবাতি-মোমবাতি জ্বলছে রাত-দিন। কেউ মাঝে মাঝে ছিটিয়ে দিচ্ছেন গোলাপজল। ভক্তরা প্রবেশ করছেন, শ্রদ্ধা কিংবা ভক্তি জানাচ্ছেন।
গোধূলি পার করে সন্ধ্যা আসতে না আসতেই সমস্ত এলাকাজুড়ে মোমবাতিগুলো জ্বলে উঠতে থাকে। দেখা যায় কেউ কেউ ধূপদানী হাতে ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে দিতে থাকেন আসর থেকে আসরে। পোষাকের বৈচিত্র্যও এক পরিচয় সেখানে। ‘বাউল-ফকিরেরা পরেন সাদা পোষাক, লাল যারা পরে আছেন তারা সাধু সন্ন্যাসী। আর তান্ত্রিক কিংবা শ্মশানে থাকেন এরকম সাধুরা কালো পরেন।’- এভাবেই পোষাক নিয়ে বলছিলেন জনৈক সাধক।
রাত যত বাড়ে লালনের আসর ততই জমে। এ আসর সে আসরে গানে মাতোয়ারা হয়ে পড়ে শ্রোতা-সাধক-সন্ন্যাসী লালনভক্ত সকলেই। ভেসে আসে একতারা কিংবা ডুগডুগির আওয়াজ।
‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি…
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি…’
-এরকম কথায় সুরে ভেসে যায় অন্ধকার। মেলা ভাঙে! লালন ভক্তরা ফের আগামী বছরের প্রতীক্ষায় এবারের মেলা শেষে ফিরে যান যার যার গন্তব্যে।