সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর অভিযোগ, ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে তিনি উপপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পান নি। এরপর ১৯ আগস্ট ফর্মেশন কমান্ডারদের কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগে ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়েত জামিল তার সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘ডু নট ট্রাস্ট ইওর ডেপুটি, হি ইজ বিহাইন্ড অল দোস থিংস।’
তবে কর্নেল শাফায়েত জামিলও ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের আগে কিছু করতে পারেন নি বা করতে চান নি।
ওইসময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জানান, ১৫ আগস্ট অনুমান সকাল ৬ টায় তার (সাফায়েত) বাসভবনের দরোজায় প্রচণ্ড ধাক্কার আওয়াজ শুনে দরোজা খুলে তিনি কাঁধে স্টেনগানসহ তার ব্রিগেডের অধীন টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদকে দেখেন। রশিদের সঙ্গে নিরস্ত্র অবস্থায় ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হাফিজ এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারের অফিসার লে. কর্নেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী।
সাফায়েতকে দেখামাত্র মেজর রশিদ বলে, উই হ্যাভ ক্যাপচার্ড স্টেট পাওয়ার আন্ডার খন্দকার মুশতাক। শেখ ইজ কিলড। ডু নট ট্রাই টু টেক এনি অ্যাকশন এগেইনস্ট আস।
রশিদের কথা শুনে ব্রিগেড কমান্ডার হতচকিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান বলে সাফায়েত নিজেই তার সাক্ষ্যে স্বীকার করেছেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে সাফায়েতকে ফোন করেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ। তিনি টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করছে তা সাফায়েত জানেন কি না। জবাবে সাফায়েত মেজর রশিদের কাছ থেকে শোনা বক্তব্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর জানান।
সেনাপ্রধান তখন তাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোনে বলেছেন, আক্রমণকারীরা সম্ভবত শেখ কামালকে মেরে ফেলেছে।
সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলে সাফায়েত তার অধীনে থাকা ফার্স্ট, সেকেন্ড এবং ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন কমান্ডিং অফিসারকে টেলিফোনে ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন বলে দাবি করেন।
এ তিন ইউনিটের বাইরে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া মেজর রশিদের টু ফিল্ড আর্টিলারিও তার অধীনে ছিলো।
সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা কলে সাফায়েত ড্রয়িংরুমে গিয়ে মেজর হাফিজকে পান, কিন্তু মেজর রশিদ এবং আমিন আহম্মেদ চৌধুরীকে পাননি।
এরপর তিনি দ্রুত ইউনিফর্ম পরে মেজর হাফিজসহ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা হন। তিনি জানান: রাস্তায় জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়ে দেখেন জিয়া শেভ করছেন। ঘটনা শোনার পর জেনারেল জিয়া বলেন, সো হোয়াট প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড! ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপহোল্ড দ্যা কনস্টিটিউশন।
জিয়ার বাসা থেকে বের হয়ে ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ঢোকার মুখে একটি ট্যাংক আক্রমণাত্মক অবস্থায় দেখতে পান বলে জানান কর্নেল সাফায়েত। ট্যাংকের উপর মেজর ফারুক বসা ছিল। শুধু তাই নয়, মেজর ফারুক তার সাপ্লাই এন্ড ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সারিবদ্ধ গাড়িগুলোর উপর হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিও করে। ফলে কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হন।
কর্নেল সাফায়েত ফার্স্ট বেঙ্গল ইউনিটের লাইনের ভেতরের রাস্তার উপরে আরো তিনটি ট্যাংক আক্রমণাত্মক অবস্থায় দেখতে পান। তার দাবি, তাৎক্ষণিকভাবে ওই ট্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব ছিলো না।
৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সাফায়েত ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ইউনিফরম পরে সেখানে আসেন। তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফের বরাত দিয়ে ৪৬ ব্রিগেডের যাবতীয় অপারেশনাল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার কথা জানান বলে সাফায়েত তার সাক্ষ্যে দাবি করেন।
এ বিষয়ে মামলার ৪৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জেনারেল শফিউল্লাহ বলেছেন, তিনি সাফায়েতের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মনে হয়েছিলো, সাফায়েত মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন। তিনি তখন তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন দিয়ে আর্টিলারি এবং আরমারকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন বলেও দাবি করেন।
শফিউল্লাহ বলেছেন, বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো নড়াচড়ার আভাষ না পেয়ে তিনি সিজিএস খালেদ মোশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে সাফায়েত জামিলকে সহায়তা করার নির্দেশ দেন। তবে তার দাবি, সেসময় জিয়া বলেছিলেন: ডু নট সেন্ড হিম, হি ইজ গোয়িং টু ম্পয়েল ইট।
ওইসময়ের সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ একথাও বলেছেন: সকাল ৭টার দিকে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পর তার অফিসে তার সামনে বসা ডেপুটি চীফ জেনারেল জিয়া বলেন, সিজিএস খালেদ মোশাররফকে আর বাইরে যেতে দিও না। বরং ‘ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন দিস প্রি-টেক্সট’ উল্লেখ করে জিয়া তাকে ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করতে বলেন।
সেনাপ্রধানের দাবিমতে, সাফায়েতকে তিনটি পদাতিক ব্যাটলিয়ন তৈরি করা কিংবা খালেদ মোশাররফের দায়িত্ব নেয়া অথবা ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করা; কোনোকিছুই সেদিন আর হয় নি।
বরং সেখানে সেনাপ্রধানকে এনে পরে আরো দু’ বাহিনী প্রধানসহ রেডিও স্টেশনে নিয়ে খুনিরা খন্দকার মুশতাকের প্রতি আনুগত্য আদায় করে নেয়।
এভাবে সেদিন ৪৬ ব্রিগেডের একটি ইউনিট হিসেবে টু ফিল্ড আর্টিলারি এবং ৬/৭ মাস আগে ৪৬ ব্রিগেড থেকে হেডকোয়ার্টারের অধীনে নেয়া ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের বিরুদ্ধে ৪৬ ব্রিগেডের বাকি তিনটি ইউনিট দিয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে ৪৬ ব্রিগেড এবং সেনা সদর ব্যর্থ হয়।
হত্যাকাণ্ড ঠেকানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার মতো খুনি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থায় নিতেও ব্যর্থ হয় ৪৬ ব্রিগেড।
হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে ব্যর্থতার এক কারণ: ঘটনার কিছুসময় আগে ৪৬ ব্রিগেডের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স সরিয়ে নেয়া। কি কারণে ব্রিগেডের মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গুটিয়ে নেয়া হয় তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে ওইসময় যে ৪৬ ব্রিগেডের নিজস্ব গোয়েন্দা ব্যবস্থা ছিলো না সেটা স্বীকার করেছেন সাফায়েত জামিল।
তার হয়তো ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ছিলো না। কিন্তু সেনা সদরের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স! তারাও ট্যাংক-কামানের ৩২ নম্বরের দিকে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারে একেবারে শেষ মুহূর্তে। আর বহুল আলোচিত ডিজিএফআই আগে কিছু ষড়যন্ত্রের তথ্য জানতে পারলেও ১৪ আগস্ট রাত থেকে জানতে পারেনি কিছুই।
তবে, মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে ডিজিএফআই’র ওই সময়ের ঢাকা ডিটাচমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর জিয়াউদ্দিন অভিশপ্ত সেই সকালে সেনা সদর এবং রক্ষী বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণের কথা জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৪২ নম্বর সাক্ষী মেজর জিয়া বলেছেন, ১৫ আগস্ট সকালে সেনা সদরে আলোচনা হয়: যেহেতু বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে, তাই কোনো পদক্ষেপ নিলে গৃহযুদ্ধ ও অযথা রক্তক্ষয় হতে পারে, তাই কোনো পদক্ষেপে নেয়া সমীচীন হবে না।
তিনি আরো জানান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ রক্ষী বাহিনীর পরিচালক মেজর হাসানকে রেডিও সেন্টারে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলে তিনি তা পালন করে হাসানকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যান।
রক্ষী বাহিনীর প্রধান তখন দেশে ছিলেন না।
তবে হাসানকে নিয়ে যাওয়ার সময় রক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে রক্ষী বাহিনীর সদস্যদেরকে ব্যাটল ড্রেসে দেখেছিলেন মেজর জিয়া।
(আগামীকাল একাদশ কিস্তি: ১৫ আগস্ট রহস্যময় ভূমিকায় জেনারেল জিয়া)