চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘৫৭ ধারার ‘লাঠি’ সরিয়ে ডিজিটাল আইনের ‘বটি’ গ্রহণযোগ্য নয়!’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বাংলাদেশ লেখক ঐক্যের বিবৃতি

বাংলাদেশ লেখক ঐক্য জানিয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লেখক সম্প্রদায়ের লেখালেখির অধিকারকে সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ করবে; চিন্তার উপর তাদের সবসময় সেন্সর আরোপ করে চলতে হবে; তাদের মনোজগতে এক ভীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। তাই বাংলাদেশের লেখক সমাজ এই আইন প্রত্যাখ্যান করছে।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ লেখক ঐক্য এসব কথা জানায়।

বিবৃতিতে তারা জানান, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে অনুমোদনপ্রাপ্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি নিবর্তনমূলক আইন বলে প্রতিভাত হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে এদেশের লেখক-সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ তীব্র আপত্তি তুলেছিল। উচ্চ আদালত এই ধারার বিপক্ষে মতামত রেখেছিল। এর এক পর্যায়ে সরকার সেটা বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নিয়েছিল।

এমন পদক্ষেপে আমরা ধারণা করেছিলাম, সরকার আর কোনো ভুল পথে হাঁটবে না। কিন্তু আমাদের সেই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কারণ ৫৭ ধারার চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর ধারা এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেমন: এর ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা ও ২৫ লাখ জরিমানা।’ এই ধারা লেখক, গবেষক, সাংবাদিক সবার জন্য ভয়াবহ বিপজ্জনক।

এ আইনের অন্যতম মানবাধিকারবিরোধী দিক হলো এর মোট ১৪টি ধারার ক্ষেত্রে যেকোনকিছু আমলযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য এবং রকমভেদে শাস্তির মাত্রা অতি উচ্চ। এতগুলো ধারা জামিন-অযোগ্য রাখা এবং শাস্তির মাত্রা দেখে আমরা ধারণা করতে পারি এই আইনটি প্রবর্তন করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারী, লেখক ও সাংবাদিকদের নিবর্তন করার জন্য।

এ আইনে অনেক বিষয়ের পরিপূর্ণ সংজ্ঞায়ন নেই। এরকম অস্পষ্টতার ফলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার যেমন যথেচ্ছাচার ব্যবহার হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তা ঘটার সুযোগ আরো বেশী। লেখক, গবেষক, সাংবাদিক কিংবা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী যেকারোর জন্যই এ আইনের ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, এর ৪৩ ধারায় পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, জব্দ ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই দেশে ‘গুম’ ‘অপহরণ’ এর পাশাপাশি নানান রকম পুলিশী হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। তাই, পুলিশকে দেওয়া এ ক্ষমতারও অপপ্রয়োগ ঘটবে বলে আমরা আশঙ্কাবোধ করছি। এতে জননিরাপত্তার পরিবর্তে জনহয়রানি বাড়বে, পুলিশী হয়রানি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে।

এই আইন বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ ধারা এবং তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকে সব ধরনের মানুষকে এই আইন বঞ্চিত করবে। কারণ এর ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কারো মানহানি প্রভৃতি বিষয়কে অপরাধক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফলে এ আইন যেকোনো বিরুদ্ধ মতকে ‘মানহানি’ বা ‘ব্যক্তির ভাবমূর্তি’ বিনষ্টকারী বলে দমন করার ভিত তৈরি করছে। আবার ‘ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির’ অযুহাতে তথ্য না দেওয়ারও একটি ক্ষেত্র রচনা করেছে।

এই আইনে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দটি বাদ দিয়ে বিতর্কিত অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ কে সন্নিবেশ করা হয়েছে। আমাদের বোধগম্য নয়, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে দেশে যখন অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতে চলেছে, তখন মান্ধাতা আমলের সেই নিবর্তনমূলক আইন সন্নিবেশ করার মাধ্যমে সরকার কী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়?

আমরা জানি নতুন ডিজিটাল বাস্তবতার উপযোগী আইন প্রণয়ন করা দরকার, কিন্তু সেই আইন হতে হবে ব্যবহারকারীদের জন্য সমর্থনমূলক, নিবর্তনমূলক নয়। তাই এই বিষয়ে আমাদের দাবী সুস্পষ্ট:

ক. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ও নিবর্তনমূলক ধারাগুলোকে (যেমন ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২, ৪৩) রদ করতে হবে।

খ. এই আইনের প্রত্যেকটি ধারাকে জামিনযোগ্য করতে হবে এবং শাস্তির মাত্রা কমিয়ে অন্যান্য আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে।

গ. পরোয়ানা ছাড়া পুলিশের অবাধ গ্রেপ্তারের, তল্লাশী করার ও জব্দ করার ক্ষমতা থাকতে পারবে না।

লেখক সমাজ আগামীর বার্তা আগে শুনতে পায়। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের লেখক সমাজের ভূমিকা অতি উজ্জ্বল। তাই আমরা মনে করি এ বিষয়ে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমাদের দাবিগুলো বিবেচনা করে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

স্বাক্ষরপ্রদানকারী বাংলাদেশ লেখক ঐক্যর সদস্যবৃন্দ:

১। ইমতিয়ার শামীম

২। মঈনুদ্দিন খালেদ

৩। জাকির তালুকদার

৪। জি এইচ হাবীব

৫। আহমাদ মোস্তফা কামাল

৬। রাখাল রাখা

৭। চঞ্চল আশরাফ

৮। রায়হান রাইন

৯। সামিনা লুৎফা

১০। আলমগীর খান

১১। আরশাদ সিদ্দিকী

১২। শওকত হোসন

১৩। ফাহমিদুল হক