খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, দ্রুত আরোগ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনায় আগামী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে তার দল বিএনপি।
কে কবে কার জন্য দোয়ার আয়োজন করবে—সেটি অবশ্যই তার পরিবার, বন্ধু ও দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়; যদি সেখানে ইনটেনশন বা নিয়ত থাকে শুধুই সৃষ্টিকর্তার কৃপালাভ। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য যদি হয় রাজনৈতিক এবং সেই দিনটি যদি হয় ১৫ আগস্ট—তখন এটি নিয়ে কথা বলবার প্রয়োজন আছে বৈকি।
বিএনপির দাবি ১৫ আগস্ট তাদের দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন। সঙ্গত কারণেই এই দিনে তার সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল হতেই পারে। আগে এই দিনে ঘটা করে তার জন্মদিনের কেকও কাটা হতো। নানা মহলের সমালোচনার মুখে অবশ্য কেক কাটায় সেই জৌলুস কমেছে। আর দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে যেহেতু তিনি এখন কারাবন্দি, তাই এ বছর কেক কাটার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের ইতিহাস তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেও সম্ভবত একটি জন্মদিন নিয়ে এত বিতর্ক হয়নি, যা হয়েছে খালেদা জিয়ার বেলায়।
আমাদের অনেকেরই জন্মদিন অন্তত দুটি। একটি আসল, অর্থাৎ যেদিন আমরা জন্মেছি। আরেকটি নকল, অর্থাৎ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমাদের নিবন্ধনের সময় শিক্ষকরা বয়স কমানোর জন্য জন্মদিন হিসেবে যে তারিখটি দিয়েছেন। সৌভাগ্যক্রমে কারো কারো ক্ষেত্রে আসল জন্মতারিখটা লেখা হলেও বয়স কমানোর তাগিদে বদলে গেছে জন্মসাল।
তবে এই যন্ত্রণা বর্তমান প্রজন্মের, অর্থাৎ যারা গত ৫/৭ বছরে জন্ম নিয়েছে বা আগামীতে নেবে, তাদের বেলায় কম। কারণ এখন জন্মের পরপরই জন্মনিবন্ধন করে ফেলতে হয়। ফলে জন্মদিন নিয়ে বিভ্রান্তির আশংকাও কম। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন আসলেই একটা রাজনৈতিক বিষয় এবং এটি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাদা ছোঁড়াছুড়িরও ইস্যু; যা প্রতি বছর ১৫ আগস্টে প্রকাশ্য হয়। এবারও তাই ১৫ আগস্টে বিএনপির দোয়া মাহফিলের আয়োজন সেই বিতর্ক নতুন করে উসকে দেবে বলে মনে হয়। যদি বিএনপি এই অনুষ্ঠানটি একদিন আগে বা পরে করার সিদ্ধান্ত নিত—তাহলে এই বিতর্কটি উঠত না। কেননা খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, আরোগ্য ও দীর্ঘয়ু কামনা ১৪ বা ১৬ আগস্ট করলে যে সৃষ্টিকর্তা শুনবেন না, তেমনটি নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু বিএনপি জেনে-বুঝেই ১৫ আগস্টেই কেক কাটা এবং দোয়া মাহফিলের এই আয়োজনটি করে জাতীয় শোক দিবসে খালেদা জিয়ার জন্মদিনের তারিখটি প্রতিষ্ঠার জন্য। এটি বস্তুত তাদের রাজনৈতিক দীনতারই প্রকাশ। বরং যদি খালেদা জিয়ার জন্মদিন সত্যিই ১৫ আগস্টেই হয়ে থাকে, তারপরও তিনি যদি এমন একটি শোকাবহ দিনে, যেদিন ঘাতকের বুলেটে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন জাতির পিতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি—তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যদি বেগম জিয়া এবং তার দল ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন বা অন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করতো তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের ভোট বাড়ত বৈ কমতো না। কিন্তু তারা এই সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠতে পারেনি।
খালেদা জিয়া কি আসলেই ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেছেন? প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের ১৫ আগস্ট জন্মদিন উদযাপন শুরু করেন। তবে তা ছিল অনাড়ম্বর। ১৯৯৬ সাল থেকে এ দিনটিতে কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন শুরু হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর খালেদা জিয়া মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে প্রথমবারের মতো নেতাকর্মীদের নিয়ে কেক কেটে জন্মদিন পালন শুরু করেন। প্রশ্ন হলো, ১৯৯১ সালের আগে কি খালেদা জিয়া নিজের জন্মদিন পালন করতেন না? যদি করে থাকেন, তাহলে সেই তারিখটি কত?
ডেইলি স্টার একবার খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের কিছু ছবি দেখিয়ে বলেছে, এসব ছবি যদি ‘ভুয়া’ না হয় তবে খালেদা জিয়ার মোট জন্মদিন পাঁচটি। তা হলো ১৯৪৪ সালের ৫ আগস্ট, ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট, ১৯৪৭ সালের ১৯ আগস্ট, ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এবং বছর উল্লেখবিহীন ১৫ আগস্ট।
ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী, খালেদা জিয়া ১৯৯৫ বা ১৯৯৬ সাল থেকে ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন পালন করেন। আর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের পরই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার দিন ১৫ আগস্টকে প্রথম বারের মতো জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করা হয়।
আগস্ট ট্র্যাজিডি হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। তার আগের প্রতি বছরের ১৫ আগস্টে এবং তারপরে এই ৪২ বছরের প্রতিটি ১৫ আগস্টে এমনকি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টেও অসংখ্য মানুষের জন্ম হয়েছে। তার মানে বাংলাদেশে লাখো মানুষের জন্মদিন ১৫ আগস্ট। সুতরাং অন্য ৩৬৪ দিনে যাদের জন্ম, তারা যদি জন্মদিন পালন করতে পারেন, ১৫ আগস্টে জন্মগ্রহণকারীরা কেন জন্মদিন পালন করতে পারবেন না? এই প্রশ্ন খুবই যৌক্তিক এবং সঙ্গত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যেইদিনে আপনার পিতা মৃত্যুবরণ করেছেন, সেইদিন যদি আপনার জন্মদিন হয়ও, আপনি কি সেদিন জন্মদিনের কেক কাটবেন?
ব্যক্তি মুজিব, নেতা ব্ঙ্গবন্ধু কিংবা রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো আলোচনার ঊর্ধে নন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার ব্যর্থতা নিয়ে ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেক কথা লিখেছেন। কিন্তু তার যে ক্যারিশমা, সাত কোটি বাঙালির ওপর তার যে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল—তার সঙ্গে বাংলাদেশের শুধু নয়, পৃথিবীর আর কোনো নেতার কি তুলনা চলে?
আপনি হয়তো আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী, আপনি হয়তো নৌকায় কোনোদিনই ভোট দেবেন না, আপনি হয়তো ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার কড়া সমালোচক; কিন্তু এই কথা কি অস্বীকার করবার কোনো সুযোগ আছে যে, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যে মানুষটির এক আঙুলের ইশারায় ‘যার যা ছিল তা-ই নিয়ে’ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল—সেই মানুষটির নাম শেখ মুজিবুর রহমান? এই ঐতিহাসিক সত্যটি যদি আপনি স্বীকার করেন, তাহলে কি আপনি ১৫ আগস্ট, যেদিন জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, সেদিন জন্মদিন পালন করতে পারেন? তবে খালেদা জিয়ার জন্মদিন আসলেই ১৫ আগস্ট কি না, এই সত্যটি কোনোদিন উদ্ঘাটিত হবে কি না, তা আমরা জানি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)