বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বছরে লেনদেনের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা। শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া এ টাকায় ভ্যাট বসালে তাতে তিনশ কোটি টাকার বেশি আসবে না। তবে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষার এ অর্থনীতিকে সাধারণ দোকানদারি হিসেবে না দেখার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরা শিক্ষাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে কাঁচাবাজারের পণ্যের সঙ্গে তুলনা না করার পরামর্শও দিয়েছেন।
তাদের মতে, শিক্ষার প্রসার ঘটাতে শিক্ষার উপর কোনো ধরণের বাড়তি চাপ তৈরি নয়, বরং শিক্ষার্থীদের বেতন ফি যাতে না বাড়ে সরকারকে সে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একই সঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ক্রমাগত শিক্ষার মান বাড়ানো যায় সেদিকে।
বাংলাদেশের ৬৩ শতাংশ উচ্চ-শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের উপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হলে সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থীর টিউশন ফি থেকে আড়াইশো-তিনশো কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারে আসবে না বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। এই বাড়তি টাকা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উপর যতোটা নেতিবাচক প্রভাব আনবে সরকারের কার্যক্রমের তার বিন্দুমাত্র ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে তারা মনে করছেন।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেছেন, এই খাত থেকে মোট অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ খুবই তুচ্ছ। সারা বাংলাদেশে গত দুই বছরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে ভ্যাটের পরিমাণ কোনোভাবেই উল্লেখ করার মতো না। শিক্ষাক্ষেত্রে এই বাড়তি টাকার চাপ তৈরি না করলে সেটা বরং দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে।
আরেক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদও বলেন, এই ভ্যাট সরকারের উপর তেমন কোনো প্রভাব আনবে না, কিন্তু সেটা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের উপর অনেক প্রভাব ফেলবে। একজন অভিভাবক যিনি কিনা সন্তানের পড়াশোনার জন্য আগে প্রতি সেমিস্টারে ৫০ হাজার টাকা দিতেন সেটা ৫৮ হাজার হলে অবশ্যই তাদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ সিট রয়েছে, শিক্ষার্থীর তুলনায় সেটা অনেক কম। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের সবার পরিবারেই যে স্বচ্ছলতা রয়েছে, তেমনটা নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এখন পড়াশোনা করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুতরাং বাড়তি টাকার পুরোটাই তাদের উপর বাড়তি চাপ হিসেবেই আবির্ভূত হবে বলে তারা মনে করেন।
এই খাতটি বাধাগ্রস্ত হলে দেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব আসবে, সেই প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য কোনোভাবেই সরকার বন্ধ করতে পারছে না। আবার সরকার বেসরকারি শিক্ষা খাতকে কাঁচাবাজারের পণ্যের মতো দেখছে। সেখান থেকে লাভ আদায় নয় বরং শিক্ষার উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। সরকার যদি ভ্যাট বাড়ায় তাহলে একসময়ে গিয়ে ওরা টিউশন ফিও বাড়িয়ে দেবে। ফলে শেষ পর্যন্ত সেটা শিক্ষার্থীদের উপর গিয়েই বর্তাবে।
চলমান এই সমস্যা সমাধানে সরকার ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের মধ্যে আলোচনা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকার ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্বটাও দূর করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, এখন হয়তো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে এবং সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মালিকরা বলে বসবে আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভ্যাটের বাড়তি টাকা গ্রহণ করবো না। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেটা কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। তাছাড়া এই বাড়তি আদায় করা ভ্যাট দেশের অর্থনীতির কোন কাজে ব্যবহৃত হবে সেটাও কেউ ব্যাখ্যা করতে পারবে না। তাই শিক্ষা খাতকে মুক্ত করে দিয়ে সরকারের উচিত মন্ত্রীদের গাড়ির উপর বাড়তি কর আদায় করা।
আবু আহমেদ বলছিলেন, সরকারের জন্য এই টাকাটা বেশি নয়। তবে কেবল সার্টিফিকেট তৈরি করা নয়, শিক্ষার্থী ও মেধাবীদের যেন উপকার হয় সেসব দিকেই বেশি নজর দিতে হবে সরকারকে। ব্যবসার চেয়ে বড় শিক্ষার্থীদের সুবিধা দেওয়াটাই আগে নজরে আনা উচিত।
তাই এই খরচ নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের উপর চাপ তৈরি না করে যদি সেটা সরকারের লোকসানও হয় তাহলে সেটা করার মন্তব্যই এই দুই অর্থনীতিবিদের। কারণ তারা মনে করেন, শিক্ষার উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন।