হালদা কি নদীর গল্প? পরিচালক তৌকির আহমেদ বলেছেন নদী ও নারীর গল্প। আমার দর্শকচোখে নদী ও নারীকে ধারন করেই হালদা আরো বিস্তৃত, আরো মহিমাময়। হালদা তাই জীবনের সিনেমা, জীবনের গল্প।
যে হালদা পৃথিবীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের বিস্ময়, যে হালদা চট্টলাবাসীর প্রতিদিনের তৃষ্ণা মেটায়, সারাদেশের মাছের চাহিদার যুগানে ভূমিকা রাখে সেই হালদা মরে যাচ্ছে। প্রতিদিন একটু একটু করে। বাঁক কেটে কমানো হচ্ছে নদীর দৈর্ঘ্য, নিরাপদ আবাস হারাচ্ছে মা মাছেরা। লাগোয়া ইটভাটা আর কারখানার বর্জ্যে প্রতিদিন দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। মাছের ডিম পাড়ার হার প্রতিবছর কমছে। এই বাস্তবতায় হালদা আর তার পাড়ের মানুষদের অবহেলার আড়াল থেকে এনে বিশ্বের সামনে দাঁড় করানোর জন্য প্রথমেই তৌকির আহমেদকে অভিবাদন।
তৌকির আহমেদ গুণী নির্মাতা, জয়যাত্রা, রূপকথার গল্প, দারুচিনি দ্বীপ দেখেই আমরা এই সত্য স্বীকার করে নিয়েছিলাম। কিন্তু চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন অজ্ঞাতনামা’য়। বড় পর্দায় না দেখতে পারার আফসোস সত্ত্বেও ধড়মড়িয়ে আমরা উঠে বসেছিলাম, এতদিনে সত্যিই তাহলে আমাদের জীবনের গল্প পর্দায় বলার এক নিপুণ কথক পাওয়া গেল!
হালদাতেও তৌকির হতাশ করেননি। বরং ভরিয়ে দিয়েছেন দুহাত ভরে। টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আড়াই ঘন্টার এই মুগ্ধভ্রমণ। হালদায় মাছ মারা নিষেধ, খালে খালে ঘুরে যা পাওয়া যায় তাতে পেট চলে না। অনন্যোপায় মাঝি মনু মিয়া মহাজনের ট্রলার নিয়ে সাগরে পাড়ি জমান। অনন্ত জলরাশির বুকে মৃত্যুদূতের মত ধেয়ে আসে জলদস্যুরা। একপর্যায়ে পানিতে ঝাঁপ দেয় মনু মিয়া আর বদি, গুলির শব্দ হয়, শব্দ হয় আমাদের হৃদপিণ্ডেরও। খেল শুরু হয় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের। উত্তাল বাজনা আর হৃদপিন্ডের শব্দকে নিয়ে তৌকির আমাদের জেলেপাড়ার এক আটপৌরে দাওয়ায় এনে দাঁড় করান। অসাধারণ ভিজ্যুয়াল ইফেক্টে ঝড়,বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দ যেন ভাঙন দেখায়। আর কে না জানে নদী একদিক ভাঙলে অন্যদিকে গড়ে, এখানেই তাই আখ্যানের নায়ক নায়িকা বদি-হাসুর গল্পের শুরু; যে গল্প ডালপালা ছড়িয়ে প্রকান্ড এক বৃক্ষ হয়ে ছায়া ফেলে, সেই ছায়ায় আমরা নিজেদের আবিষ্কার করে ভাবি আরে এ তো আমারই জীবন!
মনু মিয়ার চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু আবারও প্রমাণ করেছেন পিতার মমতা আর আর্তি ধারণ করা শ্রেষ্ঠ বাংলাভাষী অভিনেতা তিনিই। এই পিতা যেমন মেয়েকে টাকার অভাবে অপাত্রে তুলে দিয়ে কষ্ট পায়, তেমনি অভাবের তাড়নায় মা মাছ শিকারের কষ্টও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, সন্তানের আকুতি নিয়ে রাতদুপুরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
জাহিদ হাসান অনবদ্য বরাবরের মতোই। যতটুকু মুন্সিয়ানা দেখানোর সুযোগ ছিল, পাশ করে গেছেন ফুল মার্কস নিয়ে।
চটুলতা দিয়ে হাসানো নাটকের বাইরে অনেকদিন পর তরতাজা মোশাররফ করিম। বড় আফসোস হয় অসাধারণ এই অভিনেতার থেকে খুব কমই আমরা পেয়েছি, কত কী পেতে পারতাম। বাপ মা হারা বদির একটা ঘর আর ভালোবাসার স্বপ্ন যখন ইটভাটার চিমনির ধোঁয়ায় মিলিয়ে যায়, সেই ধোঁয়ায় আমাদের শ্বাসকষ্ট হয়। তবু বদিই বলে, মানুষের স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে নেই।
তৌকিরের ভাষায় এই সিনেমা নদী ও নারীর গল্প। হালদা’র সেই নারী তিশা। আপনি যদি তিশার অভিনয়ে আগেই শতভাগ মুগ্ধ হয়েও থাকেন তবু হালদা’র তিশা আপনাকে নতুন করে মুগ্ধ করবে। আলাদা আলাদা অভিব্যক্তিতে নিঃশব্দেও কত হাজার কথা বলে ফেলা যায়, তিশা তা দেখিয়েছেন। শেষটায় নৌকায় বসা তিশা, যার সত্যিকারের কোনো গন্তব্য নেই তাকে দেখে বিষণ্ণ হতে হয়। স্বপ্নবাজ আর সাহসী এই তরুণী জানে না হালদার বুকে একটু পর যে ভোর নামবে তার জন্য সেই দিনে কী অপেক্ষা করে আছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কিছু দুর্বলতা ও মাঝে মাঝে ছন্দপতন স্বীকার করেও এই ছবির শ্রেষ্ঠাংশ তিশা। হালদা’র তিশা শুধু অন্যদের জন্য না, তার নিজের জন্যও বেঞ্চমার্ক হয়ে গেলেন।
দিলারা জামান, রুনা খান, শাহেদ আলীরাও ছোট সুযোগে আলো কেড়েছেন। সংলাপরচয়িতা এখানে সহযোগিতা করেছেন ছুরির ফলার মতো একেকটি সংলাপ তাদের মুখে দিয়ে। গানগুলো ভাল, তবে দুয়েকটা গানের তেমন কোনো প্রয়োজন ছিল না। কবিগানের আসরটির দৃশ্যায়ন, শব্দসংযোজন কোনোটিই ভালো লাগেনি। শিল্পনির্দেশনা, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট অসাধারণ।
একটি দৃশ্যের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। মনু মিয়ার মা মাছ মারার অপরাধবোধ, হাসুর মা মাছের প্রতি দরদ কিংবা মা মাছ মারতে গিয়ে নিরঞ্জনের মৃত্যু, এই সবকিছু মিলে তৌকির আহমেদ সম্ভবত বার্তা দিতে চেয়েছেন এই প্রকৃতি মায়ের মতোই। এই প্রকৃতির জন্য আমাদের হাসুর মতো মমতা থাকুক, ধ্বংস করলে জন্ম নিক অপরাধবোধ নয়তো প্রকৃতি কাউকেই ক্ষমা করবে না। হালদা আমাদের গল্প। এই বাংলার নদী আর তার পোষ্য জনমানুষের জীবনের গল্প। হালদার জন্য শুভকামনা।