সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে: সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫০০ বছরেরও অধিক পুরনো মাটির মসজিদ ফুজাইরার আল বিদিয়া মসজিদে দীর্ঘ ১১ বছর ইমামতি করেছেন বাংলাদেশি হাফেজ আহমেদ। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ওই ইমামের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে মসজিদটি ঘিরে।
ফুজাইরা শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে আল বিদিয়া নামক স্থানে ৫৩ বর্গমিটার (৫৭০ বর্গফুট) আয়তন জুড়ে মসজিদটি নির্মিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ফুজিরাহ প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে মসজিদটির নির্মাণ কাল নিয়ে তদন্ত করে। সে তদন্ত অনুসারে ধারণা করা হয়, এটি ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে লোকমুখে শোনা যায়, ইসলাম প্রচারের জন্য আগত কিছু সাহাবা হাজার বছর আগে পাহাড় কেটে এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন।
দেশটির ঐহিত্যবাহী ও প্রাচীন নিদর্শনের একটি ওই মসজিদ। প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছাড়াও এটি উন্মুক্ত থাকে বিশ্বের নানা প্রান্ত হতে আসা মুসলিম-অমুসলিম পর্যটকদের জন্য। সম্প্রতি মসজিদটিতে দশর্ণাথীদের প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানালেন সেখানে দায়িত্বরত বাংলাদেশি ইমাম হাফেজ আহমেদ। মসজিদ সাময়িক বন্ধ থাকায় আপাতত অন্য মসজিদে ইমামতি করছেন বলেও জানান তিনি।
মাটির প্রাচীনতম ওই মসজিদের সঙ্গে তার ভাল লাগার কথা উল্লেখ করে হাফেজ আহমেদ বলেন, ’এক সময় দুনিয়া ঘুরে দেখার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মানুষের অল্প আয়ুর জীবনে তা অসম্ভব! তবে আল্লাহ তায়ালা আমার মনের আশা পূরণ করার জন্যেই হয়তো এ মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রাচীন এ মসজিদে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শ্রেণীর লোক আসা যাওয়া করে। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে আমার বিশ্ব দেখাও হয়ে যাচ্ছে। ‘
আল বিদিয়া মসজিদের ইতিকথা জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘স্থানীয় আরবরাও এর নির্মাণ সাল সম্পর্কে সঠিকভাবে জানেন না। তবে বোর্ডে লেখা রয়েছে প্রায় ৫৬০ বছর পূর্বে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি কখন, কে নির্মাণ করেছে একমাত্র আল্লাহ’ই ভাল জানেন।’
ওই মসজিদে কাজ করার আগে তিনি কালবা কর্ণেশ মসজিদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখান থেকে মাঝে মাঝে দেখতে আসতেন আল বিদিয়া মসজিদ। কখনো পরিবার নিয়ে, কখনো বা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে। মসজিদের প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ তৈরি হয়ে যাওয়ায় হয়তো আল্লাহ সে উছিলায় তাকে এখানকার ইমাম করে দিলেন, এমনটাও তার ধারণা।
সাময়িকভাবে মসজিদটি বন্ধ থাকায় নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে ইমাম হাফেজ আহমেদ বললেন, ‘মাঝে মাঝে চিন্তা করি, এ মসজিদে আমার আগেও দায়িত্ব পালন করেছেন বহু ইমাম। তাদের কারোই এখন আর খোঁজ খবর নেই। একদিন আমিও আর থাকব না। তখন কেউ আমারও আর খবর নিবে না, খবর থাকবে না। কেউ আর জিজ্ঞাসাও করবে না। তবে এটা সত্য, আল্লাহ’র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে নেক কাজ করে যেতে পারলে দুনিয়া এবং আখেরাতে আমরা কামিয়াব হতে পারব।’
ঐহিত্যবাহী ও প্রাচীন নিদর্শনের অন্যতম ফুজাইরার আল বিদিয়া মাটির মসজিদটি সম্পর্কে জানতে পর্যটকদের নিত্যদিন ভিড় থাকে এখানে। এ মসজিদের পুরোটাই কাঁচামাটি ও পাথরের তৈরি। চারপাশের দেয়াল ছাড়াও একটি মাত্র মাটির পিলারের উপর ভর করে আছে ৫শ বছরেরও পুরনো এই প্রাচীন মসজিদ। কাঁচা মাটি দ্বারা প্লাস্টারের স্তর দেয়া আছে দেয়ালে। বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হলেও বর্তমানে দেয়ালের কিছু কিছু জায়গা থেকে প্লাস্টারের স্তর খসে পড়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে কয়েকবার দেয়ালের রঙও পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রার্থনা কক্ষের মধ্যে কোনো জানালা নেই। তবে বাতাস যাতায়াতের জন্য মূল ফটকের ওপর কিছুটা অংশ প্রায় সময় খোলা থাকে।
এছাড়া আলো আসার জন্য ছোট ছোট কয়েকটা ফাঁকা জায়গা রাখা আছে। মসজিদের ছাদে ভিন্ন রকমের চারটি গম্বুজ, প্রার্থনা কক্ষের ভেতরে ছোট মিহরাব ও একটি মিম্বার, মসজিদের সামনে একটি পানির কূপ ও পেছনে দুটি দুর্গ আছে। ভেতরের দেয়ালে কিছু কিছু অংশে অতি সাধারণ কারু করা শিল্পের নিশানা রয়েছে। কোরআন রাখার জন্য দেয়ালের চারপাশে ঘনক আকৃতির বক্স করা আছে। মসজিদের ভেতরে কিছু কোরআন শরিফ, চারটি বাতি, দুটি এসি, মাইক, একটি দেয়ালঘড়ি ও একটি বিদ্যুৎচালিত পাখা আছে। এছাড়া এখানে অতি প্রাচীন একটি কুল গাছও রয়েছে।
দুর্গ দুটি সম্পর্কেও মতপার্থক্য আছে এখানকার অনেকের। কেউ বলছে, আজান দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো এই দুর্গ, আবার কেউ বলছে, সাহাবারা যুদ্ধের সময় নিরাপত্তার জন্য তৈরি করেছেন দুর্গ দুটি। দুর্গের কাছে গেলে আরব্য উপসাগরের অংশ বিশেষ দেখা যায়। জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত না হলেও প্রতিদিন এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। পুরনো এসব নিদর্শন ছাড়াও ২০০৩ সালের মার্চে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটি নিজস্ব অর্থায়নে মসজিদের বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পর্যটকদের সুবিধার্থে নির্মাণ করেছে মহিলা ও পুরুষদের জন্য আলাদা অজুখানা, বিশ্রামের জন্য আলাদা কক্ষ, দুর্গে যাতায়াতের জন্য পাথরের সিঁড়ি, সীমানা প্রাচীরসহ মসজিদের পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি বাগান।
এছাড়া এখানে দুটি দোকানঘরও রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় দিবসে আমিরাতের ঐহিত্যবাহী জিনিসপত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় এখানে। ফুজিরাহসহ পুরো আমিরাতের অনত্যম দর্শনীয় স্থান এটি। প্রতিদিন আল বিদিয়া মসজিদ প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকদের ভিড়ে থাকে মুখরিত পরিবেশ।
ঐতিহ্যবাহী আল বিদিয়া মসজিদের অবস্থান ফুজিরাহ শহরের দিব্বা-খোরফাক্কান সড়ক হয়ে শারম থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার ও সানদী বিচ থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দক্ষিণে আল বিদিয়া নামক স্থানে। দর্শণার্থীদের জন্য প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এটি উন্মুক্ত থাকে। এ ছাড়াও এখানে আসা পর্যটকরা ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে ফুজিরাহ, খোরফাক্কান ও কালবা বিচ। যেমন রয়েছে এখানে উন্নতমানের খাবার হোটেল, তেমনি থাকার জন্য রয়েছে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই ফুজিরাহ রোটেনা, লি মেরডিয়াম ও খোরফাক্কান ওশিয়্যানিক হোটেল। নামাজ আদায়ের জন্য রয়েছে একটি বড় মসজিদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বেচা-কেনার জন্য আছে একটি বড় বাজার।