১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে এ দেশীয় বিশ্বাসঘাতক চক্রটি। ইতিহাসের এই বর্বর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটির পরে অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে সারাদেশ চুপসে গিয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ না করে তখন মুশতাকের রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণকেই ফলাও করে প্রচার করে।
১৬ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় শিরোনাম ছিল: মুশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ’। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় কলামের শিরোনাম ছিল: ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ দৈনিক ইত্তেফাকে আরও শিরোনাম ছিল: উপরাষ্ট্রপতি ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ/জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ/যুক্তরাষ্ট্র স্বাভাবিক কূটনৈতিক কাজকর্ম চালাইয়া যাইবে/জনসাধারণের স্বস্থির নিঃশ্বাস/বিভিন্ন মহলের অভিনন্দন।
একই দিনের দৈনিক বাংলা পত্রিকায় শিরোনাম ছিল: খন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি/বাংলাদেশ টাইমস শিরোনাম করেছিল, পিপল থ্যাংক আর্মড ফোর্সেস, মুজিবস পিকচার রিমুভ। ডেইলী অবজার্ভার লিখেছিল: হিস্টরিক্যাল নেসেসিটি/জাস্টিস মাস্ট বি এস্টাবলিশড/প্রেসিডেন্ট ওয়ার্ক হার্ড টু ইমপ্রুভ কনডিশন/ কারফিউ রিল্যাক্স ফর জুম্মা প্রেয়ার্স।
সেদিনের দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল: রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষের আগে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন/ এরপর লেখা ছিল, শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন। ১৯৭৫ সাল ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অনন্য নজীর। বিশ্বাসঘাতকরা খুনী মুশতাকের সাথে হাত মিলালো। আর ভীরুরা নিজের জান বাঁচাতে গর্তে লুকালো।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দেশ জুড়ে ছিল কবর ও শ্মশানের নিরবতা সেই ঘাতকদের প্রতিনিধিত্বকারীরাই ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছে।সেটিও ঘটেছিল এই আগস্ট মাসেই, তারিখটি ছিল ২১ আগস্ট। তখন ক্ষমতায় চারদলীয় জোটের সরকার। ২০০৪ সালের ২২ আগস্টেও দলীয় সভাপতিকে হত্যাচেষ্টায় দল চুপসে যায় যেমন চুপসে গিয়েছিল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর ১৬ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর সময়েও আওয়ামী লীগের শত্রুরা আওয়ামী লীগকে টার্গেট না করে কেবলই টার্গেট করেছিল বঙ্গবন্ধুকে। ২০০৪ সালেও টার্গেট করেছে শেখ হাসিনাকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার গোটা কয়েক প্রতিবাদকারীরাও পায়নি রাষ্ট্রীয় ও দলীয় মর্যাদা। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত, নিহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারীদেরও মিলেনি রাষ্ট্রীয় ও দলীয় স্বীকৃতি। তাদের খোঁজখবর কেবল শেখ হাসিনাই নেন। এ হামলায় শেখ হাসিনা মরে গেলে নিশ্চয়ই তাদেরও খবর নিত না কেউ। যেমন ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডটিকে যারা মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের খবর নেয় না কেউ। শেখ হাসিনার মত যদি সেসময় বঙ্গবন্ধু বেঁচে যেতেন তখন হয়তো তারা মূল্যায়িত হত। দলীয় সভাপতির হত্যা ও হত্যাচেষ্টার দলীয় মূল্যায়ন কেন হচ্ছে না?
কেন ১৯৭৫ এর ১৬ আগস্ট ও ২০০৪ এর ২২ আগস্ট দলটি দেশব্যাপী ফুঁসে উঠলো না?সারাদেশে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা কত? সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠন কয়টি? ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের আলোচনায় যে উপস্থিতি তার ১০০ ভাগের একভাগও যদি রাজপথে হাজির হত কতজনকে গুলি করত খুনির দল? আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেতো শোক প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সর্বত্র। বঙ্গবন্ধুর ছবির সাথে নিজের ছবি সংযোজন করার পেছনে মূলত শোকের চেয়ে নিজেকে জাহিরী প্রবণতাই বেশি। এ শোক যদি যথার্থ হতো তাহলে ১৫ আগস্টের প্রতিবাদকারীদের দলীয় মর্যাদার স্বীকৃতি থাকত।
এইদিনে দলীয়ভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হতো। যদি তা-ই হতো ২১ আগস্টের শেখ হাসিনার হত্যাচেষ্টা দিনটিকে দলীয়ভাবে একটি বিশেষ দিবস ঘোষণা করা হত। সারাদেশে দলীয়ভাবে সেদিনটি পালিত হত। ২১ আগস্টে আহত নিহতরা যে যেখানেই আছে দলীয় নেতারা তাদের মূল্যায়ন করত ও খোঁজখবর নিত। কিন্তু না, এমনটি হয়ে ওঠেনি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা যেন দলকে লক্ষ্য করে নয় কেবলই শেখ হাসিনাকে। যদি তা-ই না হত যারা শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে যেয়ে প্রাণ দিয়েছে, আহত ও পঙ্গু হয়েছে তাদের মূল্যায়ন কেবল শেখ হাসিনা হতে নয় দল হতে আসত।
শোকের নামে নিজেকে জাহিরী প্রবণতারও বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তারা পোস্টারে নিজের ছবি দিয়ে লিখেছে, মরহুমা আইভী রহমান সহ সকল ষড়যন্ত্রকারী ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পোস্টারটির নিচে লেখা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকলীগ, ঢাকা মহানগর(উত্তর)। ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট বারবার আসবে যাবে আর এমন লজ্জাজনক শোক প্রকাশের প্রতিযোগিতা হবে। দল ক্ষমতায় থাকলে এসব প্রতিযোগিতা বেশি হবে আর ক্ষমতায় না থাকলে কম হবে এটাই কি তবে চিরন্তন নিয়তি হয়ে উঠছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)