যাদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড, মুক্তিযুদ্ধের পর সেই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের পরিবারও হয়রানির শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য রাষ্ট্রের দেয়া মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকেও অনেককে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট এএম আতাউল হকের পরিবারের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান নৌ-বাহিনী ছেড়ে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ১৯৭৭ সালে এএম আতাউল হকের মৃত্যুর পর নৌ-বাহিনী থেকে ১৯৮০ সালে তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়।
এ এম আতাউল হকের ছেলে জুলফিকার আলি মাণিক বলেন, তখন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। সুগন্ধায় তিনি বসতেন, আমার মা যখন কেবল বলতে শুরু করলেন যে আমাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তখনই পূর্তমন্ত্রী পাশ থেকে বললেন, আমরা এসব জানি, ম্যাডামকে এসব বলতে হবে না। আপনি চলে যান।
রাজধানীর কল্যাণপুরের দারুসসালাম রোডে এম আতাউল হকের পরিবারকে পরিত্যক্ত একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। ৭৫’ এ বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে তাদের মতো করেই উচ্ছেদ করা হয়।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় প্রতিটি উচ্ছেদের পেছনেই স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র কাজ করেছে। বড় ভূমিকা রেখেছে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছের লোকজন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের পক্ষে সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও তিনি পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এই বিচারপতি আব্দুস সাত্তারই ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।
বিএনপি প্রতিষ্ঠার আগে ১৯৭৮ সালের ফেব্রয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল জাগদল নামে আরেকটি দল উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, এরা নিজস্ব একটা ডিজাইন, নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখেছে শক্তিটা কোথায়, সবচেয়ে বেশি শক্তি শহীদ পরিবারে।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিগুলোই নানাভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় টানা ৯ মাস পাকিস্তান সরকারের অধীনে কাজ করেছেন এমন অনেকেই পরবর্তিতে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদেও আসীন হন। এমন অনেক অভিজ্ঞ আমলা ও আইজীবীদের যোগসাজশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর বরাদ্দ দেওয়া বাড়িগুলো দখলে নেয়।
নাসিরউদ্দীন ইউসুফ আরো বলেন, কিছু ব্যারিস্টার আর প্রশাসনের লোকেরা মিলে এসব করেন। আইনের কথা বলে তারা বলছে যে শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাড়িটিতো একজন বাঙালির, কেমন করে বাঙালির? সেটা সাম রশিদের নামে বাড়ি। তিনি আবার পে কমিশনের চেয়্যারম্যান ছিলেন। তিনি আবার সাত্তার সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠঠ ছিলেন।
জিয়া সরকারের আমল থেকেই এ উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হলেও প্রেসিডেন্ট সাত্তার ও এরশাদের আমলে সফল হয় চক্রটি। জিয়া এবং এরশাদের আমলে যেসব শহীদ পরিবারকে উচ্ছেদ করা যায়নি ১৯৯১ সালে বিএনপি’র শাসনামল এবং ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর জহির রায়হানের পরিবারসহ বেশ কিছু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়।