গণতন্ত্র সংগ্রামের প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে গণতন্ত্রের শহীদ যোদ্ধা নূর হোসেনের কথা। চোখে ভেসে ওঠে রোগা-শ্যামলা এক নগ্ন পিঠে সাদা রঙের লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। অখ্যাত যুবকের মনের কথার সেই ছবিটি তুলে বিখ্যাত হন ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে তার তোলা ওই ছবিটি, ২৮ বছর পূর্ণ হলো আজ।
১৯৮৭ সালের বিশেষ সেই দিনটির স্মৃতিচারণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন পাভেল রহমান। সেখানে তিনি লিখেছেন:
‘আমার এই ছবিটির বয়স আজ ২৮ বছর।
১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর আজকের এই দিনে জন্ম নিয়েছিল আমার ছবি ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। ছবিটির বয়স আজ ২৮সে পূর্ণ হল। আমি একজন সৌভাগ্যবান ফটো জার্নালিস্ট যার তোলা নব্বইয়ের ঐতিহাসিক গন আন্দোলনের একটি ছবি পথ পাড়ি দিল একনাগাড়ে ২৮ টি বছর। আজকের এই দিনে যিনি তাঁর শরীরে শাদা কালিতে লিখেছিলেন এই অমরবাণী সেই অসীম সাহসী নায়ক ‘নূর হোসেনের’ আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আমি তখন একটি ইংরেজি ‘দৈনিক নিউনেশান’ পত্রিকার চীফ ফটোগ্রাফার। পত্রিকা থেকে আমাকে এসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিল ১০ই নভেম্বর ঢাকা শহরের বিরোধী দল সমূহের অবরোধ কাভারেজের। ৯ই নভেম্বরের সেই রাতে আমি যখন বাড়ির পথে সচিবালয় অতিক্রম করছি তখনই চোখে পরে সচিবালয়ের বাতিগুলি। প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে প্রতিটি ভবনের বাতি জ্বলছে। এটা একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। একজন ফটোজার্নালিস্টের চোখে তো বটেই। আমি ঢুকে পড়ি সচিবালয়ে। সচিবালয়ের বিভিন্ন ফ্লোরে দেখতে পাই মজার সব দৃশ্য। বিরোধী দলের অবরোধকে উপেক্ষা করে অফিস সচল রাখতে আগের রাতেই সরকারি কর্মচারীদের সচিবালয় রাত্রি যাপনের এই ব্যবস্থা। আমার কিছু অসাধারণ ছবি হয়ে গেল সেই রাতে পত্রিকার জন্য। অফিসের টেবিলে মশারী, বালিশের স্থানে সচিবালয়ের ফাইল! আর দল বেঁধে তাস খেলার ছবি দ্রুত উঠে পড়লো আমার ক্যামেরায়।
মধ্য রাতেই ঢাকার রাস্তায় বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ফেলল পুলিশ সদস্যরা। ভোর হতে না হতেই নিজেরাই ঢাকা শহর অবরোধ করে ফেললো সরকারি বাহিনী। ভোরের আলো ছড়ানোর আগেই আমার সুজকি ১২৫ সিসির মোটরবাইক হেডলাইটের আলো ছড়ালো রাজপথে। আমি পুরো শহর ফার্মগেট থেকে যাত্রাবাড়ী, মহাখালি থেকে সদরঘাট, রামপুরা থেকে সদরঘাট চষে ফেলি। নাহ কথাও কিছু নেই। কিন্তু পুরানা পল্টন আমাকে আটকে দিলো। ছোটো লাল পতকার সরু চিকোন কঞ্চি গুলি শীতের সকালের মিষ্টি আলোয় খেলা করছিল বিক্ষোভকারীদের হাতে। … আমার মনে হলো এটাই আমার আপাতত স্পট।
পল্টন পুলিশ বক্সের সামনে মোতায়েন দুই প্লাটুন পুলিশ। দিনের শুরুতেই শান্ত লাল পতাকাধারিদের এক পশলা ইটাইটি পুলিশের সাথে। আমার বেশ কিছু ছবি হয়ে গেল। বেলা বাড়ার পরপরই প্রেস ক্লাবের দিক থেকে ছাই রঙের চট্টমেট্রো-১০ পাজেরো জিপ নিয়ে এলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সাথে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিশাল এক বিক্ষোভ মিছিল। মিছিলের নেতৃত্ব দিলেন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। শেখ হাসিনা চলন্ত জীপের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের কণ্ঠে শ্লোগানে স্লোগানে পল্টন মোড় পেরিয়ে গুলিস্তানের দিকে চলে গেলেন। অন্য আরেক নেত্রী বেগম খালিদা জিয়া অবস্থান নিলেন বাইতুল মোকারমের উত্তর গেটে।
একটু পরের দিকে পল্টন মোড়ে অবিশ্বাস্য একটি মুহূর্ত এলো আমার সামনে। আমার শরীর ঘেষে উদোম শরীরে এক যুবক হেঁটে যায় লাল পতাকার জমায়েতের দিকে। শ্যামলা গড়ন সেই যুবকের পিঠ জুড়ে শাদা কালিতে লিখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান। আমি যেন যন্ত্র চালিত এক রোবট হয়ে যাই মুহূর্তে। আমার ক্যামেরা উঠে আসে চোখে। বাম হাতটায় ফোকাস করে ফেলে পিঠ জুড়ে থাকা শাদা কালির সেই অবিস্মরণীয় অক্ষর গুলি। আমার হৃদ কম্পনের শব্দ যেন আমারই কানে এসে লাগে। টগবগে ফুটে উঠে আমার শরীরের রক্ত। আমি স্থির থাকতে পারিনা। অস্থিরতা পেয়ে বসে আমাকে। আমি আমার ডান হাতের তর্জনীতে চেপে ধরি শাটার। অবিশ্বাস্য গতিতে আমার বুড়ি আঙ্গুল ফিল্মের এডভাঞ্চ লিভারটা টেনে আনে। মুহূর্তে আরেকটি স্নেপের জন্য তৈরি হয়ে যায় ফ্রেম। আমার ডান হাতের তর্জনী আবার চাপ দেয় শাটারে। পর পর দুটি ছবি!
মিনিট পাঁচেকের পর গুলিবিদ্ধ হলেন তিনি। গণতন্ত্রের অবিস্মরণীয় এক যোদ্ধা নূর হোসেন। আমার ছবির সেই নায়ক!!!’