দেশের কৃষি গবেষণার প্রথম ল্যাবরেটরি। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয় এখান থেকেই। দেশ যে বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব তার সূতিকাগার ছিল এই ভবনটি। নির্মাণ শৈলীতেও অনন্য। পরিবেশবান্ধব নকশায় তৈরি শতবর্ষী ভবনটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন বিশ্বেই এমন ভবনের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা।
রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষি ল্যাবরেটরিটি না ভাঙার জন্য শত শত যুক্তি তুলে ধরলেন স্থপতি, প্রকৌশলী ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা। ভাঙার প্রতিবাদে মানববন্ধন করে তা যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণের দাবি জানালো আরবান স্টাডি গ্রুপ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ বেশ কিছু সংগঠন। ভবন ভাঙায় নিষেধাজ্ঞায় দিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু হাইকোর্টে এ বিষয়ে শুনানির আগেই তড়িঘড়ি করে ভেঙে ফেলা হল খামারবাড়ির ঐতিহ্যবাহী কৃষি গবেষণাগার।
ভবনটি ছিল তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে। ভবন ভাঙার পক্ষে সেই বোর্ডের নির্বাহি পরিচালকের যুক্তি, ভবনটি ১৩ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। ক্রেতারা সরকারি কোষাগারে টাকাও জমা দিয়েছেন। তাই ভবন তুলে নেওয়ার ব্যাপারে তারা চাপ দিচ্ছিলেন।
ভবনটি ভাঙার প্রতিবাদ উঠলে এটি নিয়ে দায় এড়ানোর প্রবণতাও চোখে পড়ে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলে, আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না, এটি এখন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে। তুলা উন্নয়ন বোর্ডে যোগাযোগ করা হলে তারা বলে, ভবনটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ঠিক আছে, কিন্তু এটি ভাঙার ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। ভাঙার দায়দায়িত্ব সব গণপূর্ত অধিদপ্তরের। গণপূর্ত অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তারা বলে, অনুমতি সাপেক্ষে আমরা কেবল ভাঙার কাজটি করে দিচ্ছি, দায়দায়িত্ব সব তুলা উন্নয়ন বোর্ডের।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2017/10/khamarbari-2.jpg?resize=680%2C444&quality=100&ssl=1)
হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর যেন আরও তাড়াহুড়া করে ভেঙে ফেলা হয় ভবনটি। এর পেছনে উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। ‘ভেঙে ফেলা হলে তো আর কিছু করার থাকে না’ যুক্তিটি আর শক্তভাবে দাঁড় করানো। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরও ভবনটি কেন ভাঙা হলো? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন: ‘ভবনটি ভাঙা শেষ হয়েছে। আমরা সব ফরমালিটিজ অনুসরণ করে ভবনটি ভেঙেছি। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়েই ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে ভবনটি ভাঙা হয়েছে। ভাঙার পরে রিট হলে তো আমরা কিছু করতে পারি না। দেখি, হাইকোর্ট কী বলেন।’
অথচ ভবন কিছু অংশ ভাঙার পর যখন প্রতিবাদ ওঠে, মানববন্ধন হয় তখন স্থপতি ও প্রকৌশলীরা স্থানটি সরেজমিন পরিদর্শন করে বলেছিলেন, যতটুকু ভাঙা হয়েছে তাতে খুব সমস্যা নেই। চাইলে আবারও পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2017/10/khamarbari-3.jpg?resize=696%2C444&quality=100&ssl=1)
মূল ব্যাপার হচ্ছে, নতুন প্রজেক্ট মানে নতুন আয়ের ব্যবস্থা। কোন ভবন মেরামতের চেয়ে নতুন প্রজেক্টে টাকার অঙ্কটা ঢের বেশি। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পুরনো ভবনটির জায়গায় নতুন প্রজেক্ট পাশ হয়েছে। সেখানে সাত তলা ভবন নির্মান করা হবে। তবে ঠিক কত টাকার প্রজেক্ট পাশ হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেননি তুলা্ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহি পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন।
স্থপতি ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন ভবনটি ধ্বংস না করে বরং এটিকে একটি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা যেত। এখানে প্রদর্শন করা যেত ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের কৃষির যত অর্জন তার সবকিছু। এতে একদিকে যেমন ভবনটি পর্যটকের আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হতো, তেমনি আমাদের কৃষির ইতিহাস ও ঐতিহ্য দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারতো বর্তমান প্রজন্ম। বিদেশীদের কাছেও আমরা গর্ব করে দেখাতে পারতাম যে আমাদের সমৃদ্ধ বিজ্ঞাননির্ভর অতীত।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটিকে যেকোন উপায়ে ভেঙে ফেলাকেই ‘যৌক্তিক’ মনে করলো!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)