চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক: কেমন ছিল ১৪ বছরের পথচলা

হার্ভার্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা ‘দ্য ফেসবুক’ এখন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’। ২০০৪ সালের এ দিনে অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে ১৪ বছর পার করে ১৫ বছরে পদার্পণ করল ফেসবুক।

কয়েকদিন আগেই এক স্ট্যাটাসে প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ জানান, বর্তমানে প্রতি মাসে একবার হলেও ফেসবুক ব্যবহার করেন এমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২১০ কোটি। অন্যদিকে প্রতিদিনই ফেসবুক ব্যবহার করেন প্রায় ১৪০ কোটি ব্যবহারকারী।

ব্যবহারকারীর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফেসবুকের আয়ও। ২০১৭ সালে ফেসবুকের মোট আয় হয়েছে ৪০.৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর আয়ের পরিমাণ ছিল ২৬.৮৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে আয় বেড়েছে ১৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার।

গত ১৪ বছরে ফেসবুকের ব্যবসা বেড়েছে বহুগুণ। এ সময়ে আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও কিনে নিয়েছে ফেসবুক।

কিন্তু শুরুটা কেমন ছিল ফেসবুকের? কীভাবেই বা এলো এতো দূর পর্যন্ত? কেমন ছিল এ ১৪ বছরের পথচলা? এ সবকিছুই তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য:

ফেসম্যাশ থেকে শুরু

২০০৩ সালে জাকারবার্গ তখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সে সময় তিনি ‘ফেসম্যাশ’ নামের একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেন। চালুর প্রথম চার ঘণ্টার মধ্যেই ওয়েবসাইটটি ভিজিট করেছিলেন ৪৫০ জন ভিজিটর এবং ২২ হাজার ছবি দেখা হয়েছিল এ সময়ের মধ্যে। কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গ্রুপ এবং সার্ভারে ওয়েবসাইটটির নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু কয়েকদিন পরই হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ ফেসম্যাশ বন্ধ করে দেয়।

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক

জাকারবার্গের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা লঙ্ঘন, কপিরাইট লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বেশ কিছু অভিযোগ আনা হয়। যদিও পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

দ্য ফেসবুক

২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ‘দ্য ফেসবুক’ নামের আরেকটি ওয়েবসাইট চালু করেন জাকারবার্গ। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে পরিচিতি বাড়ানোর জন্য থাকা ডিরেক্টরির নামে এই ওয়েবসাইটটি চালু করা হয়। হার্ভার্ডের এ ডিরেক্টরিতে শিক্ষার্থীদের ছবি এবং বিস্তারিত তথ্য দেওয়া থাকত।

তবে ঝামেলা যেন জাকারবার্গের পিছু ছাড়তে চাইছিল না। আর তাই এবারও সমস্যায় পড়লেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন সিনিয়র শিক্ষার্থী তাদের আইডিয়া চুরি করার অভিযোগ আনেন জাকারবার্গের বিরুদ্ধে। ‘হার্ভার্ড কানেকশন’ নামের একটি পারস্পরিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট বানাতে সহায়তার কথা বলে আইডিয়াই চুরি করে নিলেন জাকারবার্গ, এমন অভিযোগ ছিল তাদের।

ওই তিন শিক্ষার্থী তাদের দাবি নিয়ে আদালত পর্যন্ত গেলেন। সেখানে ২০০৮ সালের মামলার নিষ্পত্তি হয়। এজন্য তাদের তিনজনকে দেওয়া ফেসবুকের ১২ লাখ শেয়ার।

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক

প্রথমদিকে শুধুমাত্র হার্ভার্ডের শিক্ষার্থীদের জন্যই নেটওয়ার্কটি উন্মুক্ত ছিল। দ্য ফেসবুকের উন্নয়নে আরও চার সহপাঠীকে যুক্ত করলেন জাকারবার্গ। এর মধ্যে এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন দেখতেন ব্যবসায়িক বিষয়গুলো, ডাস্টিন মস্কোভিটজ কাজ করতেন প্রোগ্রামার হিসেবে। গ্রাফিক্সের জন্য ছিলেন অ্যান্ড্রু ম্যাককলাম এবং মুখপাত্র নিযুক্ত হলেন ক্রিস।

পরবর্তীতে এমআইটি, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়য়, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইভি লিগের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি চালু করা হয়। ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই দ্য ফেসবুক চালু হয়।

ফেসবুক

২০০৪ সালের মধ্যভাগে ফেসবুকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান ন্যাপস্টার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং বিনিয়োগকারী সিন পার্কার। তিনি জাকারবার্গের পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করতেন। একই বছরের জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো বিনিয়োগ পায় দ্য ফেসবুক। বিনিয়োগকারী ছিলেন পেপালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার থিয়েল।

২০০৫ সালে ফেসবুক.কম ডোমেইনটি কেনার পর প্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে ‘দ্য ফেসবুক’ থেকে করা হয় ‘ফেসবুক’। দুই লাখ ডলারে সে সময় ডোমেইনটি কেনা হয়েছিল।

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক

এ বছরের মে মাসে একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে ১২.৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এর বাইরে জিম ব্রেয়ার নামের একজন বিনিয়োগকারী দিয়েছিলেন আরও ১ মিলিয়ন ডলার।

এ বছরই হাইস্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য ফেসবুকের একটি সংস্করণ চালু করা হয়। শিক্ষার্থীদের বাইরে অ্যাপল, মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধাও চালু করা হয়।

এর পরের বছর ফেসবুক জানায়, অন্তত ১৩ বছর বয়স হয়েছে, এমন যে কেউ ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। তবে লাগবে শুধু একটি ইমেইল ঠিকানা।

২০০৭ সালের অক্টোবরে মাইক্রোসফট ২৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ফেসবুকের ১.৪ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।

মেসেঞ্জার

আগে থেকেই বার্তা আদান প্রদান করার সুবিধা চালু থাকলেও এ বিষয়টিকে আরও সহজ করতে ২০১১ সালের আগস্টে মেসেঞ্জার নামের আলাদা একটি অ্যাপ চালু করে ফেসবুক। অ্যাপটিকে জনপ্রিয় করার জন্য ২০১৪ সালে মূল অ্যাপ থেকে মেসেজ পাঠানোর সুবিধা বাদ দেওয়ার ঘোষণা দেয় ফেসবুক।

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক

প্রথমদিকে এতে খুব বেশি সুবিধা না থাকলেও বর্তমানে এই অ্যাপটিও সমানভাবে জনপ্রিয়। বর্তমানে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চালু থাকা মেসেঞ্জারে ভয়েস কল এবং ভিডিও কলের পাশাপাশি গেম খেলা, অর্থ লেনদেন এবং সিক্রেট কনভারসেশনের পাশাপাশি চালু আছে আরও অনেক ফিচার। ২০১৬ সালে ক্রিত্তিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক চ্যাটবট চালু করা হয়েছিল মেসেঞ্জারের জন্য।

ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ও অকুলাস অধিগ্রহণ

এখন পর্যন্ত ফেসবুক ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৬৬টি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করেছে। তবে সবথেকে বেশি আলোচিত তিন প্রতিষ্ঠান হলো ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং অকুলাস ভিআর।

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক

২০১২ সালের মার্চে ১ বিলিয়ন ডলারে ছবি শেয়ারের জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ইনস্ট্রাগ্রামকে কিনে নেয় ফেসবুক। তবে এর পরিচালনা থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যক্রমই স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয়।

২০১৪ সালে তাৎক্ষনিক বার্তা আদান প্রদান বা ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয় ফেসবুক। এজন্য ফেসবুকের খরচ হয়েছিল ১৯ বিলিয়ন ডলার।

ফেসম্যাশ থেকে ফেসবুক

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির জন্য ডিভাইস তৈরি করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান অকুলাস ভিআর। ২০১৪ সালে এ প্রতিষ্ঠানটিকেও কিনে নেয় ফেসবুক। এজন্য ব্যয় হয়ে হয়েছিল ২২০ বিলিয়ন ডলার।

আয় ও প্রবৃদ্ধি

২০০৪ সালে ফেসবুকের আয় ছিল মাত্র ৪ লাখ ডলার। এর পরের বছর এক লাফেই ৯০ লাখ ডলারে পৌঁছে যায় আয়ের পরিমাণ। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বিলিয়ন ডলার আয়ের মাইলফলক অর্জন করে ফেসবুক। এ বছর ফেসবুক ২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১৫৮ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ফেসবুক আয় করেছে ৪০.৬৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৭ শতাংশ।

বাংলাদেশে ফেসবুক

বর্তমানে বাংলাদেশেও ফেসবুক দারুণ জনপ্রিয় একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ব্যবহারকারী সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য না পেলেও গত বছরের এপ্রিলে প্রাপ্ত এক গবেষণা তথ্য থেকে দেখা গেছে সে সময়ে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই কোটি। এর কয়েকদিন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমও জানিয়েছিলেন একই তথ্য। ব্যবহারকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বে দুই নম্বরে আছে ফেসবুক, এমন তথ্যও দিয়েছিল ওই গবেষণা পরিচালনাকারী দুটি প্রতিষ্ঠান।