চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

হিটলার-রবিন হুড, ফেসবুক ট্রায়াল ও আইনের শাসন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে জার্মানির পক্ষে থাকা অ্যাডলফ হিটলার সম্মানসূচক ‘ফার্স্ট ক্লাস আয়রন ক্রস’ লাভ করেছিলেন। তারপরে মারাত্মক বক্তৃতা প্রতিভা আর সাংগঠনিক দক্ষতায় হয়ে ওঠেন জার্মান রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ-ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তারপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেপরে মাত্র ৫/৬ বছরে হলোকাস্ট বর্বরতায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিহত/হত্যা/খুন হয় হিটলার ও তার বাহিনী এবং হিটলারে ঘৃণার মতবাদের কারণে। যদিও সেই বর্বরতার পেছনেও হিটলারের মারাত্মক সব যুক্তি ছিল, বহু বহু বহু অনুসারি তা যুক্তিযুক্ত/গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নিয়ে অন্ধের মতো হিটলারের সঙ্গেই ছিল। হিটলারের নিমর্মতার এতো সমর্থক থাকার কারণ নিয়ে বিস্ময় রেখে ইতিহাসবিদরা এখনও গবেষণা করছেন।  নারী-শিশুসহ সাধারণ মানুষকে নানা অভিনব ও নির্মম কায়দায় হত্যা-নির্যাতনের চিত্র ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। সেসময় দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার মতবাদ, যুদ্ধে আর প্রতিহিংসায় পৃথিবীতে প্রায় ৮০ মিলিয়ন প্রাণহানি ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবী তছনছ করা হিটলার কোনঠাসা হয়ে আত্মগ্লানি নিয়ে আত্মহত্যা করে নির্জন বাঙ্কারে।  আত্মহত্যা তাকে তার অপকর্মের বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলেও সারাজীবন তাকে ঘৃণার পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে তার অপকর্মের সঙ্গী, যারা বেঁচে ছিল তাদের নূরেমবার্গ ট্রায়ালের সামনে দাড়াতে হয়েছে এবং সাজাও ভোগ করতে হয়েছে। মানবতার ইতিহাসে ও আইনের শাসনের উদাহরণ হিসেবে যা অনন্য।

ঠিক হিটলারের মতো না, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইংরেজী লোককাহিনীর একজন বীরত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয়-কাল্পনিক চরিত্র হচ্ছে রবিন হুড। নটিংহামের শেরউড জঙ্গলে সবুজ কাপড় পড়ে রবিন ও তার দলের বীরত্বপূর্ণ গাঁথা এখনও বহুল পাঠ্য একটি বিষয়। ধনীদের কাছ থেকে ডাকাতি ও মালামাল লুট করে গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন রবিন। অল্প সংখ্যক সঙ্গী নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লুটেরা জমিদার আর অত্যাচারি শেরিফদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল রবিন আর তার সঙ্গীরা, যারা পরিচিত ছিল ‘মেরি ম্যান’ নামে। শেরউড জঙ্গলে রবিনের সঙ্গী লিটল জন, মাচ দ্য মিলার, উইল স্কারলেটদের নিয়ে রয়েছে নানা গল্প।

গরিবের বন্ধু হিসেবে সে বহুল জনপ্রিয় কোটি পাঠকের মনে, জনপ্রিয়তার কারণে লোককাহিনীর গণ্ডি পার করে বাস্তবজীবনে রবিন হুডের মূর্তি তৈরি হয়েছে ও তা স্থান পেয়েছে নটিংহামের জনপদে। শুধু তাই নয় পশ্চিম ইয়র্কশায়ারে ক্রিকলিস পার্কে রবিন হুড ও লিটিল জনের কথিত কবরও আছে। পছন্দের কোনো চরিত্রের জন্য মানুষ কতোটা যুক্তিহীন হতে পারে, এটিও একটি বড় উদাহরণ। লোককাহিনীতে রবিনের নানা বীরত্বপূর্ণ ঘটনার জমজমাট সব অংশ উল্লেখ থাকলেও কাহিনীর শেষ অংশে তার সঙ্গীদের একে একে মৃত‌্যু ও পরে কাছের লোকদের ষড়যন্ত্রে রবিন হুডেরও মৃত্যু হয়।

লোককাহিনীর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়ানো ও গরীবের উপকারী ফ্যান্টাসি চরিত্র রবিনের বীরত্ব গাঁথা জনমনে প্রশংসা পেলেও তার ও তার দলের শেষ পরিণতি পাঠককে ভাবিয়েছে/ভাবাচ্ছে, আর তার কারণ হচ্ছে আইন ও আইনের সীমা এবং আইনের বাইরে গিয়ে কোনো কর্মকাণ্ড চালালে তার শেষ পরিণতি। আর লোককাহিনী-কাল্পনিক চরিত্র বলেই হয়তো ন্যায়-অন্যায়ের আইনত বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হয়নি রবিন ও তার দলকে। তবে হিটলার যেহেতু বাস্তব চরিত্র সেজন্য সে একসময় চরম জনপ্রিয় থাকলেও পরে তার কর্মদোষে হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের ঘৃনিত অপরাধী। আর তার হত্যাযজ্ঞ যতই অনেকের কাছে যুক্তিযুক্ত/গ্রহণযোগ্য হোক না কেন, তা ভয়ানক আইন পরিপন্থী এবং অনেক ক্ষতি করে ফেলার পরেও তা  শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এক কথায় বলেতে গেলে, আপাত দৃষ্টিতে হিটলার বা রবিন হুডের মতো চরিত্রের কর্মকাণ্ড সফলতা ও যুক্তিযুক্ত মনে হলেও আইনের দৃষ্টিতে তা অপরাধ। কোনো কর্মের উদ্দেশ্য যাইহোক বা যতই মহৎ হোক না কেনো, তা আইনের সীমার মধ্যে না থাকলে একটা সময় সমাজ ও ইতিহাস তা ভাবতে বাধ্য করে।

রাষ্ট্র-সমাজ-প্রতিষ্ঠানে আইন ও আইনের শাসন কার্যক্রম সঠিকভাবে কাজ করলে, হিটলারের মতো মানবতাবিরোধী বা রবিনের মতো জনপ্রিয়/অপরাধী তৈরি হবার শঙ্কা/সম্ভাবনা থাকে না। কোনো প্রেক্ষাপটেই প্রয়োজনও পড়ে না ওইধরণের কোনো চরিত্রের।

অনেকসময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পক্ষ-বিপক্ষের কোনো চরিত্রকে পছন্দ-অপছন্দের কারণে আমরা প্রশংসা-সমালোচনা করি, কখনো পাশে দাড়াই-দূরে ঠেলে দেই। কোনো কোনো কর্মকাণ্ড এক দলের কাছে যুক্তিযুক্ত-গ্রহণযোগ্য আর একদলের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে দেখা দেয়, আমরা একেকজন হয়ে উঠি বিচারক। প্রেক্ষাপট-কথিত প্রমাণ হাজির করিয়ে সাজাও দিয়ে ফেলি, নির্দোষও প্রমাণ করে ফেলি। তাছাড়া আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমার পছন্দের লোক কখনই অপরাধ করতে পারেন না, করলেও তাতে কোনো ষড়যন্ত্র বা যুক্তি আছে বলে দাড় করাই। আর অপছন্দের হলে তার সব কাজই খারাপ আর দোষ প্রমাণ হবার আগেই মহা-অপরাধী হিসেবে দাড় করাই। যার মাধ্যমে আমরা দেশের প্রচলিত আইন আর আইন প্রয়োগের যে ব্যবস্থা/প্রচলন, তা ব্যাহত করছি। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে এর প্রকাশ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।

অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নানা অপরাধে অভিযুক্ত হতে দেখা গেছে, আর সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু ছাত্রনেতা-নেত্রীর কিছু কর্মকাণ্ডের খবর/গুজব সামাজিক মাধ্যমে আলোড়িত হয়েছে। ওইসব ঘটনায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভিযোগ প্রমাণের আগেই কাউকে কাউকে ফেসবুক ট্রায়াল, মিডিয়া ট্রায়াল আর পছন্দের-অপছন্দের ফ্যান্টাসি ট্রায়ালে দোষী সাব্যস্ত বা নির্দোষ প্রমাণ করা হচ্ছে। এতোক্ষণ উপরে যা বলার চেষ্টা করলাম, সাম্প্রতিক এইসব ঘটনা তার একটি উদাহরণমাত্র। এরকম অনেক ঘটনা প্রায়ই আমরা দেখে আসছি।

দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘটে যাওয়া ওইসব ঘটনার কোনোটাই এমন কোনো রকেট সায়েন্স না যে, দেশের প্রচলিত আইনে তা সঠিক তদন্ত করে আইনত ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। কিন্তু আমরা আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার আগেই সবাই সবকিছু বিচারে নেমে পড়ছি। এরকারণ হিসেবে যদি বলি, ‘জ্ঞাত-অজ্ঞাত কারণে দেশের আইন ও আইনের শাসনের প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়েছে/হারাচ্ছে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে আমরা অস্থির হয়ে উঠছি’, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? তবে আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমার আশাবাদ, আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে এবং লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই দেশের আইন-সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র-সমাজসহ সব জায়গায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, কোনো প্রেক্ষাপটেই আইনের সীমারেখার বাইরে থাকতে পারে এমন চরিত্র তৈরি হবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)