অপূর্বা বর্ধনের নিজের কোন স্মার্টফোন ছিল না। মায়ের স্মার্টফোনটি ব্যবহার করত সে। সেই ফোনেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ব্যবহার করতো ১৪ বছরের এই কিশোরী। স্মার্টফোনে এসব ব্যবহারের মাত্রাটা অপূর্বার মা সানি বর্ধনেরও নজর এড়ায়নি।
স্কুল থেকে ফিরেই মেয়ের স্মার্টফোনে ঢুকে পড়ার প্রবণতা এবং প্রথম শ্রেণি থেকে প্রথম স্থান অধিকার করা মেয়েটি হঠাৎ পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়ায় উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি।
মেয়ের আচরণে উদ্বিগ্ন ছিলেন জানিয়ে অপূর্বার মা সানি বর্ধন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকে ওর রেজাল্ট কিছুটা খারাপ হওয়া শুরু করে। আমি এজন্য ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম। ফেসবুকে ওর একটা ফ্রেন্ড সার্কেল ছিল। তবে ওরা কারা আমরা সেটা জানি না। কারণ অপূর্বা মোবাইলফোনটি প্যাটার্ন লক দিয়ে রাখতো, ফেসবুক থেকে বের হয়ে লগআউট করতো। আমরা পাসওয়ার্ড জানতাম না। স্কুল থেকে ফিরেই জামা-কাপড় না বদলে, না খেয়েই মোবাইলটা নিয়ে বসে পড়তো।’
‘মাঝে মাঝে রাগ করে বলতাম এখানে এতো কী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে! ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মেধা তালিকায় শীর্ষে ছিলো অপূর্বা। এই মেধার জন্যই হলিক্রসে ভর্তির সুযোগ পায় সে। গত বছর থেকে ফলাফল খারাপ হতে থাকায় বলেছিলাম, শুরু থেকে এতো ভালো ফলাফল করে না আসলে আমরা এতো আশা করতাম না। ওর স্কুলে এখন জেএসসি’র পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে শেষ মডেল টেস্ট চলছে। তিনটি পরীক্ষা ইতোমধ্যে হয়েছে, আজ রোববার অংক পরীক্ষা ছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষকে আমরা অপূর্বার বিষয়টি জানানোর জন্য ওর সহপাঠীদের বলে দিয়েছি।’
তিনি জানান, কয়েক মাস আগেও তার সঙ্গেই ঘুমাতো মেয়ে। তবে জেএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করার কথা বলে সম্প্রতি আলাদা বসার ঘরের পাশের কক্ষে থাকা শুরু করেছিলো অপূর্বা।
গত বৃহস্পতিবার ওই কক্ষেই মেয়েকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান অপূর্বার মা। এরপর হাসপাতালে নিয়ে জানতে পারেন দুই ঘণ্টা আগেই মৃত্যু হয়েছে ফুটফুটে মেয়েটির। মেয়ের এমন অকালমৃত্যুর একদিন পরে সানি বর্ধনের মোবাইলফোনে অপূর্বার বন্ধু পরিচয়ে কয়েকজন কল করে। এদেরই একজন অপূর্বার বাবা-মাকে জানায়, মেয়েটি হয়তো আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা ‘ব্লু হোয়েল গেমে’র শিকার হয়েছে।
রাজধানীর নামী স্কুলে পড়ুয়া মেয়ের রহস্যময় মৃত্যুর পর কয়েকটি গণমাধ্যমকে অপূর্বার বাবা অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্ধন জানান, ব্লু হোয়েল গেমটিকে সন্দেহ করছেন তারা।
তবে পুলিশ বলছে, এক রুশ তরুণের উদ্ভাবিত এই ব্লু হোয়েল গেমের ৫০টি ধাপের সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে আত্মহত্যা। চূড়ান্ত ধাপে যাওয়ার আগে নিজের হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে তিমি আঁকতে হয়। এরকম কোন কিছুই অপূর্বা বর্ধনের শরীরে পাওয়া যায়নি। এমনকি মায়ের যে ফোনটি সে ব্যবহার করতো সেটিও খতিয়ে দেখে কিছু পায়নি পুলিশ। তাই ফোনটিও অপূর্বার মা সানি বর্ধনের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
অপূর্বার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী বা সন্দেহ করছেন না জানিয়ে পরিবার পক্ষ থেকে কোন মামলা করা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। অথচ কয়েকটি পত্রিকায় অপূর্বার বাবা সুব্রত বর্ধনেরর বরাতে বলা হয়েছে, তার মেয়েসহ বাংলাদেশে ৬১ জন তথাকথিত ব্লু হোয়েল গেমের জন্য আত্মহত্যা করেছে।
পুলিশের কাছে এমন কোন তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে নিউ মার্কেট থানার ওসি বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় অপূর্বার বাবার বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে ব্লু হোয়েল গেমের কারণে ওনার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমরা যতদূর জানি এই গেমে অংশ নিয়ে আত্মহত্যা করাদের মধ্যে কিছু লক্ষণ থাকে। হাতে ব্লেড দিয়ে কেটে তিমি আঁকতে হয় কিংবা শরীর ক্ষতবিক্ষত করতে হয়। এরকম কোন কিছু আমরা মৃতদেহে দেখিনি। এই গেম খেলতে বেশি সময় লাগে অথচ অপূর্বা তার মায়ের মোবাইলফোন এতো সময় ব্যবহার করতে পারার কথা নয়। অপূর্বার বাবা বলেছেন বাংলাদেশে উনার মেয়েসহ ৬১ জন ব্লু হোয়েলের কারণে মারা গেছে। এরকম কোন রেকর্ড আমাদের কাছে নেই। আমরা ওই মোবাইলটিও খতিয়ে দেখেছি, তবে সন্দেহজনক কিছু পাইনি। যেহেতু মেয়ের মোবাইলফোন নয়, তাই সেটি আবার তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।’
রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের একটি ফ্ল্যাটে সপরিবার থাকেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত বর্ধন। মেয়ের মৃত্যুর তিন দিন পার হচ্ছে। বর্ধন দম্পতিকে সান্ত্বনা জানাতে এসেছেন কাছের স্বজনরা।
এর ফাঁকেই গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন সুব্রত বর্ধন। মেয়ের মৃত্যুর পর ব্লু হোয়েল নিয়ে তিনি জানার চেষ্টা করেছেন জানিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘অপূর্বার হাতে কোন দাগ দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে একা ছাদে যেতো। আমাদের বলতো পূর্ণিমা দেখতে ছাদে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। আমার মেয়েরই যদি এমন করুণ পরিণতি হয় তাহলে একেবারেই সাধারণ, গ্রামের মানুষের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা এমন কিছুর খপ্পরে পড়লে কী হবে সেটাই ভাবছি। আর কোন বাবা-মায়ের কোল এভাবে খালি হোক তা চাই না।’
তবে, সত্যিই রাশিয়া-ভারতের পর এবার বাংলাদেশে ব্লু হোয়েল হানা দিয়েছে কিনা এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই দেশের গেমিং বাজার সংশ্লিষ্টদের।
বিভিন্ন ফেসবুক গেমিং গ্রুপ কিংবা নিছক মজা করার পেইজে-গ্রুপে এই সর্বনাশা গেমের প্রচারণা আছে এবং কিশোর-তরুণদের কাউকে কাউকে গেমটি সম্পর্কে আগ্রহী হতে দেখেছেন বলে জানান গেম ডিজাইনার মোহাম্মদ মোহাইমিন তালহা।
গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাইজ আপ ল্যাবের এই ডিজাইনার বলেন, ‘আমরা গেম তৈরির জন্য বাজারে আলোচিত গেমস নিয়ে প্রাথমিক খোঁজ খবর রাখি। এটা করতে গিয়ে দেখলাম একটি গেম খেলে মানুষ আত্মহত্যা করছে এমন খবরে ফেসবুক পোস্টে অনেকেই আগ্রহী হয়ে গেমটির খোঁজ চালাচ্ছে। গেমটির মূল টার্গেট মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে অবসাদে-বিষন্নতায় ভোগা কমবয়সীরা।
‘এই গেমে একটি কমিউনিটি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এসব চ্যালেঞ্জ পূরণ করে তাদের কাছে ছবি পাঠাতে হয়। এরপর এই কমিউনিটি বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট নাম্বারসহ সকল ব্যক্তিগত-পারিবারিক তথ্য হাতিয়ে নিয়ে গেমটি খেলতে বাধ্য করে। সাধারণত ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপে এই গেমের ফাঁদ পাতা হয়। আগে গুগল প্লে স্টোরে এই গেমটি থাকলেও এখন ডার্কওয়েভে চলে গেছে। দেশে বিভিন্ন ফেসবুকে গ্রুপে-পেইজে এই গেমের তথ্য লেনদেন হচ্ছে। তবে অন্যান্য দেশে ব্লু হোয়েল গেমে একটি কমিউনিটি আত্মহত্যা করতে চ্যালেঞ্জ দেয়। এদেশে এরকম কোনো কমিউনিটি আছে বলে শুনিনি।’
ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্লু হোয়েল গেমটি ২০১৩ সালে রাশিয়ায় তৈরি হয়। ফিলিপ বুদেকিন নামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত এক মনোবিজ্ঞানের ছাত্র দাবি করে যে, সেই এই গেমের আবিষ্কর্তা।
রাশিয়ায় অন্তত ১৬ জন কিশোর-কিশোরী এই গেমে অংশ নিয়ে আত্মহত্যা করার পরে বুদেকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে তার দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। যেসব ছেলেমেয়ের সমাজে কোনও দামই নেই, তাদেরকেই সে আত্মহত্যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে ‘সাফ’ করতে চেয়েছিল বলে স্বীকারোক্তিতে জানায় বুদেকিন।