জন্মেছিলাম ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর তাই আবার ফিরে এলো আরও একটা জন্ম দিন। পদার্পণ করছি ৮৯ বছরে। দীর্ঘায়ু হতে পেরেছি নি:সন্দেহে। প্রিয়জনদের কাছে আনন্দ সংবাদও বটে। আমার কাছেই কম কিসে? এত দীর্ঘ দিন ধরে অপূর্ব সুন্দর এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা কত কিছুরই তো সাক্ষী-একেবারে চাক্ষুষ সাক্ষী হতে পেরেছি। এ সুযোগ শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই খুব কম সংখ্যক মানুষের ভাগ্যেই ঘটে। সেই অসাধারণ সুযোগটি দিব্যি আমার ভাগ্যে জুটে গেল।
জন্মদিন কথাটিরই আলাদা একটা আবেগ আছে যেন। সে আবেগ ফেলে আসা দিনগুলিকে, সপ্তাহগুলিকে, মাস ও বছরগুলিকে মনে করিয়ে দেয়। জীবনটাকে ফিরে দেখারও সুযোগ করে দেয়।
আমার বাবা বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৪ বছর বয়স পর্য্যন্ত। ১৯৫৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আমরা তাঁকে হারাই। থেকে গেলেন স্নেহময়ী, কষ্টে ভরা জীবনের অধিকারী শেকার্ত মা, আর থাকলাম আমরা চার ভাই এক বোন। বোনটি গঘীতা বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান অল্প বয়সেই বৈধব্যের শিকার হতে হয় তাকে। বোনটির বয়স এখন ৮৬ র কাছাকাছি। তারপরে আমাদের মেজভাই বীরেশ। পাবনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান। তাকে আমরা হারিয়েছি ২০০০ সালে যখন তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। বাকী দুই ভাই ব্রজেশ ও পরেশ যথাক্রমে সেজ ও ছোট। উভয়েই বেঁচে আছে। ব্রজেশের বয়স এখন ৮০ র কাছাকাছি আর পরেশের ৭৭।
তাই বাবা স্বল্প বয়সে চলে গেলেও একজন বাদে তাঁর বাকি ৪টি সন্তানই বেশ দীর্ঘায়ু হতে পেরেছি। কত আনন্দই না হতো মা-বাবা আজ বেঁচে থাকলে। কিন্তু অত বেশী বয়স, যা তাঁরা বেঁচে থাকলে এখন তাঁদের হতো, কাউকেই বেঁচে থাকতে দেখা যায় না। সেজন্যে বেদনাবোধ থাকলেও বাস্তবতা অস্বীকার করি কি করে?
যা হোক, এই যে ৮৯ তে পড়লাম তার পেছনে যাদুটা কি? আমি নিশ্চিত, কোন অলৌকিক কারণে নয় বা কারও খাতায় মৃত্যু তারিখ লেখা আছে কিন্তু অন্য সবার মত আমিও তা জানি না-এমন কোন কারণে নয় বরং পরিপূর্ণ জাগতিক, বৈজ্ঞানিক এবং পরিবেশগত কারণে। এই কারণগুলি মসবার ক্ষেত্রেই সত্য তা তিনি অত্যন্ত কম দিনই বাঁচুন বা অনেক বেশী দিন। তবে এ কথা ঠিক যে তবু কোন তারিখ পর্য্যন্ত বাঁচবো তা বলা যায় না। বিজ্ঞান এখনও তা আবিষ্কার করতে পারে নি। তবে কে কোন কারণে মারা গেলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা তা সুনির্দিষ্টভাবেই বলে দিতে পারেন।
বিশ্বাস করি, আমার আয়ু বেড়ে গেল বাল্যকালেই বিজ্ঞান সম্মত দৃষ্টিভঙ্গী অর্জনের কারণে। ঐ দৃষ্টিভঙ্গী আমাকে মানুষকে ভালবাসতে, মানুষের স্বার্থে লড়াই করতে, দেশকে ভালবাসতে, দেশের মানুষকে ভালবাসতে এবং গোটা পৃথিবীকেই ভালবাসতে শিখিয়েছে। সেই লক্ষ্যে জীবনভর কাজ করে চলেছি নানাভাবে, সাধ্য শক্তি অনুযায়ী। তবে দিনে দিনে মাঠে ময়দানে জমায়েত অথবা গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রাথমিক রাজনৈতিক শিক্ষা দিয়ে কর্মী সংগ্রহ করার দৈহিক শক্তি হারিয়ে ফেলার বেদনাও কম নয়। তবু আমার কাজের দ্বিতীয় ময়দান লেখালেখিটা আজও অব্যাহত রাখতে পেরেছি এবং সেই লেখাগুলির মাধ্যমেই দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রগতিশীল শক্তির করণীয় সম্পর্কে আমার ভাবনা তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছি-থাকবো আমৃত্যু।
বাঙালি জাতির অনেকগুলি সংকটময়, দুর্য্যােগভরা জীবন প্রত্যক্ষ করেছি বাল্যকাল থেকেই। তার প্রথমটি হলো ১৩৫০ বা ১৯৪৩ এর মন্বন্তর। খাদ্যাভাব ছিল না দোকানে বা গুদামে। ছিল দরিদ্রজনদের (নিম্নমধ্যবিত্তসহ) ঘরে তাদের বাড়ীতে। মিনিটে মিনিটে মানুষের অনাহারে মৃত্যু ঘটেছে গুদামভর্তি দোকান ভর্তি চাল-গম-আটা থাকা সত্বেও। ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটির সাথে তখনও পরিচিত হইনি কারণ তখন ছিলাম নিতান্তই ১০ বছরের শিশু। ঐ সি-িকেট তখন খাদ্য পন্যের দাম এতই বাড়িয়ে দিয়েছিল যে তা কিনে খাবার শক্তি ছিল না বিপুল সংখ্যক মানুষের। ফলে হাজারে হাজারে বাঙালির ঘটেছিল এমন করুণ মৃত্যু।
পথে ঘাটে লাশ পড়ে থাকতো। সংখ্যায় তা এতই যে তা সরানোর জন্য পাবনা পৌরসভাকে একটি ট্রাক কিনতে হয়েছিল। পাবনা পৌরসভার ইতিহাসে নাকি ওই ছিল প্রথম ট্রাক কেনা ।
বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক মা গৃহিনী। তাই ঐ সংকটের আঘাত তীব্রভাবে পড়েছিল আমাদের পরিবারের উপরও। চালের দাম দুই টাকা থেকে মন প্রতি ১০ টাকায় উঠলে বাবা প্রমা গুনলেন। আবার বহুদিন জামালপুর থেকে আমার খবর না পাওয়াতে উদ্বিগ্ন চিত্তে সবাই ছুটলাম সিরাজগঞ্জ ঘাট দিয়ে জামালপুর। দিন কয়েক পরে ফিরছিলাম ট্রেন যোগে ভিন্ন পথে গাইবান্ধার বোনারপাড়া জংশন হয়ে। শেষ রাতে ট্রেনটি ওখানে থামলো। ওয়েটিং রুমে সবাই মিলে অপেক্ষা। ট্রেন বদল করতে হবে-সে ট্রেন আসবে কয়েক ঘন্টা পরে। হঠাৎ দেখি কিছু দূরে চোনারপাড়া প্লাটফর্মে জটলা। কাউকে বুঝতে না দিয়ে চুপি চুপি সেখানে গিয়ে দেখি এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবতী মহিলা চিৎ হয়ে অর্ধ ঊলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছেন মাটিতে। অপরদিকে একটি বছর খানেক বয়শের শিশু কাঁদছে আর মায়ের বুক চাপড়াচ্ছে। কিছু বুঝতে না পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম মহিলাটির অনাহারে ম ৃত্যু ঘটেছে-শিশুটি মায়ের বুকের দুধ না পেয়ে অমন করছে। চোখেল জল থামাতে পারি নি। ফিরে আসি ওয়েটিং রুমে। বসে থাকি চুপচাপ আর ভাবি মানুষ কেন না খেয়ে মরছে।
গ্রামের কাছাকাছি আতাইকুলা এসে বাবার চাকুরীর খবর পেয়ে সবাই মিলে ছুটলাম কলকাতার কাছে বিড়লাপুরে। আমরা জামালপুর থাকাকালে নিয়োগপত্রটি রেজিষ্টার্ড ডাকে বাবার নামে এসেছিল কিন্তু তাঁকে বা আমাদের কাউকে না পাওয়ায় আতাইকুলা পোষ্ট অফিসের পিওন জিতেন কাকা চিঠিটি রিসিভ করে প্রেরকের কাছে ফেরত পাঠিয়েদেন। চাকুরীটি ছিল বিড়লাপুর জুট মিলের একজন কর্মকর্তা পদে। জামালপুর থেকে বাড়ী ফেরার পথে আতাইকুলা এসেই খবরটি পাওয়া গেল। তাই হন্তদন্ত হয়ে সবাই ছুটলাম গঙ্গানদী তীরবর্তী বিড়লাপুরে। শশাংককাকা ঐ চাকুরীটি বাবার জন্যে সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু যোগদানের তারিখ উত্তীর্ণ হওয়ায় ঐ পদে অন্য একজনকে নিয়োগ দিয়ে ফেলেছেন মিল কর্তৃপক্ষ। তবু সেখানে কয়েকমাস থাকলাম গঙ্গাতীরে সকাল-সন্ধ্যা দুর্ভিক্ষজনিত লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলাম।
তবু শশাংক কাকুর অনুরোধে ওখানেই থেকে যেতে হলো। শীঘ্রই তিনি মিলের দু’জন বড় কর্মকর্তার সন্তানদের প্রাইভেট টিউটর হিসেবে বাবার চাকুরী এবং একটি স্বতন্ত্র বাসার ব্যবস্থা করলেন। বাবা আমাকে ওখানকার বিড়লাপুর একাডেমী নামক হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলেন। নিয়মিত স্কুলে যাতায়াতের পথে দেখতাম গঙ্গার তীরবর্তী রাস্তার দুই ধারে অজশ্র অনাহারে মৃতের লাশ পড়ে থাকতে।
তখন অবিভক্ত ভারত ঐক্যবদ্ধ বাংলা ইংরেজ শাসনাধীন। বলা হয় ইংরেজরা আইনের শাসনের দৃঢ় অনুসারী, ঘোর দুর্নীতি বিরোধী এবং প্রজাবৎসল। তার নমুনা পথে ঘাটে সারা বাংলা জুড়ে দেখলাম। কী ভয়াবহ চিত্র। তবে এই ঘটনাবলী আমার অবচেতন মনেই আমাকে বৃটিশ-বিরোধী, দুর্নীতিবাজ ব্যাসায়ীর প্রতি অসীম দরিত্র ঘটনা ও মানুষের প্রতি দরদী করে তুলেছিল।
এর কয়েক বছর পরে ১৯৪৮ এ আমরা সপরিবারে পাবনা শহরে স্থায়ীভাবে চলে এসে অষ্টম শ্রেণীতে পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনষ্টিটিউশনে ভর্তি হই। ঐ বছরেই রাষ।ট্রভাপষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেই। শুরু হলো হাঁটি হাঁটি পা পা করে রাজনীতির ময়দানে বিচরণ। অত:পর এই লক্ষ্যে ১৯৫০ এ সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে শিখা সংঘ গঠন ও তার ঐতিহাসিক কার্যকলাপে সক্রিয় ভূমিকাগ্রহণ এভং এর পর দলে বলে ১৯৫২ সালের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করে ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে প্রায় সার্বক্ষণিক আত্মনিয়োগ। ১৯৫৫ তে আওয়ামী লীগে যোগদান আবার ১৯৫৭ সালে ণ্যাপ গঠনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আত্মনিয়োগ। ১৯৫০ থেকে এভাবে ১৯৭২ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ-এই ২১ টি বছর ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়।
বাঙালি জাতি পাকিস্তানের গোটা আমল জুড়ে যে নিপীড়ন-ডির্য্যাতন-শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য-ভেদনীতি-সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন-তার বিরুদ্ধে ইতিহাস রচনাকারী আন্দোলন-সংগ্রামের একজন দায়িত্বশীল সক্রিয় কর্মী হওয়াতে গর্ববোধও কম নয়। সে লড়াই একের পর এক সফল হয়েছে-একটাতেও হারিনি আমরা। এক কঠিন ঐক্যে বাঁধতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে। সেই ঐক্যই হয়ে পড়লো সাফল্যের চাবিকাঠি।
এ ছাড়াও, ন্যাপ প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাষানী, শেখ মুজিবর রহমান, ক মরেড মনি সিংহ সবাই অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন দেশ ও দশের স্বার্থে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে তীব্র ও ধারাবাহিক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে। এতে হতে পেরেছি একজন সক্রিয় অংশীদার। জেল খাটতে হয়েছে ৮/১০ দফায় সাকুল্যে ১৩-১৪ বছল বিনাবিচারে কিন্তু দমাতে পারে নি।
১৯৫৯তে ২৬ বছল বয়সে ঠিকই বন্ধনে আবদ্ধ হই নাটোরের সাবেক জোতদার প্রয়াত সুধীর নাথ তালুকদারের জ্যেষ্ঠ কণ্যা পূরবীর সাথে। একটি সংস্কৃতিমনা দায়িত্বশীল এবং আজীবন সংসার জীবনের কঠিন-কঠোর সংগ্রামে সফল। আমার দীর্ঘ জেল জীবন বিয়ের পর থেকেই শুরু হয়-জেলেই কাটে যৌবনকালটা। ক্লান্তিহীন পরিশ্রম, বাড়তি লেখাপড়া, শিক্ষকতার চাকুরী সংগ্রহ করে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ, সন্তানদের লেখা পড়া, মেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষা সবই চিরসাথী পূরবীরই অবদান। বারংবার নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বড় বড় হাসপাতালে থাকতে হয়েছে সেখানেও সঙ্গী পূরবী। যতটুকু যা রাজনীতিক্ষেত্রে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হতো না পূরবীর অকৃপণ সহযোগিতা না পেলে। এমন কি, পাকিস্তান অবজার্ভারের পাবনাস্থ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করা কালে দু’দফা জেলে গেলে সম্পাদক বার্তা সম্পাদক এবিএম মুসাতে বিকল্প ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলে মুসা ভাই সে দায়িত্ব অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পূরবীকেই দিয়েছিলেন-সে দায়িত্বও পালন করেছেন পূরবী সাফল্যের সাথেই। তার কবিতাগুচ্ছ নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়ে তৃপ্তি সহকারে তাল পালন করেছি।
জীবনবোধ, সমাজ, সংস্কৃতি, জাতীয় চেতনা বাল্যকাল থেকেই শিখাসংঘ, ছাত্র ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( গোপনে কমিউনিষ্ট পার্টি) গড়ে তুলেছে যা গর্বের সাথে ধারণ করি সভ্য মানুষ হিসেবে দাবীও করি।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা জীবনের প্রধানতম ব্রত। সেই ব্রতে পূর্ব বর্ণিত সংগঠনগুলি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। দীর্ঘ কারাজীবনও বৃথা যায় নি। সময়টা কেটেছে মার্কসবাদ লেনিনবাদের বই গোপনে সংগ্রহ করে পড়ার মাধ্যমে। অল্প স্বল্প যা লিখেছি তা ঐ জেল নাম বিশ^বিদ্যালয় থেকেই-আর লিখেছি রাজপথের আন্দোলনর অভিজ্ঞতা থেকে। সমাজতন্ত্র একদিনে আসবে না-এটি একটি মৌলিক শিক্ষা-তবে শোষিত ও সচেতন মানুষেরাই তা একদিন আনবেনই এ বিশ্বাস মনে সুদৃঢ়।
আর ঐ যে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে সেই লক্ষ্য নিয়েই তো ভাষা আন্দোলন থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। সর্বত্র সফলতার বিশাল র্অন। কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধ। সর্বত্র সফলতার বিশাল অর্জন। কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধের এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে স্পষ্টই চোখ পড়ছে সমাজতন্ত্র যেন দূরে সরে যাচ্ছে আবার দেশটাকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে শোষণে লিপ্ত হয়েছে কোটিপতি -পুঁজিবাদীরা। ধর্মকেতারা ব্যবহার করছে তাদের ধন সম্পদ বাড়ানোর লক্ষ্যে-মানুষে মানুষে বিবেদ সৃষ্টি করছে যাতে মানুষ ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে।
অত্যন্ত আশাবাদী চিত্তে অপেক্ষা করছি, নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে অর্থ। বিত্ত, লালনা পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি মোণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে যে দিন তুলবে সেই শুভ দিনটির অপেক্ষায়। সে দিনটি দেখে যেতে চাই।
সংকট তো নিজে, পূরবীকে, সন্তান প্রবীর, প্রলয়, মধুমিতা, মালবিকা, মৌসুমী অর্থাৎ স্ত্রী-পুত্র-কণ্যা মন্তানদের শিক্ষা, আর্থিক অনটন, এমন কি অনাহারও বাদ যায় নি।
আবার প্রাপ্তির দিকও বিশাল। বাবার মৃত্যুর পরে রিক্ত হস্ত জনিত তাঁর শেষকৃত্য কিভাবে করবো ভাবছিলাম যখন-তখনই হঠাৎ ছুটে এলো সহকর্মী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা, কর্মীরা-এলো ছাত্রলীগ কর্মীরাও উদার হস্তে। মিটে গেল সমস্যা। ৫৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাবার উদ্দিপনায় একুশে উদযাপন করে গভীর রাতে বাসায় ফিরতেই বাসা ঘেরাও, ভোরে গ্রেফতার যুক্ত ফ্রন্টের কাজে বিঘœ সৃষ্টি করতে আরও অনেক সহকর্মীর সাথে। ঐ প্রথম জেলে গেলাম কিন্তু ওখানেই শেষ নয়। ৮/১০ দফায় ১৩/১৪ বছর জেলে থাকতে হয়েছে বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই। পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপিঠের শিক্ষকতার চাকুরী ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকদের তীব্র আপত্তি সত্বেও আইউবের সামরিক শাসকের কড়া নির্দেশনা, কোন বামপন্থী শিক্ষককে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাখা চলবে না-এমন পরিস্থিতিতে কমিটি বাধ্য হলো পদচ্যুত করতে।
সপরিবারে পাবনা এসে এক ব্যাংকের চাকুরীর জন্য লিখিত পরীক্ষা দিয়ে সারা প্রদেশের শত শত চাকরী প্রার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায় কর্তৃপক্ষ নিয়োগপত্র সহ স্বাক্ষর করে ডেসপাচ বিভাগে পাঠালে গোয়েন্দা বিভাগ ব্যাংককে চাকুরী নিয়োগ না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়াতে চাকুরীটি হলো না। অথকষ্ট আর জেল, রাজনীতি ও আর মিছিলকে থামাতে পারে নি। তবে পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন পার্টি এবং সরকারও এক ধরণের ভাতা প্রবর্তনের পর। জেল জীবন শেষ হলো ১৯৭৭ সালে জিয়ার আমলে এসে। এরশাদ আমলে তিনবার বাড়ী তল্লাসী করেছে কিন্তু ধরা না দিয়ে মিছিল করেছি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। মিছিল শেষ হওয়ার আগেই কেটে পড়েছি পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে। চার পাঁচ খানা পাঠক প্রিয় বই লিখেছি। অসংখ্য প্রতিষ্ঠান থেকে দেশ-বিদেশে সম্বর্ধনা পেয়েছি। অবশেষে সাংবাদিকতায় একুশে এদকও। মানুষের কতই না ভালবাসায় সিক্ত আমি। ৮৯ তে পা দিতে পেরে গর্বিতও।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)