চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের রাতে প্রতিরোধকারী খোকনের বীরত্ব গাথা

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ। সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, পাড়া-মহল্লার সব জায়গায়ই আলোচনা আজ রাতেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের তথ্য সকাল থেকেই ঢাকার বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছিল।তাই বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ সাহেবের ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়িতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতা হতে শুরু করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও দেখা করছেন শেখ সাহেবের সঙ্গে।

শেখ সাহেব দলীয় ও ছাত্রনেতাদের পরামর্শ দিচ্ছেন। সবাইকে সতর্ক থাকা ও বঙ্গবন্ধু আটক হলে করণীয় কী তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন।ধানমন্ডি ৪ নাম্বার  হতে ৩২ নাম্বার সড়ক পর্যন্ত সন্ধ্যার পর থেকেই এক তরুণ জিপ গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দ্রুত গতিতে গাড়িটি ৩২ নাম্বারের দিকে ছুটে যাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ পর অন্য রাস্তায় ফিরে আসছে। সেই তরুণের বন্ধুদের মধ্যেও কৌতুহল ছিল, সে এতো বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে বার বার কোথায় যাতায়াত করছে? বন্ধুরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। রাতেই ধানমন্ডিতে নেমে আসে ভীতিকর নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ পর পর শুধু গাড়ির শব্দ। থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। সবার মনেই ভয়ের শংকা তৈরি হচ্ছে। তৎকালিন ধানমন্ডি ১ – ৩২ নাম্বার রোডের বাসিন্দারা একটি পরিবারের মতোই বসবাস করতেন। সবাই সবাইকেই চিনতেন।

আর ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর থেকে ব্যস্ত থাকা সেই তরুণের নাম আবু জাফর আকরাম উল্লাহ খোকন। টগবগে এই তরুণের বাসা ধানমন্ডি ৭ নাম্বার রোডে। তার পিতা পানা উল্লাহ সাহেব পাকিস্তান সিএসপি অফিসার। ধানমন্ডিতে সবার পরিচিত পরিবার। বঙ্গবন্ধু পাগল আবু জাফর আকরাম উল্লাহ খোকন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানেই যেতেন সেখানেই তার সঙ্গে থাকতেন। তাই বঙ্গবন্ধু তাকে খুব স্নেহ করতেন।অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধু খোকন কে বললেন, এখন থেকে তোর দায়িত্ব ধানমন্ডিতে যারা আমরা বাঙ্গালিরা বসবাস করি তাদের অবাঙ্গালি বা পাকিস্তানিরা যাতে কোন ক্ষতি করতে না পারে তুই খেয়াল রাখবি। কোথায় কী হয় মনিটরিং করবি আমাকে খবরাখবর জানাবি। আর লিডারের এই নির্দেশনা পালনের খবরটি পাড়ার খোকনের বন্ধু-বান্ধব সবাই জানতেন। তাই ২৫ মার্চ ৭১-এ সন্ধ্যার পর থেকেই ওই ধানমন্ডিতে খোকনের ব্যস্ততা ঘিরে বন্ধুরা ভাবছিলেন কী ঘটতে যাচ্ছে রাতে। খোকন কেন বারবার ৩২ নাম্বারের দিকে যাচ্ছে আবার অন্য রাস্তায় ফিরে আসছে? এমন নানান শংকা নিয়েই বন্ধুরা রাতে যার যার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। রাত যত বাড়ছে ততই যেন বিপদের আশংকা বেড়েই চলছে। এরইমধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লো পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাস্তায় নামছে। সবার আশংকা সেনারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করতে পারে। রাত ১১টার পর থেকেই রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ।

চারদিকেই সুনসান নিরবতায় শুধু গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে ধানমন্ডির বাসিন্দারা আতংকের মধ্যেই রাত পার করলেন। এর মধ্যে কারফিউ জারির ঘোষণা। সকালেই ধানমন্ডির বাসিন্দারা জানতে পারলেন বঙ্গবন্ধু বাড়িতে নেই। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করলো কিনা এটাই ধানমন্ডির বাসিন্দারা কেউ নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। ওই রাতে ৭ নাম্বার রোডের খোকনের পরিবারের কারো ঘুম ছিলো না। কারণ খোকন তো ঘরে ফিরেনি। সবাই উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রাত পার করলেন। কারফিউ চলছে।

২৬ মার্চ সকাল বেলা এক ব্যাক্তি ধানমন্ডি ৭ নাম্বার রোডে খোকনদের বাড়ির দেয়াল টপকে প্রবেশ করে জানান, এটা কি পানা উল্লাহ সাহেবের বাসা? হ্যাঁ বলার পরই ওই ব্যাক্তি জানান তাদের খোকনকে পাকিস্তানি সেনারা গতরাতে হত্যা করে লাশ ৩২ নাম্বার রোডের ওপারে ফেলে চলে গিয়েছিল। পরে তার বন্ধুরা সকালে সেই লাশ তাদের বাড়িতে নিয়ে রেখেছে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ওই রাতের এই মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ উঠে এসেছে খোকনের বড় বোন ও তার বন্ধুদের বক্তব্য।

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ খোকনের পরিচয় কখনোই প্রকাশ হয়নি কোন গণমাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় তার বাসার গেটে বা রাস্তায় একজন নিরাপত্তারক্ষী বা অজ্ঞাত পুলিশ নিহত হওয়ার সংবাদ বিবিসি বাংলাসহ আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে আজ অব্দি প্রকাশিত হয়ে আসছে। কিন্তু খোকন কোন পুলিশ সদস্য ছিলেন না। খোকন ছিলেন একজন বঙ্গবন্ধু পাগল ধানমন্ডি ক্লাবের তরুণ ফুটবলার ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই অসহযোগ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য ধানমন্ডি ৮ নাম্বার মাঠে তরুণ ও কিশোরদের ডামি গেরিলা ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছিলেন। খোকনের সব কিছুই ছিলো তার প্রিয় লিডারের নির্দেশনা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে ঘিরেই।

ধানমন্ডি ৪ নাম্বার রোডের বাসিন্দা খোকনের বন্ধু জার্মান প্রবাসী প্রয়াত ইয়াকুবের বড় ভাই ইয়াহিয়া মোহাম্মদ ১৯৭১-এর সেই ভয়াল রাতের স্মৃতিচারণ করে বললেন, খোকন আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু হলেও আমরা সবাই একসঙ্গেই চলতাম খেলাধুলা করতাম। ধানমন্ডি ১-৩২ পর্যন্ত আমরা সবাই একটি পরিবারের মতোই বসবাস করতাম। খোকন ছিলো ধানমন্ডি ক্লাবের ফুটবলার। অসম্ভব বঙ্গবন্ধু পাগল ছিল। বঙ্গবন্ধু ঢাকার যে খানেই যেতেন সেখানেই লিডারের পিছু পিছু হাজির হতেন। তাই বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক স্নেহ করতেন। ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু খোকনকে আমাদের এই ৪ নাম্বার রোডসহ ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার পর্যন্ত সকল বাঙ্গালি পরিবারগুলোর খোঁজখবর রাখা ও অবাঙালিদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাই আমরা ধানমন্ডির ততকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে রাতে তাদের ব্যাংকের জিপ গাড়িটি নিয়ে ধানমন্ডি ১-৩২ নাম্বার পর্যন্ত পাহারা দিতাম। খোকন নিজে জিপটি চালাতো, আমরা গাড়িতে থাকতাম।১৯৭১- এর ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর থেকেই খোকন ছিলেন গাড়ি নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমাদের সেই কিছু বলছিলো না। আমাদের ৪ নাম্বার রোড দিয়ে নিজেই বেশ দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে ৩২- এর দিক থেকে আসছিল আবার যাচ্ছিল।এভাবেই বেশ কয়েকবার সে যাতায়াত করে।আমরা তার ব্যস্ততায় কিছু জানতে পারছিলাম না। আমাদের ধারণা হচ্ছিল সেই হয়তো কাউকে কোথাও পৌঁছে দিচ্ছিল। এরই মধ্যে চারিদিকেই একটি গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আজ রাতে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এমন গুঞ্জন গোটা ঢাকায় বিরাজ করছিল।হঠাৎ করেই ধানমন্ডির রাস্তাঘাট নিরব সুনসান হয়ে যায়।রাত যত বাড়তে থাকে আমাদের মাঝে ততই ভয় ও আতংক বাড়তে থাকে।

রাত আনুমানিক ১১টার পর থেকেই আমরা খোকনের জিপটিকে রাস্তায় দেখতে পাচ্ছিলাম না। বন্ধুরা একে অপরের মধ্যে ল্যান্ডফোনে খোঁজখবর রাখছিলাম।এক পর্যায়ে ল্যান্ডফোনের লাইনগুলো ডেড হয়ে যায়। আমরা আরো আতংকিত হই। চারিদিক থেকে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ কানে ভেসে আসছিল। এরই মধ্যে খবর আসলো পাকিস্তানি সেনারা ৩২ নাম্বার আক্রমণ করেছে। তবে শেখ সাহেবের অবস্থানের বিষয়ে রাতে বা পরদিন ২৬ মার্চ কারফিউ থাকায় কিছু জানতে পারিনি।

ইয়াহিয়া মোহাম্মদ বললেন, ২৬ মার্চ সকালেই ছোট ভাই ইয়াকুবের কাছে খবর আসল আমাদের খোকনকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যা করে রাস্তায় ফেলে গেছে। কিন্তু এর বেশি কিছুই জানতে পারছিলাম না। তখনও কারফিউ চলছে। তবে গুঞ্জন ছিল মানুষের খাদ্য সামগ্রী ও কেনাকাটার জন্য যেকোন সময় কারফিউ শিথিল করা হতে পারে। এরই মধ্যে জানতে পারলাম খোকনের বন্ধু আলিম ও তার বড়ভাই পাক্কা খোকনের লাশটি তাদের কলানাগানের বাড়িতে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। খোকনের নিহত হওয়ার কারণ আমরা ওই সময় জানতে না পারলেও পরে জানতে পারি কলাবাগানে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের বাসার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে। খোকন রাতে আনুমানিক ১১টার দিকে তার জিপ গাড়িটি রাখতে যায় আব্দুস সামাদ আজাদের বাসায়। ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া দেওয়ান লুতফুর রহমানের ছেলে দেওয়ান আজিজুর রহমানকে খোকন বলেন, আমি গাড়িটি রেখে যাচ্ছি আমি ছাড়া এই গাড়ি আর কাউকে দিবেন না। আমি ৩২- এ যাচ্ছি লিডার একা। লিডারের কিছু হয়ে গেলে। এ সময় বাড়ির সবাই খোকনকে বলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে গেছে গুলি করছে। তাকে যেতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু খোকনের একটি কথা লিডার একা আমাকে ৩২ যেতেই হবে। এই বলেই খোকন ওই রাতে বিদায় নেন। এমনটাই বর্ণনা দিচ্ছিলেন ইয়াহিয়া মোহাম্মদ। এরপর খোকন আর জীবিত ফিরে আসেনি।

খোকনের বন্ধু আলিমের বড় ভাই ক্রীড়া সংগঠক সৈয়দ মাহবুব সোবাননী পাক্কা সেই রাতে খোকনের লাশ শনাক্ত ও উদ্ধারের লোমহর্ষক বর্ণনায় বলেন, খোকনের বন্ধু আমার ছোট ভাই আলিম, তাদের অপর বন্ধু হিরো। সাত নাম্বার রোডের রুহেল ও চার নাম্বার রোডের ইয়াকুব বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সময় থেকেই গেরিলা যুদ্ধের ডামি মহড়া ও তরুণদের ট্রেনিং দিতো। তিনি বলেন, ৭১-এর ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহতা দেখতে আমার ছোট ভাই ডেনমার্ক প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা আলিম, প্রয়াত সাবেক ফুটবলার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন পরে মেজর নাসির (সংবাদ পাঠিকা চৌধুরী রীনার স্বামী) এবং আমার খালাতো ভাই আমেরিকা প্রবাসী গোলাম সালেক বাবু ২৬ মার্চ সকল বেলা কারফিউ চলাকালেই রাস্তার পরিস্থিতি দেখতে বাসা থেকে বের হয়। চারিদিকেই সুনসান নিরবতা। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ইট ও গাছের গুড়ির ব্যারিকেড। জনমানবহীন ভীতিকর পরিস্থিতি। কিছু দূর যেতেই বর্তমান নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ (ওই সময় ইটের ক্লিপং কাচা রাস্তা)- এর ওকে স্পোর্টসের কারখানার সামনে খোকনের লাশ দেখতে পায়। বিষয়টি তারা খোকনের বাড়িতে একজন হাঁড়িপাতিল বিক্রেতা হকারের মাধ্যমে খবর পৌঁঁছায়। এরপর বন্ধুদের খবর দেয়া হয় নানান উপায়ে।

২৬ মার্চ ৭১- এর সকালের সেই শোকাবহ বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনায় পাক্কা বলেন, কারফিউ চলাকালেই প্রথমে তার লাশটি নিয়ে আমরা কলাবাগান মসজিদে যাই। কিন্তু মসজিদের ইমাম ও অন্যান্যরা মসজিদে লাশ রাখতে বাধা দেন। তারা বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জানতে পারলে আমাদেরও মেরে ফেলবে এবং পুরো মহল্লা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিবে। অশ্রুসিক্ত সৈয়দ মাহবুব সোবানী পাক্কা বললেন, বাধ্য হয়েই আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই খোকনের লাশটি আমাদের কলাবাগের বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে থাকা ইটের স্টক ভেঙ্গে ভেতরে লাশটি রেখে চারপাশে আবার ইটের স্টক দিয়ে ঘিরে সাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি কারফিউ সিথিলের জন্য। এভাবেই ২৬ মার্চ সারাদিন ও রাত পার করার পর ২৭ মার্চ সকালে কয়েকঘন্টার জন্য কারফিউ সিথিল করা হলে আমরা লাশটি একটি ঠেলা গাড়িতে তুলে ৩২ নাম্বার রোড ধরেই খোকনের ধানমন্ডি ৭ নাম্বার রোডে পানাউল্লাহ সাহেবের বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

খোকনের লাশের বিবরণ দিয়ে সৈয়দ মাহবুব সোবানী পাক্কা বলেন, তার শরীরে অসংখ্য বুলেটে ঝাঁজড়া, ডান হাত ব্রাশ ফায়ারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কারফিউ শিথিলের সময়েই দ্রুত লাশের গোসল সম্পন্ন করে আমরা ধানমন্ডি ৭ নাম্বার রোডের (ওই সময় বেড়ার তৈরি ছিল) মসজিদে জানাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করি। খোকনের বন্ধু ও আমরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আজিমপুর কবরস্থানে পৌঁছাই। কবরস্থানে উপস্থিত থাকা ধানমন্ডি ক্লাবের সদস্য, এলাকাবাসী, ফুটবলার ও বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন। যতদুর মনে পড়ে নেয়ামত উল্লাহ সাবু, রহমতুল্লাহ, নুরুল্লাহ, সালামত, আকবর, বাবুল, সুলতান, মাসুদ, হাফিজ খাদেম, হারুন, মাখন, হাফেজ মওলানা মোঃ জাকারিয়া, মোঃ ইয়াহিয়া, মোঃ ইয়াকুব, মোঃ ইলিয়াস, মোঃ আব্দুল্লাহ, মোঃ সোয়েব, আজিম শাহ্, জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশা, আলিম শাহ্, মাহফুজুর রহমান রানা, মাহমুদ হোসেন, ওসমান,রফিক, ফুয়াদ,  যোয়াদ, আলিম, রুমি, তৌফিক সুলতান মাহমুদ, আবু নাসির ও আজিমপুর কলোনিতে থাকা মোহামেডানের গোলরক্ষক সান্টু উপস্থিত হয়েছিলেন।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন ‘বিগ বার্ড’-এর অভিযানে বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বাঙ্গালির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত আবু জাফর আকরাম উল্লাহ খোকনের সাতাশি বছরের বৃদ্ধা বড় বোন সাবেক কূটনৈতিক তাহ্ মিনা খান ডলি ৫১ বছর আগে ছোট ভাই হারানোর স্মৃতিচারণে বলেন, আমার স্বামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন বাঙ্গালি অফিসার ছিলেন। তার চাকরি চলে গিয়েছিল বাঙ্গালি বলে। সেই ২৫ মার্চ রাতে হন্তদন্ত হয়ে খোকন তার দুলা ভাই (আমার স্বামী) কে বলে আপনার পিস্তলটা দ্রুত দেন, আমার হাতে সময় নাই আমাকে এখনই যেতে হবে। তখন আমার স্বামী বলে, আমার অস্ত্র লাইসেন্স করা, অন্য কেউ ব্যবহার করলে আমার অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। অস্ত্র না দেওয়ায় খোকন দ্রুত ঘরে ঢুকে আলমারি খুলে একটি ধারালো নেপালি ভোজালি (রাম দায়ের মতো) হাতে নিয়ে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে। আমরা তাকে কিছুতেই থামাতে পারলাম না। কারো কথাই শোনেনি। ওই যে ছোট ভাইকে জীবিত শেষ দেখলাম। এর একদিন পর লাশ হয়ে ফিরে আসল। এই বলেই সাতাশি বছরের ডলি চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছতে শুরু করলেন। মায়ের স্নেহে বড় করা খোকনের ছবি ও স্মৃতি আজও তিনি বুকে ধারণ করে বেঁচে আছেন।

খোকনের নিহত হওয়ার বর্ণনায় তাহ্ মিনা খান ডলি বলেন, খোকন কীভাবে নিহত হলো আমরা কেউ তা জানতে পারিনি। শুধু এটুকুই জেনেছি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করেছে। খোকন ছিল বঙ্গবন্ধু পাগল। যেখানে লিডার যেত, সেখানেই খোকন তার পিঁছু পিঁছু হাজির থাকতো। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধু তাকে বিশ্বস্ত মনে করে আমাদের ধানমন্ডির বিভিন্ন মহল্লার নিরাপত্তা ও দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন। অত্যান্ত উৎসাহের সঙ্গে খোকন সেই দায়িত্ব পালন করছিলেন বিশেষ করে তরুণদের ডামি গেরিলা ট্রেনিং।

৫১ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটে খোকনকে একজন পুলিশ ও অজ্ঞাত হিসেবে কেন প্রচারণা হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোন গণমাধ্যমকর্মী আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে জানতে আসেনি। আর খোকনের বড় শখ ছিল একজন আর্মি অফিসার হওয়ার। তাই প্রায়ই সে আমার স্বামীর খাকি পোশাক পড়ে এলাকায় জিপ নিয়ে ঘুড়ে বেড়াতো। ২৫ মার্চ ৭১- এ খোকনের পরনে খাকি পোশাক থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে নিরাপত্তারক্ষী ও পুলিশ হিসেবে প্রচার করে আসছে। বঙ্গবন্ধু ওই সময় কোন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিতেন না।

খোকনের নিহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনায় বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসলে মাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। তখন বঙ্গবন্ধু আমার মায়ের হাত ধরে বলেছিলেন, খোকনের মা আমার চোখের সামনে ওরা আমার খোকনকে গুলি করে মেরে ফেললো আমি কিছুই করতে পারলাম না। এ সময় ৩২ নাম্বারের পাশের বাড়ির একজন (নামটি মনে করতে পারছিলেন না) ব্যাংক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর পাশে দাড়িয়েই বলছিলেন, আমরা দূর থেকে দেখলাম কেউ একজন ডান হাত উঁচু করে হাতে থাকা একটি ধারালো অস্ত্র উচুিয়ে বঙ্গবন্ধুর বহন করা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গাড়িটির সামনে প্রতিরোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়।তার ডান হাত গুলিতে ঝাঁঝড়া করে দেওয়া হয়।

তাহ্ মিনা খান ডলি বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সামনেই ৩২ নাম্বারের ওই প্রতিবেশী খোকন শহীদ হওয়ার বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন।এ সময় উপস্থিত থাকা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের উদ্দেশে বলছিলেন, খোকন দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু খোকনের জন্য খুবই দুঃখপ্রকাশ করে বারবার বলছিলেন, খোকনের মা আমার খোকনকে আমি বাঁচাতে পারলাম না। ওই দিনই প্রথম খোকনের নিহত হওয়ার প্রকৃত বিষয়টি আমরা বঙ্গবন্ধু ও ৩২ নাম্বারের প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারি।

তাহ্ মিনা খান ডলি বলেন, ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরোধকারী খোকনই অপারেশন সার্চ লাইট গণহত্যার প্রথম শহীদ। খোকন ছিলেন ধানমন্ডি ক্লাবের নিয়মিত ফুটবলার। ওই সময় ধানমন্ডি দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে খেলত। আমাদের বাড়ি নির্মাণের সময় খোকন বাড়ির ইট, পাথর, সিমেন্ট নিয়ে ধানমন্ডি ক্লাবের ট্যান্ট নির্মাণে কাজে লাগিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম ঈদ জামাত ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে আদায় করেন এবং মাঠের পশ্চিম প্রান্তে ক্লাব ট্যান্ট সংলগ্ন স্থানে খোকনের সম্মানে নির্মাণ করা স্মৃতিস্তম্ভে হাত বুলিয়ে খোকনের প্রতি সম্নান দেখাতেন এবং বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার আগে পর্যন্ত ধানমন্ডি ক্লাব মাঠেই ঈদের নামাজ আদায় করে খোকনের নেম ফলকটিতে হাত বুলাতেন।

৮৭ বছরের বৃদ্ধা তাহ্ মিনা খান ডলি বলেন, বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারে প্রথম প্রতিরোধকারী আমার ছোট ভাই খোকন শহীদ হওয়ার ইতিহাস আছে মুছে ফেলা হচ্ছে। ধানমন্ডি ক্লাবে নেই তার নামফলকটি। তিনি বলেন, ৭১- এর ২৫ মার্চ রাতে আমার ছোট ভাই খোকনই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারে বাধা দিয়ে শহীদ হয়েছেন—এটা আমাদের জন্য গৌরবের বিষয়।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)