১৪ দল কি বিভক্ত হচ্ছে? তার শরিকদের কেউ সরকারি দল আর কেউ বিরোধী দল হচ্ছে? রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় এ প্রশ্নটি সবার মুখে মুখে৷ ১৪ দলের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ পর্যন্ত ১৪ দলের ঐক্যের কথা বলেছে৷ জোটের ঐক্যকে জোরদার করতে জোট শরীক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে (ইনু) নৌকা প্রতীক তুলে দিয়েছে৷ নির্বাচনে তখন বিরোধী পক্ষ ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষ৷ কিন্তু নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষের ভরাডুবি ঘটে৷
এরপরই আওয়ামী লীগ শরিকদেরকে বিরোধী দল হওয়ার পরামর্শ দিতে থাকে৷ শুরু হয় ১৪ দলে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন৷ ১৪ দলীয় জোট বিরোধী দলে যাবে না। আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের অধীনে নির্বাচন করেছি। তাই আমরা বিরোধী দলে যাচ্ছি না বলে সাফ জানিয়েছেন ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেন, ‘আমি তো জাতীয় পার্টি না! আমাকে যদি এরশাদের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে ভুল করবেন। সকালে এক কথা বলল, বিকালে আরেক কথা বলল। আমরা তাদের মতো না।’ মেনন আরও বলেন, আমি নির্বাচনেও বক্তব্য দিয়েছি উন্নয়নের পক্ষে। আমি বক্তৃতা করেছি আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পক্ষে। তাহলে এখন কীভাবে পাল্টা বক্তব্য দেবো? আমি তো ভোটের আগে উন্নয়নের কথা বললাম, এখন এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলে তার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে?
আওয়ামী লীগ ও মন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি বলেন, প্রথম থেকেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে জোট চর্চা করেনি বা করতে চায়নি। আমরা যেটা বারবার গত ১০ বছরে জোর দিয়ে বলেছি, আপনারা জোট চর্চা করুন। এই জোট চর্চার ব্যবহার না থাকায় একটি কেন্দ্রীভূত জায়গায় এসেছে। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেই সমস্ত ক্ষমতা শুধু আমরা নই, আওয়ামী লীগের লোকজনও জানে না, কেন তাদের মন্ত্রিত্ব নেই? আমরা তো জানি না, কেন আমাদের মন্ত্রিত্ব নেই? আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘চিফ হুইফ’ কে হচ্ছে? বলল, ভাই, জানি না। সুতরাং এটা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের ন্যায় দেশের রাজনীতির পরিণতি, যেখানে সকল ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তিসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের আরেক শরিক বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। এজন্য প্রশাসনে অতি উৎসাহী একটি অংশ দায়ী বলে মনে করছে দলটি। ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জাসদের জাতীয় কমিটির সাধারণ সভায় একাদশ সংসদ নির্বাচনকে এভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। পরে এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দলটি। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ জাসদ তাদের সভার মূল্যায়ন তুলে ধরে জানায়, দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণ উদ্দীপনা ও আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের পরে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েছে গোটা জাতি। এর মূল কারণ প্রশাসনের এক শ্রেণীর অতি উৎসাহী অংশ ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত করেছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের জয় এই নির্বাচনে ‘নিশ্চিত’ ছিল উল্লেখ করে বলা হয়, জনগণের ভোটের মাধ্যমে ১৪ দল তথা মহাজোটের নিশ্চিত বিজয় জেনেও যে মহল বিশেষ এ অপকর্ম করেছে, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। কেননা, এ কলঙ্কিত ঘটনার মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এ কলঙ্কের দাগ মুছতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৪ দল শরিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম ক্ষুব্ধতা ও অনিশ্চয়তা৷ তারা নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ছিল ১৪ দল৷ সরকারের নানা উন্নয়ন ও অর্জনের কথা বলে তারা জনগণের কাছে ভোট চেয়েছে৷ তবে নির্বাচনের আগে কেন তাদেরকে নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে বলা হলোনা? এখন যদি তারা বিরোধী দল হয়ে সরকার ও নির্বাচনের সমালোচনা করে বক্তব্য দেয় মানুষ তা কিভাবে নেবে? নির্বাচনে বিএনপির এমন অপ্রত্যাশিত ভরাডুবি না হলে হয়তো শরীক দলকে তা বলা হতো না৷ আওয়ামী লীগও হয়তো তখন ভাবেনি যে নির্বাচনী ফলাফলে বিএনপির এমন করুণদশা হবে৷ তবে কি বিএনপির রাজনৈতিক শক্তির উপরই ১৪ দল শরিকদের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি? বিরোধী পক্ষ যতো দুর্বল হবে শরিকদের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি কি তত কমবে? যেমন ২০০৪ সালে বিএনপি জামাতকে আর না বলে শরিকদের নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথে নেমেছিল৷ তখন বিএনপি ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়৷ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া৷ একাদশ সংসদেও যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে সরকার গঠন করতো তখন কি আওয়ামী লীগ শরীকদের দূরে ঠেলতো? নির্বাচনের আগে দেশে দুটো পক্ষই ছিল৷ একপক্ষের মার্কা নৌকা আরেক পক্ষের ধানের শীষ৷এ দু মার্কার পৃথক মার্কা পৃথক জোট ও পৃথক ইশতেহার৷ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগও প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতো বিএনপিকেই৷
সরকার দল হওয়ার জন্য যেমন সংখ্যাগরিষ্ট আসন পেতে হয় বিরোধী দল হয়ে উঠলে কতটি আসন পেতে হয়? বিরোধী দল হয়ে ওঠার জন্য কি এমন কোন শর্ত আছে? বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলে কি বিরোধী দল বিশেষণ হারিয়ে ফেলে? যদি তাই হয় তাহলে কি সরকার দল বর্জন করা দলটিকে বাদ দিয়ে অন্য দলদের নিয়ে নির্বাচনে যেয়ে বিরোধী দলকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দিতে পারেনা? তারা কি পারেনা সকল আসনে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দিয়ে সরকার দল ও সংখ্যালঘিষ্ঠ আসন সংখ্যক সাংসদদের আলাদা করে বিরোধী দল বানিয়ে ফেলতে? একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কি তাই হতে চলছেনা? না হয় কিছু নৌকাকে বিরোধী দল হয়ে যেতে কিভাবে বলা হচ্ছে? ১৪ দল সরকার দলীয় জোট তাই তারা আবার বিরোধী দল হয় কি করে? হয়তো তা পারে পক্ষ ত্যাগের মাধ্যমে৷ শরীকদের কেউ কেউ চাইলে অবশ্যই পক্ষ ত্যাগ করতে পারে৷ কিন্তু পক্ষত্যাগ না করতে চাইলে তাদের বাধ্য করা কি ঠিক? সরকার কি সত্যিই গণতন্ত্রের স্বার্থে বিরোধী দল চাচ্ছে না কি তা কেবলই কাগজে কলমে? যে মুখে তারা সরকারের উন্নয়নের কথা বলে ভোট চেয়েছে সে মুখে তারা অনিয়ম দুর্নীতির কথা কি করে বলবে শরিকদের এই প্রশ্ন খুবই যৌক্তিক নয় কি? জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে একভাবে নির্বাচনের পরে তাদের অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কি ১৪ দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না? তখন কি মানুষ প্রশ্ন করতে পারেনা ১৪ দলের কয়টি সরকার দল ও কয়টি বিরোধী দল?
সরকার দল ও বিরোধী দল হওয়ার পূর্ব শর্ত কি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব থাকা? তাহলে ১৪ দলে যেসব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই তারা কোন দল? যেমন সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি প্রভৃতি৷ বিএনপি জামাতের আমলে এ দলগুলো রাজপথে ১৪ দলের ব্যানারে বিরোধী দল ছিল৷ এবার কি তারা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের সাথে থেকে বিরোধী দল হতে যাচ্ছে?১৪ দলে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি? নাকি প্রধান শরীক আওয়ামী লীগ একতরফা ভাবে বিরোধী দল হওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে? আসলে বর্তমান বাস্তবতায় বিরোধী দলকে পরিস্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত৷
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব দল৷ এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি কি পেরেছে এসব দলকে সরকার দল ও বিরোধী দল হতে মাইনাস করতে? ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিলেও তারা সংসদে গেছে ৩ বছর৷ বাকি ২ বছর তারা সংসদে যায়নি৷ এমন কি ১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪৭ জন সাংসদ পদত্যাগ করেছিল৷ কিন্তু বিএনপি এবার কেন এই দাবিতে অনড় থেকে নির্বাচন বর্জনের সাহস করতে পারলো না? কেন তাদের মনে হল এতে তারা সরকার দল ও বিরোধী দল দুটো হতেই ছিটকে পড়তে পারে?
১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি৷ আওয়ামী লীগ বর্জন করেছে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন৷ এরশাদ জমানায় এসব বর্জনের কারণেই বিরোধী দলের সংকট কাটাতে আ স ম আব্দুর রবের দলকে বিরোধী দল বানানো হয়৷ যাকে বলা হতো গৃহপালিত বিরোধী দল৷ কিন্তু এই গৃহপালিত বিরোধী দলও নির্বাচনের পরে হয়নি তা নির্বাচনের আগেই হয়েছে৷ কিন্তু এবার হচ্ছে নির্বাচনের পরে৷ এক জোটে ও এক প্রতীকে নির্বাচন করে নির্বাচনের পরে পৃথক হয়ে যাওয়ার কি ব্যাখ্যা দেবেন গণতন্ত্রের ব্যাখ্যাকাররা? এক প্রতীকে ও একসাথে নির্বাচন করে নির্বাচনের পরে পৃথক জোট করার কোন সুযোগ কি আছে? থেকে থাকলে ১৪ দলের কয় দল আলাদা হচ্ছে? এমনটি হলে এই সিদ্ধান্ত কি ১৪ দলের বৈঠকে হওয়া হওয়া সংগত নয়? অথবা যারা বিরোধী দল হবে তাদের জোট ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়? আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে বিরোধী দলকে বলা হতো সম্মিলিত বিরোধী দল? দল ছিল ৭৮টি৷ এবার বিরোধী দল হিসাবে কয়টি দল থাকছে? আর এমনটি হলে তার নামকরণ কি হচ্ছে? এ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা, গুঞ্জন ও সকল অস্পষ্টতার অবসান কাম্য৷ এ অস্পষ্টতা নিরসন হবে কি?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)