১৪ আগস্ট বিকেল থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সব প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে শেষ বৈঠক, নাইট প্যারেডের নামে সেনা সমাবেশ, অস্ত্রাগার খুলে দিয়ে অস্ত্র ও গুলি বিতরণ, রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা, সেনাদের উদ্দেশে ব্রিফিং, ট্যাংকসহ যাত্রা; সবকিছু প্রকাশ্যেই হয়েছে। তারপরও যারা পারতেন, তাদের কেউই খুনিদের ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ নেন নি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খন্দকার মুস্তাক আহম্মদ এবং মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদের মধ্যে ১৪ আগস্টের বৈঠকের বর্ণনা দিয়েছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনিদের একজন মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। সেনাবাহিনী থেকে আগেই অবসরে যাওয়া শাহরিয়ার ওইদিন তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলো। বিকেলে রশিদ এবং মেজর নূর তাকে মন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের আগামসি লেনের বাসায় নিয়ে যায়। যাবার পথে তারা গাড়ি রেখে যায় চানখারপুলে। সেখানে তাদের মধ্যে এমন আলোচনা হয় যাতে পরদিন সকালে খন্দকার মুশতাক তার বাসায়ই অবস্থান করে।
শাহরিয়ারের মতো মেজর ফারুকও তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে যে রাজনৈতিক যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলো মেজর রশিদ। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবেই পরদিন ভোরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে আগামসি লেনে শেষ বৈঠক হয় যেখানে ঠিক হয়ে যায় খন্দকার মুশতাকই হবে রাষ্ট্রপতি।
ওই বৈঠকের পর ঠিক হয় শাহরিয়ার-হুদা-নূর-রাশেদ চৌধুরীসহ চাকুরিচ্যুত অথবা অবসরে যাওয়া মেজর-ক্যাপ্টেনরাও ফারুকের ল্যান্সার এবং রশিদের আর্টিলারি ইউনিটের নাইট প্যারেডে যোগ দেবে, যে নাইট প্যারেড থেকে সেনা বিদ্রোহের নামে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তরসূরীদের হত্যা করা হয়।
কর্নেল ফারুকও স্বীকার করেছে, নাইট ট্রেনিং এর সময় তাদের মধ্যে সমন্বয় করে ১৫ আগস্ট ভোরে চূড়ান্ত অ্যাকশন প্ল্যানের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো।
বালুরঘাটে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের ওই নাইট প্যারেডে স্বভাবত:ই প্রথমে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিলো না। কিন্তু রাতে যেনো অস্ত্রাগার খুলে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা বিকেলেই করে রেখেছিলো টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২৬ নম্বর সাক্ষী, টু ফিল্ড আর্টিলারির অ্যামিউনিশন সেন্টারের দায়িত্বে থাকা নায়েক জামরুলসহ একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যে তার বর্ণনা পাওয়া গেছে।
জামরুল জানান, ১৪ আগস্ট বিকেলে মেজর রশিদ তাকে অ্যামিউনিশন স্টোরের চাবি কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের কাছে জমা না দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিতে বলে।
তবে দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরসহই একটি ডজ গাড়িতে মেজর রশিদ অ্যামিউনিশন সেন্টারের সামনে আসে। তাদের সঙ্গে ল্যান্সার ও আর্টিলারির ১০/১২ জন সৈনিক ছিলো। ‘মেজর রশিদের নির্দেশে অ্যামিউনিশন সেন্টারের তালা খুলে দিলে ওই সৈনিকরা কোনো প্রকার হিসাব ছাড়াই কামানের গোলা এবং রাইফেল, স্টেনগান, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, রিভলবার ইত্যাদি অস্ত্রের গুলি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়,’ বলে জানান জামরুল।
এরপর মেজর রশিদের নির্দেশে তিনি অ্যামিউনিশন সেন্টারের তালা লাগিয়ে দেন। মেজর রশিদ তখন তাকে বলে, তুমি লাইনে থাকবা। আমাদের আরো অ্যামিউনিশনের প্রয়োজন হতে পারে।
তবে কোথাও থেকে কোনো বাধা না আসায় খুনিদের আর কোনো গোলা-বারুদ বা গুলির প্রয়োজন হয় নি। সারাদিনই কামানগুলো নিয়ে রাজধানীতে মহড়া চলেছে, কিন্তু কোথাও থেকে কোনো বাধা আসে নি।
ওইদিন কামানোর গোলা ব্যবহার হয়েছিলো চারটি। এর একটি মোহাম্মদপুরে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রথম দফা হামলার পর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত মেজর মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বে কামানের গোলা ছোঁড়া হয়। এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিলো, পুরো সেনাবাহিনীই এই অপারেশনের সঙ্গে আছে।
রশিদ ট্রাক ভরে যে গোলা-বারুদ নিয়ে যায় সেগুলো বালুরঘাটে নাইট প্যারেডে রাত ১২টার দিকে পৌঁছায় বলে জানান ১৭ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার গানার সামছুল ইসলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওই নাইট প্যারেড শুরু হয়েছিলো। সেখানে তখন মাত্র ছয়টি কামান থাকলেও এরইমধ্যে হাতে হাতে চলে এসেছিলো হালকা অস্ত্র।
ছয়টি কামানের মতো ওই রাতে ট্যাংকও ছিলো ছয়টি। এ বিষয়ে জানান ঘটনার সময় ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের বি স্কোয়াড্রনের এসডিএম এবং মামলার ২৩ নম্বর সাক্ষী আব্দুল আলী মোল্লা। তিনি জানান: ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিংয়ে গিয়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার লে. কিসমতের নির্দেশে ১০টি ট্যাংক পরিস্কার করেন। রাত আনুমানিক ১২টার দিকে মেজর ফারুক এসে বলে, ট্যাংক মহড়া আছে, ট্যাংক বাইরে যাবে। যাদের ট্যাংক স্টার্ট নেয়, তারা হাত তোলো।
ফারুকের কথায় ছয়জন ড্রাইভার হাত তুলে। তখন ওই ছয়জন ড্রাইভারকে একপাশে দাঁড় করিয়ে ট্যাংকের অন্যদের মধ্য থেকে ফারুক পছন্দ করে ফোর্স বেছে নেয়। পরে ওই ফোর্স এবং অফিসারদের মধ্যে ট্যাংক বণ্টন করে ফারুক চলে যায়। তবে তখনও ট্যাংকে কোনো গোলা ছিলো না।
ফারুক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে, পরে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের পাশে সিওডিতে অ্যামুনিশন নিয়ে এয়ারপোর্ট রোড হয়ে চেয়ারম্যানবাড়ি রেল ক্রসিং দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে ফোর্থ এবং ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারের ভেতর দিয়ে এয়ারফোর্সের ফাইটার স্কোয়াড্রন হয়ে পুরাতন এয়ারপোর্টকে পাশে রেখে রক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের কাছ দিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ হয়ে তারা ট্যাংক নিয়ে ৩২ নম্বরে পৌঁছায়।
ট্যাংকের গোলা পরে নেয়া হলেও ফারুকের ল্যান্সার ইউনিটকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দেওয়া হয় রাত সাড়ে ৩টার মধ্যে। এগারো নম্বর সাক্ষী এল.ডি বশিরসহ অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যে তা স্পষ্ট হয়েছে।
চল্লিশ নম্বর সাক্ষী অনারারি ক্যাপ্টেন সাঈদ আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি অসুস্থ থাকায় মেজর ফারুকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এসেছিলেন। রাত ২টা/৩টার দিকে আরডিএম তার কাছে এসে বলে, আর্টিলারি আসছে, ট্যাংক রেডি হচ্ছে। দুই রেজিমেন্ট কম্বাইন্ড ট্রেনিং করবে, তাই হাতিয়ার অ্যামিউনিশন চায়। কিছুক্ষণ পর কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন দেলোয়ার তার কাছে একটা স্লিপ পাঠায়। তিনি চাবি দিয়ে স্লিপটা ট্রেজারিতে রাখতে বলেন।
কিন্তু, আধা ঘণ্টা পর তার মনে হয়, ট্রেজারিতে অনেক টাকা আছে। তখন কোয়ার্টার গার্ডে গিয়ে মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদকে কথা বলতে দেখেন তিনি। তাদের পাশে এলএমজি ফিট করা একটি জিপ ছিলো। মেজর ফারুক তাকে গেট বন্ধ করে দিয়ে রেজিমেন্টের দিকে খেয়াল রাখতে বলে।
ফারুকের কাছে অনারারি ক্যাপ্টেন সাঈদ তাদের গন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক বলে, স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করতে যাবো।
‘এই খবর শফিউল্লাহ সাহেব জানেন?’ জিগগেশ করলে ফারুকের উত্তর ছিলো: দরকার মনে করি না।
এভাবে প্রকাশ্যে সব প্রস্তুতির পাশাপাশি ফারুক-রশিদের ঘোষণাও ছিলো প্রকাশ্য। ঊনচল্লিশ নম্বর সাক্ষী রিসালদার মনসুর বলেন, নাইট প্যারেডে ফারুক বলে, বিশেষ কাজে দেশের জরুরি পরিস্থিতিতে ট্যাংক বাইরে যাবে। তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো। এই নির্দেশ পেয়ে তিনি ট্যাংক নিয়ে অ্যামিউনিশন স্টোরে যান। কিন্তু সেখানে অ্যামিউনিশন পাওয়া যায় নি। পরে ফারুক তা যোগাড় করতে পারলেও কোনো বাধা না থাকায় ব্যবহার করতে হয় নি।
প্রসিকিউশনের ১২ নম্বর সাক্ষী ল্যান্সারের এল.ডি সিরাজ জানিয়েছেন, প্রকাশ্য ব্রিফিংয়েই মেজর ফারুক বলে, আগামীকাল ১৫ আগস্ট ইউনিভার্সিটিতে মিটিং হবে। সেই মিটিংয়ে রাজতন্ত্র ঘোষণা করা হবে। শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘোষণা করবেন। আমরা রাজতন্ত্র সমর্থন করি না। এখন আমি যা বলবো এবং আমার অফিসাররা যা বলবে তা তোমরা শুনবে (পালন করবে)’।
২৪ নম্বর সাক্ষী আর্টিলারির হাবিলদার আমিনুর রহমানের সাক্ষ্য অনুযায়ী, মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম তাদের ব্রিফিংয়ে বলে, অনেক কষ্ট করে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলাম। বর্তমান সরকার আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে পারছে না। জনগণ না খেয়ে মরছে– এই সরকারতে উৎখাত করতে হবে।’
চৌদ্দ নম্বর সাক্ষী দফাদার জব্বার মৃধা এবং ১৯ নম্বর সাক্ষী দফাদার সহিদুর রহমানসহ অন্যদের সাক্ষ্যে জানা যায়, মেজর ডালিমরা এরকম ব্রিফিংয়ে যোগ দেওয়ার আগেই তাকে এবং বরখাস্ত কিংবা অবসরে যাওয়া অন্য কর্মকর্তাদের ইউনিফর্ম সরবরাহ করা হয়।
সব প্রস্তুতির পর কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে আর্টিলারি এবং ল্যান্সাররা বালুরঘাট থেকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর এবং বাইরে দিয়ে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর, মিন্টো রোডে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবন, ধানমণ্ডিতে শেখ মণির বাসভবন, শাহবাগে বেতার ভবন এবং বঙ্গভবনে পৌঁছে যায়। পরের ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে তিনটি বাড়িতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড।
(আগামীকাল অষ্টম কিস্তি: ডালিমের স্টেনগান দেখে ভয়ে রাস্তা ছেড়ে দেন অফিসাররা)