২২ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে তিনবার। খেলার মাঠ আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাঠ, দুটোই জরুরি দুই নেত্রীর জন্য। ভারতীয় সময় দুপুর একটায় এবং রাত আটটায় কোলকাতার ইডেন গার্ডেনে তাদের দেখা হয়েছে। খেলা দেখা আর রাজনীতির টুকটাক কথাবার্তায় সময় কাটলো দুজনের। পাশাপাশি সময় কাটানোর মাঝে এই সুযোগ তাদের দুজনের কেউই ছাড়েন নি বলেই মনে করি। এছাড়াও তারা দুজনে সন্ধ্যে ছয়টায় কোলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে আনুষ্ঠানিক ভাবে বৈঠকে বসেছেন। সেটাও একটা সুযোগ দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে দুই নেত্রীর বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করবার।
বাংলাদেশ ও ভারত–দুই রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে বেশ কিছু জরুরী ইস্যু রয়েছে। আমি মনে করি তার মধ্যে নীচের তিনটি ইস্যু সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ। (১), দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক পানি বন্টন; (২) এনআরসি; এবং (৩) সীমান্ত নিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশ সমস্যা।
আন্তর্জাতিক পানি বন্টন
বাংলাদেশ এবং ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় বেশ কিছু নদীর আন্তর্জাতিক পানি বন্টনের ইস্যু তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এর মাঝে গঙ্গা নদীর পানিবন্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে দুই রাষ্ট্রের মাঝে। একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি ঠিক কতখানি প্রয়োগ হচ্ছে তার চাইতে বড় কথা দুই দেশের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সৌভাতৃত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তিস্তা নদীটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক পানি বন্টনের ইস্যুটি স্বভাবতই উঠে আসা উচিৎ। বাংলাদেশ তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে।
এই বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দিল্লী সফরে ছিলেন তখন তিনি সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সাথে এই ব্যাপারে ফোনে কথা বলেছিলেন। কিন্তু এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বরাবরই একটা অনিচ্ছা রয়ে গেছে। তাঁর মতে, তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিলে ভারতের উত্তরবঙ্গে পানির সমস্যা হবে। তবে বিকল্প সমাধান হিসেবে আত্রেয়ী নদীর পানি বাংলাদেশের সাথে বন্টন করার বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে তিস্তা নদীর পানি বন্টন ইস্যুটি সুরাহাহীন রয়ে গেছে। এমনকি তিস্তার পানি না দেয়ায় বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানিও বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে অনড় অবস্থানেই রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। একই সাথে মমতা বন্দোপাধ্যায় দাবি করেছেন যে ভারতের উত্তর দিনাজপুরের বেশ কিছু নদীর উপর বাংলাদেশ বাঁধ তৈরী করেছে। এর ফলে তিনি দাবি করেছেন যে, পানির কষ্ট বেড়েছে ঐ অঞ্চলের কৃষকদের এবং উত্তরবঙ্গে চাষাবাদের সমস্যা দেখে দিয়েছে।
এনআরসি
ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স অর্থাৎ এনাআরসি মানে এটি রাজ্যের বৈধ নাগরিকদের তালিকা । প্রথমবার এই তালিকা তৈরি হয় ১৯৫১ সালে ৷ স্বাধীন ভারতের জনসংখ্যার পরিসংখ্যানের পাশাপাশি আসামের প্রথম এনাআরসি তালিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৭ সালে অনুপ্রবেশকারীদের আসাম থেকে বহিষ্কারের আইন বাতিল করা হয়। ১৯৭৮ সালে ভোটার তালিকায় অভিবাসীদের প্রবেশ করানো হয় ৷ ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে অবৈধ শরণার্থী আইন পাশ করা হয়, যাতে বলা ছিল ১৯৭১ এর ২৪ মার্চের আগে যারা ভারতে এসেছিল তারাই এনআরসি-র অন্তর্ভুক্ত হবে ৷ এরপর ১৯৯৭ সালে নির্বাচন কমিশন শরণার্থীদের নামের যে ভোটারের তালিকা প্রকাশ করে সেই নামগুলির পাশে “সন্দেহজনক” শব্দটি লেখা ছিল। ২০০৩ সালে চালু হয় নাগরিকত্ব আইন। ২০১৫ সালে এনআরসি নবকরণের পাশাপাশি তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের কাজও শুরু হয়। সর্বশেষ, এনআরসিতে মোট আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৬১। চুড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে , ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম।
এখন ভৌগোলিক কারনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এনআরসি ইস্যুটিও যথেষ্ট চিন্তায় ফেলেছে বাংলাদেশকে। ইতিমধ্যেই আসামে চালু হওয়া এনআরসির জন্য যেসব আসামের বাসিন্দা ভারতের “নন সিটিজেন” হিসেবে গণ্য হয়েছেন, তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে কিনা এই নিয়ে সংশয় রয়েছে বাংলাদেশের মনে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন কাউকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না। তারপরও সংশয় দূর হতে সময় লাগবে। তবে এনআরসি নিয়ে শেখ হাসিনার ভরসার জায়গা হতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। মমতা জোরালো ভাবে এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেছেন যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে তিনি এনআরসি চালু করতে দিবেন না।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশ সমস্যা
বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে ৪,১৫৬ কিমি লম্বা আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, এটা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা। এর মধ্যে রয়েছে আসামের সাথে ২৬২ কিমি, ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬ কিমি, মিজোরামের সাথে ১৮০ কিমি, মেঘালয়ের সাথে ৪৪৩ কিমি এবং পশ্চিম বঙ্গের সাথে ২,২১৭ কিমি। ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বিভাগগুলো হোল ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং চট্টগ্রাম।
অভিযোগ রয়েছে যে, গোসম্পদ, খাবার জিনিস, ওষুধ এবং মাদকদ্রব্য ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরা কারবারের গুপ্তপথ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত সীমানাকে ব্যবহার করা হয়। আবার কথিত আছে যে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে সীমানা অতিক্রম করে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ না হলেও একটা নীরব অস্থিতিকর পরিস্থিতি বিরাজমান থাকে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারী বিএসএফ বাহিনী যখন বাংলাদেশের ১৫ বছর বয়সের বালিকা ফেলানিকে হত্যা করে লাশটা সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়ার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিল, সেটা বিশ্ব মানবতাকে নাড়া দিয়েছিল।
তবে এটাও ঠিক যে ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যে চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ, গরু পাচার, মাদক এবং বেআইনি অস্ত্র চালান ইত্যাদি সঙ্ঘটিত হয় তা নিয়ে ইতিমধ্যে দুই দেশের মধ্যে অনেক সম্মেলন হয়েছে। বিজিবি থেকে সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দুর্বৃত্তদের এক তালিকা দেয়া হয়েছে এবং বিএসএফ-ও ঠিক একই ধরনের তালিকা বিজিবিকে হস্তান্তর করেছে। তারপরও ভারত ও বাংলাদেশের জন্য শান্তিপূর্ণ সীমান্তনীতি এবং তার সার্থক প্রয়োগ আমাদের সকলের কাম্য। এখানে উল্লেখ্য যে কিছুদিন আগে ভারতের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয় যে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের আটক করে রেখেছে বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনী। অন্যদিকে বাংলাদেশের দাবী অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জেলেও বেশ কিছু বাংলাদেশী বন্দী হয়ে রয়েছেন। অতএব, সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করি হাসিনা-মমতা বৈঠকে সীমান্ত নিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
ইডেন গার্ডেনে কি হোল তা থাকুক শুধুই বিনোদনের স্মৃতি হিসেবে। কেউ হারবে, কেউ জিতবে; কিন্তু দিনের শেষে আসলে জিতবে দুটি দেশই–বন্ধুত্বের বিজয় সুনিশ্চিত। তবে একই সাথে দুটি দেশের নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে তাজ বেঙ্গল হোটেলে যে কূটনৈতিক পাশা খেলা হবে, সেখানেও দুটি দেশের হাস্যোজ্জ্বল বিজয় দেখতে চাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)